দূরের জানলা - কবীর সুমন
১৯৭৬ সাল থেকে আমি কলকাতার দেশ পত্রিকার জন্য নিবন্ধ লেখা শুরু করি। এমনভাবে শুরু করলাম যেন আমি বিরাট কেউ, যার লেখা পাওয়ার জন্য দেশ পত্রিকা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করে থাকতেন। সম্পাদক সাগরময় ঘোষ মহাশয়, যার মতো স্নেহশীল মানুষ আমি কমই দেখেছি, আমার আর্জি চিঠি আর একটি লেখা পড়ে হয়ত মনে করেছিলেন। ছোকরার লেখা ছাপা যেতে পারে। আমার বয়স তখন ২৭, থাকি তখন পশ্চিম জার্মানিতে। এইভাবে আমি জার্মানির সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য বিষয়ে থেকে থেকেই প্ৰবন্ধ নিবন্ধ লিখতে এবং সেগুলি সাগরময় ঘোষ মহাশয়কে পাঠিয়ে দিতে থাকি। উনি সেগুলি দেশ পত্রিকায় ছাপাতে থাকেন। এর পর আমি ১৯৭৯ সালে কিছু মাস কলকাতায় ছিলাম, ভয়েস অফ জার্মানির বাংলা বিভাগের হয়ে সংবাদদাতার কাজ করতাম ফ্রি-লানসার হিসেবে, আর প্রবন্ধ লিখতাম। সেরকম কিছু লিখলেই লেখাটি নিয়ে সটান চলে যেতাম দেশ পত্রিকার দপ্তরে সাগরময় ঘোষের কাছে। তাঁকে পড়তে দিতাম। তিনি বলতেন, রেখে যাও, পড়ে দেখব। পরে কখনও তাঁর মতামত জানতে চলে যেতাম তাঁর দপ্তরে। প্রত্যেক বারই শুনতাম : ও, ঐ লেখাটা? ওটা তো আমি ছাপতে দিয়ে দিয়েছি। --আশ্চৰ্য মানুষ ছিলেন তিনি। লেখা নিয়ে এ-ছাড়া কোনও মন্তব্যই তিনি করতেন না। তখনও আমি সুমন চট্টোপাধ্যায় নামেই লিখতাম। ১৯৮০ সালে আমি চাকরি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চলে গেলাম। সাগরময় ঘোষ আমায় একদিন চিঠি লিখে জানালেন আমার কাছ থেকে তিনি প্ৰতি মাসে একটি লেখা চান। ফিচারের নাম কী দেওয়া যায়? আমার প্রস্তাব ছিল “দূরের জানলা।” তিনি মেনে নিলেন। ওয়াশিংটনে ভয়েস অফ আমেরিকার অফিসে শুনছিলাম নিজের নামে আমি বাইরে কিছু লিখতে পারব না। তাই নাম নিলাম “মানব মিত্র।” তার পর থেকে কয়েক বছর ধরে লিখে গিয়েছি মাসিক ফিচার। আমেরিকা থেকে চলে আসার পর কলকাতায় বসেও প্ৰবন্ধ লিখেছি দেশ-এর জন্য। ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় দফায় জার্মানিতে বেতার সাংবাদিকের চাকরি করতে গিয়েও মাঝেমাঝে লিখেছি দেশ পত্রিকায়। ‘দূরের জানলা’র সময় থেকে সেই যে মানব মিত্র নামে লিখেছি, অন্য কোনও নাম আর ব্যবহার করিনি।
কিছু বছর আগে কয়েকজন বাঙালি তরুণ তরুণী ‘দূরের জানলা’ নামে আমার সেই সময়কার লেখাগুলির একটি সংকলন প্ৰকাশ করেন। কী হল সেই সংকলনের কে জানে। বইটি চোখে দেখেছিলাম বিলক্ষণ। প্রকাশকদের তারপর না দেখেছি চোখে, না শুনেছি তাদের বাঁশি। বইটি আদৌ কেউ কিনল কিনা, কিনলে ক’জন, তার কিছুই জানাননি তাঁর আমায়। পরে লোকমুখে শুনেছি তাদের মধ্যে এক যুবক আমার সম্পর্কে নানান কথা বলে বেড়াচ্ছেন, যার একটি হল আমি “শোধনবাদী” হয়ে গিয়েছি। কবে যে শোধন-না-করে-খাও-বাদী ছিলাম