পুশকিন: রুশ সাহিত্যের সম্রাট
হায়াৎ মামুদ
রুশ সাহিত্যে পুশকিনের আসনের সঙ্গে তুলনীয় ইংরেজি সাহিত্যে শেক্সপীয়র, জর্মন সাহিত্যে গোয়টে ও বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের আসন। কথাসাহিত্যিক ও সমালেচক ভ্লাদিমির নাবোকভ বলেছেন, সব কটি রুশ সম্রাটের রাজত্বকাল মেলালেও পুশকিনের কবিতার একটি পঙক্তিরও যোগ্য হবে না। মাত্র আটত্রিশ বৎসর আয়ুষ্কালে তিনি রুশ ভাষা ও সাহিত্যে একাধারে আধুনিক কাব্যভাষা, বাস্তববাদ, গদ্যকাহিনী, ট্রাজেডি, কাব্যনাট্য প্রভৃতির জনক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। কিন্তু তার প্রতিভার মর্ম ও গুরুত্ব বিদেশীর পক্ষে উপলব্ধি করা, রুশ ভাষা না জেনে, সহজ নয়। কবি রবীন্দ্রনাথের মহত্ত্ব ভাষান্তরের ভিতর দিয়ে যেমন ইউরোপীয় ভাষাভাষী কোন পাঠককে হৃদয়ঙ্গম করানো অসম্ভব, পুশকিনের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটিই ঘটে। এ প্রসঙ্গে এডমন্ড উইলসন ও নাবোকভের বিতর্ক মনে পড়বে। উইলসনের ন্যায় দুঁদে সমালোকে নাচোকভের পুশকিন অনুবাদে খুশি হননি এবং তার অভিযোগের জবাবে নাবোকভাবে তিরস্কারের মোদ্দা কথা ছিল- যা অসম্ভব তা সম্ভব করার দাবি তোলা অযৌক্তিক, আর উইলসন সাহেবের মাতৃভাষা রুশ হলে এমন অন্যায় আবদার তিনি করতে পারতেন না। আমরা জানি যে, ভ্লাদিমির নাবোকভ ছিলেন দ্বিভাষী। মাতৃভাষা রুশ ও অর্জিত ভাষা ইংরেজিতে তার পারদর্শিতার প্রমাণ উভয় ভাষাতেই তার সৃজনশীল সাহিত্য, এবং এ দুটির বাইরে অন্তত ফরাশি ও জর্মানেও তার ঈর্ষাণীয় দখল ছিল।
আলেক্সান্দর সের্গেইয়েভিচ পুশকিনের জন্ম মস্কোয়, ১৭৯৯ সালের ২৬ শে মে। তার বাবা সের্গিয়েই-এর পরিবার ছিল অন্তত ছ’শ বছরের পুরনো রুশ প্রাচীন অভিজাত বংশগুলোর একটি। আর মা ছিলেন সম্রাট পিওৎর ভেলিকি- যাকে আমরা পিটার দ্য গ্রেট হিসেবে জানি, তার অতি ঘনিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য রাজন্য আব্রাহম গানিবালের দৌহিত্রী। ইব্রাহিম হানিবলের জন্মভূমি ছিল আবিসিনিয়া, নানান ভাগ্যবিপর্যয়ের পর ক্রীতদাস হিসেবে তাকে রুশ সম্রাটের নিকট পাচার করা হয়েছিল কিশোর বয়সে। তবে হানিবলও সাধারণ পরিবার থেকে আসেননি, ছোটখাটো রাজপরিবারেরই সন্তান ছিলেন। রুশী রাজদরবারে এসে এই নিগ্রো ছেলেটির যাবতীয় সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটে এবং সম্রাটের নেক নজরে পড়ায় রাশিয়ায় ও ফ্রান্সে পড়াশোনার সুযোগ পান এবং প্রকৌশল বিদ্যায় শিক্ষিত হয়ে ওঠেন। ক্রমশ সম্রাটের সেনাবাহিনীতে, মেজর জেনারেল পদমর্যাদা নিয়ে প্রকৌশল দপ্তরের প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। প্রসঙ্গত, রাজদরবারে আসার পরেই তাকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়েছিল, ইব্রাহিম নামটি হয়ে যায় আব্রাহাম, আর ধর্মপিতা সম্রাট পিওৎর নিজে হওয়ায় সম্পূর্ণ নামটি রূপান্তর ঘটে এভাবে: আব্রাহাম পেত্রোভিচ গানিবাল [রুশীতে হ ধ্বনি নেই।] সম্রাট তাকে খেতাব দিয়ে রাজন্যবর্গের অন্তর্ভুক্ত করে নেন, সম্রাজ্ঞী তাকে বিশেষ স্নেহের চক্ষে দেখতেন। পুশকিন তার অভিজাত বংশ ও আফ্রিকার রক্ত নিয়ে গর্ব করতেন।
