হুমায়ূন আহমেদের ফাউনটেনপেন
১৩.
স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন
দুঃস্বপ্ন নিয়ে লেখা সাইকোলজির একটা বই পড়ছিলাম, 'ঘরমযঃসধৎব ুড়ঁ যধঃব'. মানুষ কী দুঃস্বপ্ন দেখে, কেন দেখে তা-ই বিতং করে লেখা। আমি আমার দুঃস্বপ্নগুলি বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাচ্ছিলাম। বই পড়ে জানলাম, মানুষ সবচেয়ে বেশি যে দুঃস্বপ্ন দেখে তা হচ্ছে উঁচু জায়গা থেকে পতন। এই পতনের শেষ নেই। একসময় সে আতঙ্কে জেগে ওঠে।
এই বিশেষ দুঃস্বপ্ন আমি যৌবনকালে দেখতাম। এখন আর দেখি না। বইয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে_এই দুঃস্বপ্ন অসহায়ত্বের প্রতীক। কেউ যদি অসহায় বোধ করে তখনই এই দুঃস্বপ্ন দেখে। হয়তো যৌবনে আমি অসহায় বোধ করতাম।দ্বিতীয় দুঃস্বপ্ন যা মানুষ প্রায়ই দেখে, তা হচ্ছে জনসমাবেশে নিজেকে নগ্ন অবস্থায় আবিষ্কার করা। নিজের সম্মান নিয়ে যারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তারাই নাকি এই দুঃস্বপ্ন দেখেন। আমি নিজে কয়েকবার নগ্ন অবস্থায় নিজেকে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে দেখেছি। স্বপ্নে পুরো ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হয়েছে।
আজকাল কেন জানি স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন কোনোটাই দেখি না। গভীর রাতে ঘুমাতে যাই। এমনিতেই আমার ঘুম ভালো হয়, তারপরও ডাক্তারের পরামর্শে ডিজোপেন নামের একটা ঘুমের ওষুধ খাই। সাইকিয়াট্রিস্ট এবং লেখিকা আনোয়ারা সৈয়দ হক আমি ডিজোপেন খাই শুনে আঁতকে উঠে বলেছিলেন, এটা তো পাগলের ওষুধ। আপনি পাগলের ওষুধ খাচ্ছেন কেন?
আমি বিনয়ের সঙ্গে বলেছি, আমি তো পাগলই!
কড়া ঘুমের ওষুধ মাথা থেকে স্বপ্ন তাড়িয়ে দেয়। যারা ঘুমের ওষুধ খায় তাদের স্বপ্ন দেখার কথা না, তারপরও কয়েক দিন আগে স্বপ্নে দেখলাম, আমি ক্লাস নিচ্ছি। একদল ছাত্র গম্ভীর মুখে বসে আছে। আমি তাদেরকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের চধৎঃরপষব রহ ধ নড়ী ঢ়ৎড়নষবস পড়াচ্ছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম আমার প্যান্টের ফ্লাই খোলা। প্রবল আতঙ্কে ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় বসে আছি আর ভাবছি, এই স্বপ্নটা কেন দেখলাম? বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা মিস করছি বলে দেখছি? ক্লাসে পড়াচ্ছি ঠিক আছে, প্যান্টের ফ্লাই খোলা কেন? এর অর্থ কী? সাইকিয়াট্রিস্টরা স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে চিন্তা করতে থাকুন, এই ফাঁকে আমি বলে ফেলি যে অধ্যাপনার বিষয়টা আমি 'মিস' করি। 'মিস' করার ভালো বাংলা পাচ্ছি না বলে ইংরেজি শব্দটাই লিখলাম। বাংলায় মিস করা হলো অভাববোধ, দুঃখবোধ। কোনোটাই মূল ইংরেজি শব্দের সঙ্গে যাচ্ছে না।
অধ্যাপনার সময়টা ছিল আমার অর্থকষ্টের কাল। টেলিভিশন কেনার সামর্থ্য ছিল না বলে বাসায় টেলিভিশন ছিল না। হাতের কাছের সমুদ্রে পা ভেজানোর সামর্থ্যও ছিল না। তারপরও দুঃখে-কষ্টে সময়টা ভালো কেটেছে। কেমিস্ট্রির দুরূহ বিষয় ছাত্রদের কাছে পরিষ্কার করতে পারছি_এই আনন্দ তুলনাহীন।
বহিরাগত পরীক্ষক হয়ে তখন বরিশাল-পটুয়াখালী যেতাম। যাওয়া-আসার ঞঅ, উঅটা সংসারের কাজে আসত। ঢাকা থেকে লঞ্চ ছাড়ত সন্ধ্যাবেলায়। লঞ্চের ডেকে একা বসে থাকার আনন্দও ছিল সীমাহীন। আজকাল একা থাকতে পারি না। সব সময় আশপাশে মানুষজন লাগে। মানসিক এই পরিবর্তন কেন হচ্ছে কে জানে!
