Ticker

6/recent/ticker-posts

হুমায়ূন আহমেদের ফাউনটেনপেন ১২

হুমায়ূন আহমেদের ফাউনটেনপেন ১২ অপেক্ষা
humayunahmed.jpg
মানবজীবন হলো অপেক্ষার জীবন। ছোটখাটো অপেক্ষা দিয়ে জীবনের শুরু_মা কি আমাকে চকলেট কিনে দেবে? বাবা কি আজ ঘোড়া ঘোড়া খেলবে? বাবা ঘোড়া হবে, আমি তার পিঠে উঠে হেট হেট করব।
জীবনের শেষে অপেক্ষার ধরন সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। তখন অপেক্ষা মৃত্যুর। এই মৃত্যুকে মহিমান্বিত করার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান।' মহাপুরুষদের কাছে মৃত্যুর অপেক্ষা হয়তো বা আনন্দময়। আমি সাধারণ অভাজন হওয়ার কারণে মৃত্যুচিন্তা মাথায় এলে অস্থির হয়ে যাই। আমি চলে যাব তার পরেও আকাশ ভেঙে জোছনা নামবে, 'সবাই যাবে বনে'। আষাঢ় মাসে আকাশ অন্ধকার করে মেঘ জমবে। তরুণীরা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গাইবে, 'এসো করো স্নান নবধারা জলে'। সেই অপূর্ব নবধারা জল দেখার জন্যে আমি থাকব না, এর কোনো মানে হয়?
প্রসঙ্গ আপাতত থাকুক। নানাবিধ অপেক্ষার গল্প করা যাক। আধুনিক নগরজীবনে নতুন কিছু 'অপেক্ষা'র সৃষ্টি হয়েছে, যা আগে ছিল না। যেমন, গাড়িতে বসে, গরমে সিদ্ধ হতে হতে 'যানজট' খোলার অপেক্ষা। এই অপেক্ষা অর্থবহ করার অনেক চেষ্টা আমি করেছি, যেমন গাড়ির সিট পকেটে সহজে হজম হয় এমন বই। অ্যাসিমভের, 'ইড়ড়শ ড়ভ ঋধপঃং'. উন্মাদ পত্রিকার সম্পাদক আহসান হাবীবের কিছু রসিকতার বই। রিপ্লের একটা বই, যেখানে উদ্ভট উদ্ভট কাহিনী। এর বাইরে আছে মোবাইল ফোনে সাপের খেলা।

