জীবনানন্দ দাশের উপন্যাস সমগ্র
জীবনানন্দ দাশ, তিরিশের দশকের অন্যতম আধুনিক কবি। জীবনানন্দের মৃত্যুর পর, তাঁর বেশ কিছু সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর ছবির প্রয়োজন হয়। সে সময়ে ছবি খুঁজতে গিয়েই আবিষ্কৃত হয় চারটি ট্রাঙ্ক, যা ছিল গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের পা-ুলিপিতে পরিপূর্ণ। তাঁর রচিত গল্প-উপন্যাস পরবর্তী সময়ে চার খ-ের সমগ্র হিসেবে প্রকাশিত হয়। ফলে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়, কেন তিনি এসব সাহিত্যকর্ম প্রকাশ করলেন না। যতদূর জানা যায়, কবি জীবনানন্দ যে নব্য ধারায় কাব্য রচনা করেছেন তা তৎকালীন সময়ে যথেষ্ট সমালোচিত ছিল। জীবনানন্দ দাশ মানুষের অন্তর্গত বেদনা, হতাশা, ব্যর্থতা, নৈঃসঙ্গবোধকে এক বিমূর্ত কল্পলোকে অনুভব করেছেন এবং চিত্রকল্পের মাধ্যমে তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। নাগরিক জীবনে একাকী মানুষের ব্যর্থতায় মূল সংকট প্রতিভাত করেছেন। এর মূলে তিনি যৌনতাকে উল্লেখ করেছেন। যার ফলে ব্যক্তিজীবনে বারংবার হোঁচট খেয়েছেন। এমনিতেই তিনি ছিলেন অন্তমুখী। তাঁর ওপর তৎকালীন সাহিত্যিকদের তীব্র কটাক্ষের বিপরীতে নিশ্চুপ থেকেছেন জীবনানন্দ দাশ। চাকরিতে, শিক্ষকতায় এমনিতেই মন বসাতে পারতেন না। তার ওপর কবিতার অশ্লীলতার দায়ে চাকরিচ্যুত হওয়া। প্রায়ই বেকার থাকার কারণে ব্যক্তিজীবনে দাম্পত্যজীবনে জীবনানন্দ অসুখীই ছিলেন। শিল্পের সঙ্গে আপস করতে না চাইলেও অবস্থার চাপে পড়ে কখনো দিশেহারা হয়েছেন।
গল্প-উপন্যাসে তিনি যে বার্তা দিতে চেয়েছেন তা হলো মানুষের জীবনে মূল্যবান হলো টাকা। মানুষের মন নামক স্বত্ব সেখানে বিক্রীত। টাকাই মানুষের সত্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। সব মানুষ ভালো থাকতে চায়। এর উৎস টাকা। কেবলই টাকা। কিন্তু জীবানন্দ দাশ এ জীবনে সুখ পাননি। তাই মানুষের পৈশাচিক ব্যবহার, অবহেলাকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। আধুনিক নাগরিক জীবনের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা অযথাই লক্ষ্যহীন জীবনকে বয়ে চলার আনন্দে তিনি আনন্দিত হতে পারেননি। না ছিল তার বহুরূপী মুখোশ, না ছিল টাকা। তাই সমাজে তার অবস্থান ছিল হতাশাগ্রস্ত, কাপুরুষ, নির্জনতম ব্যক্তি। প্রকৃত পক্ষে কেউই তার ভেতরকার সত্তাকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে পারেননি। জীবনানন্দ দাশ গদ্যরচনায় হাত দেন কাব্য রচনাকালের বছর পাঁচেকের মধ্যে। তা ১৯৩২-৩৩ সালের দিকে।