আমি বহিরাগত একজামিনার হিসেবে সবচেয়ে বেশি গিয়েছি বরিশাল বিএম কলেজে। আমার থাকার ব্যবস্থা হতো কেমিস্ট্রির ল্যাবরেটরির একটা ঘরে। ঘরভর্তি মাকড়সা। মেঝেতে তেলাপোকা। ল্যাবরেটরি গাছপালার মাঝখানে। সন্ধ্যার পর পরিবেশ ভুতুড়ে হয়ে যেত। অধ্যাপক নিজের বাড়ি থেকে ভদ্রতা করে খাবার আনতেন তা-না। বহিরাগত পরীক্ষকের 'সেবা'র জন্য ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হতো।
রাত ৯টার পর রসায়নের কোনো এক অধ্যাপকের বাসা থেকে খাবার আসত। রাত ৯টাতেই মনে হতো নিশুতি রাত। মশারি খাটিয়ে মশারির ভেতর বসে থাকতাম। ঘুম আসত না। মাকড়সা, তেলাপোকা ছাড়াও অন্য একটি ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করত। সেটা হলো ভূতের ভয়। এতে একটা লাভ অবশ্যি হয়েছে, আমি বেশ কিছু ভূতের গল্প লিখেছি।
বিএম কলেজে দিনযাপনের একটা গল্প বলা যেতে পারে। এক সন্ধ্যায় মধ্যবয়স্ক এক মহিলা বিশাল বাহারি কাজ করা পিতলের টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁর সাজগোজ দেখার মতো। হাতভর্তি সোনার গয়না (সেই সময় নকল গয়নার চল শুরু হয়নি)। গলায় চন্দ্রহার। ভদ্রমহিলা অতি পরিচিতজনের গলায় বললেন, হুমায়ূন ভাই ভালো আছেন?
আমি বললাম, জি। আপনাকে চিনতে পারলাম না।
ভদ্রমহিলা তাঁর নাম বললেন। তিনি যে আমার কিছু বই পড়েছেন সে তথ্য জানালেন। টিফিন ক্যারিয়ারভর্তি পোলাও, কোর্মা, ঝালমাংস এবং ইলিশ মাছ ভাজা এনেছেন তাও শুনলাম।
একজন নতুন প্রায় অখ্যাত লেখকের জন্য বিপুল আয়োজন আমাকে বিস্মিত করল। ভদ্রমহিলা জানালেন, তিনিও একজন লেখিকা। একটা উপন্যাস সম্প্রতি লিখে শেষ করেছেন। উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। আমাকে পাণ্ডুলিপি পড়তে হবে।
আমি বললাম, আপনি পাণ্ডুলিপি রেখে যান। আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ব।
ভদ্রমহিলা বললেন, পাণ্ডুলিপি রেখে গেলে আপনি পড়বেন না। তার চেয়েও বড় কথা, আমি আমার পাণ্ডুলিপি কখনো হাতছাড়া করি না। বলা তো যায় না, কোত্থেকে কী হয়। আমি নিজে আপনাকে পড়ে শোনাব।
কত পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি?
চার শ' পৃষ্ঠার।
চার শ' পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি পড়তে আপনার কতক্ষণ লাগবে?
আট ঘণ্টা লাগবে। আমি একজনকে পড়ে শুনিয়েছিলাম। আট ঘণ্টা পঁচিশ মিনিট লেগেছে।
সারা রাত আপনি আমাকে পাণ্ডুলিপি পড়ে শোনাবেন?
আমি খবর নিয়েছি আপনি আরো চার দিন আছেন। আমি রোজ সন্ধ্যায় এসে দুঘণ্টা পড়ব। সময় নষ্ট না করে শুরু করে দেই?
আমি তখন পুরোপুরি হতাশ। এই মহিলার হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো পথ দেখছি না।
প্রতি সন্ধ্যায় কালজয়ী কোনো লেখাও আমি লেখকের মুখ থেকে শুনব না।
ভদ্রমহিলা বললেন, হুমায়ূন ভাই, এটা একটা প্রেমের করুণ উপন্যাস। নৌকাতে নায়ক-নায়িকার প্রেম হয়। নৌকা ঝড়ের মধ্যে পড়ে। নায়িকা সাঁতার জানে না। তাকে বাঁচাতে গিয়ে নায়কেরও সলিল সমাধি হয়। দুজনকে উদ্ধারের পর দেখা যায়, দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে মরে পড়ে আছে। পড়া শুরু করি?
আমি হতাশ গলায় বললাম, করুন।
ভদ্রমহিলা পাঠ শুরু করলেন। তাঁর উপন্যাসের প্রথম বাক্য_'নৌকার মাঝি বদর বদর বলে নৌকা ছেড়ে দিল।'
আমি বললাম, থামুন। আমি ভাটি অঞ্চলের দিকের মানুষ। জীবনে অসংখ্যবার নৌকায় চড়েছি। কখনো শুনিনি কোনো মাঝি বদর বদর বলে নৌকা ছাড়ে। আপনি শুনেছেন?