জানি না। ঠিক যেমন জানি না বইটি কয় কপি বিক্রি হয়েছিল। এই যে সপ্তর্ষি প্রকাশন ‘দূরের জানলা' বইটি আবার প্রকাশ করছেন তার কারণ কী আমি জানি না। আশ্চর্য সপ্তর্ষি আমায় প্ৰত্যেক বছর রয়্যালটি দেন। যেরকম বিক্রি হয় সেই হিসেবে। এটাও এক রহস্য। সপ্তর্ষি আমার লেখা গানের সংকলন ছাড়াও আমার আরো কিছু বই বের করেছেন এমনকি দুটি উপন্যাস। বই মেলায় ওঁদের স্টলে গেলে বইগুলি দেখা যায়। মাঝেমাঝে বই মেলায় গিয়ে দেখি। বেশ লাগে। আমার নাম উল্লেখ করার সময়ে বাঙালি অবশ্য আমায় “গায়কই বলেন। কেউ কেউ আবার শখ করে আমায় কবি’ও বলে থাকেন। তাদের ধারণা আমি কবিতা লিখেছি, এখনও লিখছি। এই হল কবিতা সম্পর্কে তাঁদের ধারণা। ‘দূরের জানলা” কেউ পড়বে বলে আমার মনে হয় না। হিসাব করে দেখেছি জন্য জনাত্রিশ মানুষ আমার গান বাজনা সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন তারাই পড়বেন ভালোবাসার জায়গা থেকে।
যা বুঝেছি, সপ্তর্ষি আমায় ভালবাসেন। আমিও তাঁদেরভালবাসি। ল্যাঠা চুকে গেল। সুমন চট্টোপাধ্যায় মানব মিত্র হয়েছিল একদিন। তারও ঢ়ের পরে একদিন সুমন চট্টোপাধ্যায় আর মানব মিত্র মিলে কবীর সুমন হয়ে গিয়েছিল। সেই নামেই আমি বর্তমান। এই তো, হয়ে এল। শিগগিরিই একদিন আমার অসংখ্য শত্রুর মুখে মধু দিয়ে আমি এই নামটি নিয়েই অতীত হয়ে যাব।
বিনীত
কবীর সুমন
১৯/জি, বৈষ্ণবঘাটা বাই লেন
কলকাতা ৭০০০৪৭
১৯৭৬ সাল থেকে আমি কলকাতার দেশ পত্রিকার জন্য নিবন্ধ লেখা শুরু করি। এমনভাবে শুরু করলাম যেন আমি বিরাট কেউ, যার লেখা পাওয়ার জন্য দেশ পত্রিকা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করে থাকতেন। সম্পাদক সাগরময় ঘোষ মহাশয়, যার মতো স্নেহশীল মানুষ আমি কমই দেখেছি, আমার আর্জি চিঠি আর একটি লেখা পড়ে হয়ত মনে করেছিলেন। ছোকরার লেখা ছাপা যেতে পারে। আমার বয়স তখন ২৭, থাকি তখন পশ্চিম জার্মানিতে। এইভাবে আমি জার্মানির সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য বিষয়ে থেকে থেকেই প্ৰবন্ধ নিবন্ধ লিখতে এবং সেগুলি সাগরময় ঘোষ মহাশয়কে পাঠিয়ে দিতে থাকি। উনি সেগুলি দেশ পত্রিকায় ছাপাতে থাকেন। এর পর আমি ১৯৭৯ সালে কিছু মাস কলকাতায় ছিলাম, ভয়েস অফ জার্মানির বাংলা বিভাগের হয়ে সংবাদদাতার কাজ করতাম ফ্রি-লানসার হিসেবে, আর প্রবন্ধ লিখতাম। সেরকম কিছু লিখলেই লেখাটি নিয়ে সটান চলে যেতাম দেশ পত্রিকার দপ্তরে সাগরময় ঘোষের কাছে। তাঁকে পড়তে দিতাম। তিনি বলতেন, রেখে যাও, পড়ে দেখব। পরে কখনও তাঁর মতামত জানতে চলে যেতাম তাঁর দপ্তরে। প্রত্যেক বারই শুনতাম : ও, ঐ লেখাটা? ওটা তো আমি ছাপতে দিয়ে দিয়েছি। --আশ্চৰ্য মানুষ ছিলেন তিনি। লেখা নিয়ে এ-ছাড়া কোনও মন্তব্যই তিনি করতেন না। তখনও আমি সুমন চট্টোপাধ্যায় নামেই লিখতাম। ১৯৮০ সালে আমি