জীবনানন্দের উপন্যাসে সংঘাত আছে, গভীর জীবনদৃষ্টি আছে। এ সংঘাত সমাজের সঙ্গে নয়, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির নিজের অস্তিত্বের সংঘাত। তাই মাল্যবান, উৎপলা, হেম, কল্যাণী সবার বেদনাই পৃথক, অস্তিত্বের সংকটও ভিন্ন। তাদের একাকিত্ব, বেদনার গভীরতা প্রকাশ করতে গিয়ে জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ অংশ উহ্য রয়ে গেছে। প্রায়ই জীবনানন্দের উপন্যাসের নায়কেরা বিবাহিত, এক সন্তানের পিতা। কিন্তু এ সন্তানেরা উপন্যাসে উপেক্ষিত। দৈনন্দিন জীবন, নারী-পুরুষের কর্মময় জীবনের ছবি, আবেগী-সংসারী মনোভাব এখানে অনুপস্থিত। এ যেন কেবল থাকার জন্যই থাকা। তাঁর সৃষ্ট নায়কেরা আরামে থাকতে চায়, স্ত্রীসঙ্গ চায়। কিন্তু তারা উদ্যমী নয়। প্রতি উপন্যাসেই লেপের উষ্ণতার আড়ালে জীবনের গভীরতর স্বাদের প্রসঙ্গ এসেছে। সংকটের মূলে দারিদ্য। এর ফলেই মাল্যবান-উৎপলা, হেম-কল্যাণী, স্বামী-স্ত্রী হয়েও সর্বদাই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেছে। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মূলে আর্থিক সঙ্গতিকেই গুরুত্ব দেন তিনি। তাই জীবনসায়াহ্নে এসেও উৎপলার সচ্ছল মেজদা-বৌঠান সুখী। অন্যান্য উপন্যাসেও এই প্রবণতা স্পষ্ট। এ ধারা থেকে কিছুটা বের হয়ে আসেন ‘সুতীর্থ’ উপন্যাসে। সুতীর্থ মাল্যবান বা হেমের মতো নয়। সে ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট। তারপরও মানুষের অন্তর্গত বেদনাকে তিনি একইভাবে অনুভব করেছেন। সুতীর্থকে তিনি প্রাণশক্তি দিয়েছেন; কিন্তু বৈরীবিশ্বেও নোংরা বোধের চক্রে তা নিয়ত দ্বিধাগ্রস্ত।‘জলপাইহাটি’ সেদিক থেকে কিছুটা প্রতিবাদী। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নিশীথ সেন, মধ্যবিত্ত। স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে জলপাইহাটি গ্রামে বাস করে। স্ত্রী সুমনা রোগাক্রান্ত। জীবিকার তাগিদে নিশীথ সেন শহরে আসে। মফস্বলের গ-ির বাইরে জীবনকে খোলা চোখে দেখতে গিয়ে, সমাজের, রাষ্ট্রের বড় ফাঁকি চোখে পড়ে তাঁর।
জীবনকে, দাম্পত্য জীবনকে তিনি এক উৎকট রূপে প্রত্যক্ষ করেছেন। কখনো মনে হয়েছে হয়তো প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিজীবন এমনই আবার পরক্ষণেই এ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছেন। যে সংকট নিজে অনুভব করেছেন সেটা এতটা খোলামেলা প্রকাশিত হোক তা হয়তো চাননি জীবনানন্দ দাশ। বর্তমান সময়ে এ উপন্যাসগুলো পাঠে কখনোই শিল্পমান বর্জিত গদ্যসম্ভার বলে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এখানে জীবনের গভীরতা আছে। আধুনিক মানুষের অস্তিত্বের সংকট আছে। অনেকে বলতে পারেন, সংকট থেকে উত্তরণের পথ জীবনানন্দ দেখাতে পারেননি। তাদের বলতে চাই জীবনানন্দ মানুষের বোধকে জাগ্রত করতে চেয়েছেন। জাগ্রত ব্যক্তি মাত্রই আপন কর্তব্য অনুভব করতে পারবেন। যদি পারা যায় তবে কথাশিল্পী জীবনানন্দের সার্থকতা। (ফারহানা সুলতানা)
বাংলা ভাষার বিশুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশের প্রতি এই আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদন, জীবনানন্দ দাশের উপন্যাস সমগ্র।