না।
তাহলে কেন লিখেছেন, মাঝি বদর বদর করে নৌকা ছেড়ে দিল? আপনার পর্যবেক্ষণে ভুল আছে। আপনি আশপাশে কী হয় দেখেন না। আপনার লেখা কিছু হবে বলে আমি মনে করি না। আমি আপনার লেখা শুনব না।
পুরোটা না শুনলে কিভাবে বুঝবেন?
হাঁড়ির ভাত সিদ্ধ হয়েছে কি না জানার জন্য একটা ভাত টেপাই যথেষ্ট।
প্রতিটি ভাত টিপতে হয় না। আপনার ভাত সিদ্ধ হয় নাই। আপনার নিজের ভাত সিদ্ধ হয়েছে? নিজেকে আপনি কী মনে করেন?
ভদ্রমহিলা যথেষ্ট চেঁচামেচি করে টিফিন ক্যারিয়ার ফেরত নিয়ে চলে গেলেন।
আমার মাংস-পোলাও খাওয়া হলো না।
এ ধরনের সমস্যা আমার এখনো মাঝে মাঝে হয়। তার একটা গল্প বলি। এক তরুণী কবি আমাকে কবিতার বই দিতে এসেছে। বইটা তাকে নিজ হাতে আমাকে দিতে হবে, কারণ কবি বইটা আমাকে উৎসর্গ করেছে। এটি তার প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ।
আমি তাকে বাসায় আসতে বললাম। চবি্বশ-পঁচিশ বছর বয়সী এক তরুণী। বিষাদগ্রস্ত চেহারা। খুবই অস্থিরমতি। স্থির হয়ে তাকাচ্ছেও না।
আমাকে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার জন্য তাকে ধন্যবাদ দিলাম।
সে বলল, স্যার, আমি আপনার কিছু সময় নেব। সবগুলি কবিতা আমি নিজে আপনাকে পড়ে শোনাব। আপনি না বললে শুনব না।
বলেই সে অপেক্ষা করল না। বই খুলে কবিতা আবৃত্তি শুরু করল। চটি বই কবিতা পড়ে শেষ করতে আধঘণ্টার মতো লাগল। আমি বললাম, ভালো হয়েছে। কবি হতাশ গলায় বলল, ভালো হয়েছে বলে শেষ করলে হবে না। আপনার অনুভূতি পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে হবে। কেন ভালো হয়েছে সেটা বলবেন। প্রতিষ্ঠিত কবিদের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করবেন।
আমি বললাম, তাহলে বলব ভালো হয়নি।
কেন?
তুমি ছন্দ বলে যে একটা ব্যাপার আছে তা-ই জানো না।
আমি লিখি আমার নিজস্ব ছন্দে। ছন্দের পুরনো ধারণায় আমি বিশ্বাসী না।
কবিতার নানান ছন্দ আছে_এই বিষয়টা কি তুমি জানো?
হুঁ।
দু-একটা ছন্দের নাম বলতে পারবে?
এখন মনে পড়ছে না। শুধু অমিত্রাক্ষর ছন্দের নাম মনে আসছে। মাইকেল মধুসূদনের আবিষ্কার।
পয়ার ছন্দ জানো?
না।
আমি বললাম 'চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে
কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।' এটি কোন ছন্দে লেখা বলতে পারবে?
না।
আমি বললাম, ছন্দের নাম 'ললিত'। ললিতের অনেক ভাগ আছে। যেমন_ভঙ্গ ললিত, মিশ্র ললিত, ললিত ত্রিপদী, ললিত চতুষ্পদী, ভঙ্গ ললিত চতুষ্পদী।
আপনি কি প্রমাণ করতে চাইছেন যে আপনি ছন্দবিশেষজ্ঞ?
আমি কিছুই প্রমাণ করতে চাইছি না। একবার আমার ছবির জন্য গান লেখার প্রয়োজন পড়ল। তখনই ছন্দ বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। তোমার প্রতি আমার উপদেশ হলো, ছন্দ বিষয়টা পুরোপুরি জেনে তারপর কবিতা লিখবে।
বরিশালের মহিলা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে চলে গিয়েছিলেন, এই কবি তার বই ফেরত নিয়ে চলে গেল। যাবার আগে অপমানসূচক একটি বাক্য বলে গেল। সেই বাক্যটি বলতে ইচ্ছা করছে না। অভিমানী কবি যা ইচ্ছা বলতে পারেন।
পাদটীকা
happily however, there are also books that talk like men.
-Theodor Haecker.
কিছু মানুষ আছে যারা বইয়ের মতো কথা বলে। আনন্দের বিষয় হচ্ছে, কিছু বই আছে মানুষের মতো কথা বলে।
_থিওডর হেকার।
কুইজ
এভারেস্ট বিজয়ী বাংলাদেশি তরুণ মুসা ইব্রাহীমের বাবার নাম কী?
উত্তর: মো. আনসার আলী।
(মুসা ইব্রাহীম! অভিনন্দন, বাপকা ব্যাটা)।
0 Comments