জ্যামে আটকা পড়লে কোনো কিছুই ভালো লাগে না। বইয়ের পাতা খুলতেই পারি না। মোবাইল ফোনের সাপ নিয়ে তখন খেলতে বসি। সাপকে আপেল, চেরি ফল খাইয়ে লম্বা করাই হলো খেলার নিয়ম। কিছুক্ষণ সাপকে খাওয়ানোর পরে মনে হয় এখন কী করা যায়? অন্যদের কথা জানি না, জ্যামে আটকা পড়লে অবধারিতভাবে আমার ছোট বাথরুম পায়। তখন গভীর শঙ্কা নিয়ে ভাবি, আগামী তিন ঘণ্টায় যদি জ্যাম না ছোটে তাহলে কী কেলেংকারি হবে কে জানে!
যানজটে সবাই অসুখী হন তা-না। ভিক্ষুক এবং ফেরিওয়ালারা দন্ত বিকশিত করে হাসেন। ভিক্ষুকের হাত থেকে বাঁচার কূটকৌশল একজন আমাকে শিখিয়েছেন। ভিক্ষুক যখন ভিক্ষা চাইবে তখন তাদের দিকে তাকানো যাবে না। ভাব করতে হবে, ভিক্ষুকরা অদৃশ্য মানব। এদেরকে দেখা যাচ্ছে না। 'মাফ করেন'_বাক্যটাও ওদের দিকে তাকিয়ে বলা যাবে না। চোখে চোখ পড়লেই নাকি ধরা খেতে হয়।
জলজ্যান্ত মানুষকে অদৃশ্য মানব ভাবা কঠিন কর্ম। আমি ভিক্ষুকদের দিকে তাকাই। যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে বলি, মাফ করেন। মাফ চাইতে গিয়ে আমার জীবনে একটা ঘটনা ঘটেছে। জনৈক ভিক্ষুক বলেছে, স্যার, সকাল থাইকা আমি খালি মাফই করতেছি। আর কত মাফ করব?
এমন বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ ভিক্ষুকের কাছ থেকে আশা করা যায় না। আমি মানিব্যাগ খুলে ১০০ টাকার একটা নোট বের করলাম।
কয়েকদিন আগে পত্রিকায় একজন ভিক্ষুকের ছবি ছাপা হয়েছে। সে নাকি ভিক্ষা করে কোটিপতি হয়েছে। সে তার সন্তানদের সমাজে আদর্শ ভিক্ষুক হিসেবে দেখতে চায় এবং তাদের সাফল্য কামনা করে।
ইদানীং পত্রিকায় কোটিপতিদের নিয়ে ফিচার হচ্ছে। কেউ কাঁচামরিচের ক্ষেত করে কোটিপতি, কেউ ঝিংগা চাষ করে কোটিপতি। কোটিপতিদের ছবিও ছাপা হয়। ছবিতে তাঁদের অত্যন্ত বিমর্ষ দেখায়। কোটিপতি হয়ে তাঁরা এমন বিমর্ষ কেন কে জানে! পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে একেক ধরনের খবরের জোয়ার আসে। একটা সময় গেছে গাই গরুর। সবাই গাই গরু পাচ্ছে। তাদের ছবি ছাপা হচ্ছে। বেশির ভাগ সময়েই চিন্তিত কৃশকায় এক তরুণী গরুর দড়ি ধরে ভীত চোখে গরুর দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন জোয়ার চলছে কোটিপতির। সম্প্রতি পড়লাম শামুক বিক্রি করে কোটিপতি।
অপেক্ষা বিষয়ে বলতে গিয়ে অন্য বিষয়ে চলে এসেছি। মূল বিষয়ে আসা যাক। অপেক্ষার শ্রেণীভেদ_
কসাইয়ের অপেক্ষা
কসাই অপেক্ষা করে একদিন তার ছেলে এমন নামি কসাই হবে, যে একটা আস্ত গরু এক ঘণ্টায় নামিয়ে ফেলবে।
ছাত্রলীগের অপেক্ষা
পড়াশোনা, ভালো রেজাল্ট_এই সব নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না, তাদের অপেক্ষা টেন্ডার নিয়ে। তারা বাকি জীবন ছাত্রলীগের সেবা করে যেতে চায়। সময় হলে বয়স্কভাতার জন্যে আবেদনের ইচ্ছাও তারা পোষণ করে। বর্ষাকালে 'কই' মাছ উজায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসা মানে ছাত্রলীগের বর্ষাকাল। তারা একসঙ্গে 'উজায়া' যায়।
তাদের থামানোর নানান চেষ্টার কথা শুনছি। কোনোটিই মনে হয় কাজ করছে না।
লিচু খাওয়া নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ মারামারি করেছে। দশ জন আহত। এই খবর কিছুক্ষণ আগে পড়েছি। লিচুর পরপরই আমের সিজন আসছে। ভয়ে আছি, তখন না জানি কী হয়।
আমি তখন শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর। শহীদুল্লাহ হল ছাত্রলীগের এক কর্মী কী একটা কাজে যেন এসেছে। আমি তাকে বললাম, এই তোমরা তো আওয়ামী লীগের লেজ।
সেই ছেলে চোখ কপালে তুলে বলল, স্যার এটা কী বলেন? আওয়ামী লীগ আমাদের লেজ।
সাম্প্রতিক ঘটনা দেখে ওই ছাত্রের কথাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে।
ডাক্তারদের অপেক্ষা
তাদের অপেক্ষা রোগের জন্যে। তাদের কোনো জাতীয় সংগীত থাকলে তার প্রথম পঙ্ক্তি হতো_'আয় রোগ আয়, উড়াল দিয়ে আয়।'
কিছুদিন আগে হৃদয়ঘটিত সমস্যা নিয়ে ল্যাবএইডে ডাক্তার বরেন চক্রবর্তীর কাছে গিয়েছিলাম। বরেন চক্রবর্তী লেখক মানুষ বলেই লেখকদের বিশেষ খাতির করেন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার জন্যে চার ঘণ্টা প্লাস্টিকের লাল চেয়ারে বসে থাকতে হয় না। দেড় থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে ভেতরে ডাক পড়ে।
বরেন চক্রবর্তী যে রসিক মানুষ তা জানা ছিল না। তাঁর একটি রসিকতায় যথেষ্ট মজা পেয়েছি। পাঠকদের সঙ্গে রসিকতাটা ভাগাভাগি করা যেতে পারে।
বরেন চক্রবর্তীর নিয়ম হচ্ছে, রোগীকে বিছানায় শুইয়ে প্রথমেই রোগীর দুই পায়ের পাতা স্পর্শ করা (পালস দেখার জন্যে)। একদিন তা-ই করছেন। রোগী বলল, শুরুতেই আপনি পায়ে ধরেন কেন?
বরেন চক্রবর্তী বললেন, ইচ্ছা করে কি আর পায়ে ধরি? বিবেকের দংশনে পায়ে ধরি।
রোগী : ব্যাপারটা বুঝলাম না। কিসের বিবেকের দংশন?
বরেন চক্রবর্তী : এই যে আপনার চিকিৎসা শুরু হলো। ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হবেন। জলের মতো টাকা যাবে। আপনার অর্থ ব্যয়ের পেছনে আমার একটা ভূমিকা আছে বলেই বিবেকের তাড়নায় প্রথমেই আপনার পায়ে ধরছি।
ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ ডাক্তার বরেন চক্রবর্তীর রসিকতা কিভাবে নেবে কে জানে! তবে ক্ষমতাধর সব রাজনৈতিক নেতাই ডাক্তার বরেন চক্রবর্তীর বাঁধা রোগী। ডাক্তার বরেনের জন্যে এটা একটা আশার কথা।
ভয়ঙ্কর অপেক্ষা
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দীর্ঘদিবস দীর্ঘরজনী ফাঁসির অপেক্ষাকে আমি বলব ভয়ঙ্কর অপেক্ষা। প্রতি মুহূর্তেই মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখা। এদের একজন মহিউদ্দিনকে যখন ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে তখন সে জল্লাদদের বলল, আমি অসুস্থ মানুষ। আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না? জানি না সেই সময় শিশু রাসেলের জলভরা করুণ মুখের ছবি একবারও তার মনে পড়েছিল কি না।
যুদ্ধ-অপরাধীদের অপেক্ষা
তারা অবশ্যই নাজাতের অপেক্ষায় আছে। 'ঊাবৎুনড়ফু রং ঢ়ধরফ নধপশ নু যরং ড়হি পড়রহ'_এই ইংরেজি আপ্তবাক্যটি তাদের মর্মমূলে পেঁৗছেছে বলেই আমার ধারণা।