চাকরি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চলে গেলাম। সাগরময় ঘোষ আমায় একদিন চিঠি লিখে জানালেন আমার কাছ থেকে তিনি প্ৰতি মাসে একটি লেখা চান। ফিচারের নাম কী দেওয়া যায়? আমার প্রস্তাব ছিল “দূরের জানলা।” তিনি মেনে নিলেন। ওয়াশিংটনে ভয়েস অফ আমেরিকার অফিসে শুনছিলাম নিজের নামে আমি বাইরে কিছু লিখতে পারব না। তাই নাম নিলাম “মানব মিত্র।” তার পর থেকে কয়েক বছর ধরে লিখে গিয়েছি মাসিক ফিচার। আমেরিকা থেকে চলে আসার পর কলকাতায় বসেও প্ৰবন্ধ লিখেছি দেশ-এর জন্য। ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় দফায় জার্মানিতে বেতার সাংবাদিকের চাকরি করতে গিয়েও মাঝেমাঝে লিখেছি দেশ পত্রিকায়। ‘দূরের জানলা’র সময় থেকে সেই যে মানব মিত্র নামে লিখেছি, অন্য কোনও নাম আর ব্যবহার করিনি।
কিছু বছর আগে কয়েকজন বাঙালি তরুণ তরুণী ‘দূরের জানলা’ নামে আমার সেই সময়কার লেখাগুলির একটি সংকলন প্ৰকাশ করেন। কী হল সেই সংকলনের কে জানে। বইটি চোখে দেখেছিলাম বিলক্ষণ। প্রকাশকদের তারপর না দেখেছি চোখে, না শুনেছি তাদের বাঁশি। বইটি আদৌ কেউ কিনল কিনা, কিনলে ক’জন, তার কিছুই জানাননি তাঁর আমায়। পরে লোকমুখে শুনেছি তাদের মধ্যে এক যুবক আমার সম্পর্কে নানান কথা বলে বেড়াচ্ছেন, যার একটি হল আমি “শোধনবাদী” হয়ে গিয়েছি। কবে যে শোধন-না-করে-খাও-বাদী ছিলাম জানি না। ঠিক যেমন জানি না বইটি কয় কপি বিক্রি হয়েছিল। এই যে সপ্তর্ষি প্রকাশন ‘দূরের জানলা' বইটি আবার প্রকাশ করছেন তার কারণ কী আমি জানি না। আশ্চর্য সপ্তর্ষি আমায় প্ৰত্যেক বছর রয়্যালটি দেন। যেরকম বিক্রি হয় সেই হিসেবে। এটাও এক রহস্য। সপ্তর্ষি আমার লেখা গানের সংকলন ছাড়াও আমার আরো কিছু বই বের করেছেন এমনকি দুটি উপন্যাস। বই মেলায় ওঁদের স্টলে গেলে বইগুলি দেখা যায়। মাঝেমাঝে বই মেলায় গিয়ে দেখি। বেশ লাগে। আমার নাম উল্লেখ করার সময়ে বাঙালি অবশ্য আমায় “গায়কই বলেন। কেউ কেউ আবার শখ করে আমায় কবি’ও বলে থাকেন। তাদের ধারণা আমি কবিতা লিখেছি, এখনও লিখছি। এই হল কবিতা সম্পর্কে তাঁদের ধারণা। ‘দূরের জানলা” কেউ পড়বে বলে আমার মনে হয় না। হিসাব করে দেখেছি জন্য জনাত্রিশ মানুষ আমার গান বাজনা সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন তারাই পড়বেন ভালোবাসার জায়গা থেকে।
যা বুঝেছি, সপ্তর্ষি আমায় ভালবাসেন। আমিও তাঁদেরভালবাসি। ল্যাঠা চুকে গেল। সুমন চট্টোপাধ্যায় মানব মিত্র হয়েছিল একদিন। তারও ঢ়ের পরে একদিন সুমন চট্টোপাধ্যায় আর মানব মিত্র মিলে কবীর সুমন হয়ে গিয়েছিল। সেই নামেই আমি বর্তমান। এই তো, হয়ে এল। শিগগিরিই একদিন আমার অসংখ্য শত্রুর মুখে মধু দিয়ে আমি এই নামটি নিয়েই অতীত হয়ে যাব।
বিনীত
কবীর সুমন
১৯/জি, বৈষ্ণবঘাটা বাই লেন
কলকাতা ৭০০০৪৭