তদনীন্তন খান্দানি পরিবারের ঐতিহ্য অনুযায়ী বাড়িতে ফরাশি গর্ভনেস রাখা হয়েছিল। বাড়ির ফাইফরমাশ খাটার জন্য ছিল জর্মন চাকরবাকর, ইংরেজ পরিচারিকাও ছিল । আর ছিলেন আরিনা নামের দাই মা। যার মুখের ঘুমপাড়ানি ছড়া, গল্প ইত্যাদি শুনে শুনে সাধারণ রুশী জনজীবন ও মানুষজনের ভাষা বিষয়ে তিনি সচেতন হয়ে ওঠেন। জীবনীকারগণ বলেছেন, পুশকিন ফরাশি জানতেন ফরাশিদের মতোই, জর্মন, ইতালীয় ও ইংরেজি ভাষা থেকে অনুবাদ করতে পারতেন, গ্রিক ও লাতিন ধ্রুপদী সাহিত্য উত্তমরূপে পাঠ করেছিলেন এবং সমকালীন ইউরোপীয় ও মার্কিন কবি সাহিত্যিকদের রচনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।
পুশকিনের কবি প্রতিভার উন্মেষ ঘটে কিশোর বয়সেই, কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় যখন তার বয়স পনেরো। রুসলান ই লুদমিনা (রুসসান ও লুদমিলা) নামে কাহিনীকাব্য ১৮২০ সালে প্রকাশিত হলে তখন থেকে উদায়মান যুগান্তকারী কবি হিসেবে পূর্বসূরী কবিকুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরবর্তী দশ বছর নানা ধরনের কবিতা রচনা, কবিতা ও কাব্যভাষা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা ও উদ্ভাবনায় ব্যাপৃত থাকেন। পরে তার মন যায় গদ্য রচনার দিকে- গদ্যকাহিনী নির্মাণ, ইতিহাস সম্পর্কিত গবেষণা ইত্যাদি। ১৮৩৬ সালে সভ্রেমিয়েন্নিক (সমকালীন) নামে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করতে শুরু করেন। এই পত্রিকাটি পুশকিনের আরেক অক্ষয় কীর্তি তার অকালমৃত্যুর পরেও এর মৃত্যু ঘটেনি এবং একাধিক সাহিত্যিকের সম্পাদনায় ১৮৬৬ পর্যন্ত চালু ছিল, ও তৎকালীন প্রগতিবাদী সাহিত্যধারাকে প্রতিষ্ঠা করার কাজে সক্রিয় থাকে। আমাদের মনে পড়ে যায়, খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে, বাংলা ‘পরিচয়’ পত্রিকার কথা।
কবির ব্যক্তিগত জীবন খুব সুখের ছিল না। তিনি খোদ সম্রাট কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শিখলেও এবং মেজাজে অভিজাত হলেও মননশীলতায় স্বৈরতন্ত্রবিরোধী ও জনদরদী ছিলেন। ‘ডিসেম্ব্রিস্ট’ নামে বিপ্লবী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত না হলেও তার কবিতা সদস্যদের কাছে পাওয়া গিয়েছিল। ধরা পড়ার পর এই দলের কারো ফাঁসি কারো বা সাইবেরিয়ায় নির্বাসন হয়ে গেলে সম্রাট তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তিনি ওদের চিনতেন কি না; দৃপ্ত উত্তর দিয়েছিলেন পুশকিন, বলেছিলেন: চিনলে জানলে তো ওদের সঙ্গেই থাকতাম। পুশকিন এত জনপ্রিয় ছিলেন যে সম্রাট প্রকাশ্যে কিছু করার সাহস পাননি, কিন্তু আমৃত্য তার পিছনে গুপ্তচর লাগিয়ে রেখেছিলেন। যারা, এমনকি গোপনে কবির ব্যক্তিগত দাম্পত্য সম্পর্কের চিঠিপত্রও খুলে খুলে পড়ত। তাকে নাস্তিক হওয়ার জন্য নির্বাসন দণ্ডও ভোগ করতে হয়েছিল কিছুকাল। পুশকিন বিবাহ করেছিলেন নাতালিয়া ইভানভনা গনচারভা নামের এক ডাকসাইটে বহুবল্লভা সুন্দরীকে। প্রাক বৈবাহিক দিনগুলোয় কবির বোহিমীয় জীবন, পানাসক্তি ও লাম্পট্য ছিল সুবিদিত। কিন্তু বিবাহোত্তর কালে তিনি সংসারী, পত্নীগতপ্রাণ, সুখী হতে চেয়েছিলেন। সন্তানও হয়েছিল কয়েকটি। কিন্তু বিধিলিপি খণ্ডাবে কে? জর্জ দঁত্যা নামের জনৈক ফরাশি এমন ঘনিষ্ঠতা কবি-স্ত্রীর সঙ্গে পাকিয়ে তুললেন যে নিজের সম্মান রক্ষার জন্য ভদ্রলোককে ডুয়েলে আহ্বান না করে পুশকিনের গত্যন্তর থাকল না। দ্বন্দ্বযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হল ১৮৩৭ সালের ২৭ জানুয়ারি তারিখে। শোচনীয়ভাবে আহত হলেন পুশকিন, দুদিন ধরে প্রচুর রক্তক্ষরণে মারা গেলেন ২৯ তারিখে।
1 Comments