পাদটীকা
বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় অভিনেতা সোহেল রানা আমাকে উদ্দেশ করে কিছু কথা বলেছেন। যেমন_ছবি নামে আমি যেসব রসগোল্লা বানিয়েছি তা কেউ দেখে না।
অতি সত্যি কথা। ছবি বানানোর শখ পূরণের জন্যে আমি অনেক টাকাই নষ্ট করেছি। ভবিষ্যতেও করব। ন্যাড়া একবার বেলতলায় যায়, আমার মাথায় এখনো কিছু চুল অবশিষ্ট আছে বলে বারবার বেলতলায় যাই।
সোহেল রানার দ্বিতীয় বক্তব্য_"আপনি দেশ নিয়ে স্বাধীনতার ৩০ বছরেরও বেশি সময় পরে 'জোছনা ও রজনীর গল্প' উপন্যাসটি লিখেছেন। সত্যিকার দেশপ্রেম আপনার মধ্যে থাকলে আপনি অনেক আগেই এ ধরনের লেখা লিখতেন। এ থেকেই আপনার দেশপ্রীতি যে কতটুকু তা বোঝা যায়। তাই আপনি ভারতীয় ছবির পক্ষে লিখবেন, বলবেন_এতে তো অবাক হবার কিছু নেই।"
আমার দেশপ্রেমের অবস্থা সর্বনিম্ন পর্যায়ের, তা জেনে শঙ্কিত বোধ করছি। এখন কী করা যায়? কোনো একদিন দেশপ্রেম জাগ্রত হবে তার জন্যে অপেক্ষা? অপেক্ষায় থাকলাম।

কুইজ
বাথরুমে যে টয়লেট পেপার ব্যবহার করা হয় তা কাদের আবিষ্কার?
উত্তর : চীনাদের (১৩৯১ সন)।
ফিলাডেলফিয়ার ঝপড়ঃঃ চধঢ়বৎ ঈড়সঢ়ধহু টয়লেট পেপারের রোল বাজারে আনে ১৮৭৯ সালে।
আমি আমেরিকার এক হোটেলে বিন লাদেনের ছবি ছাপা টয়লেট পেপার দেখেছি।

Post a Comment

0 Comments