হুমায়ূন আহমেদের ফাউনটেনপেন ১৪
নামধাম
মানুষের প্রথম পরিচয় তার নাম। দ্বিতীয় পরিচয় কি 'ধাম'? নামধাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয় বলেই এই জিজ্ঞাসা। আমি মনে করি না, নামধাম মানুষের পরিচয়। চুরুলিয়াতে কাজী নজরুল নামের আরেকজন থাকলেই দুই নজরুলের এক পরিচয় হবে না। যদিও তাদের নামধাম এক।
নাম বিষয়ে আজকের লেখা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করি। সুরা বাকারায় আল্লাহপাক বলছেন, "আমি আদমকে প্রতিটি বস্তুর 'নাম' শিখিয়েছি।" এখানে 'নাম' নিশ্চয়ই প্রতীকী অর্থে এসেছে। নাম হলো বস্তুর ঢ়ৎড়ঢ়বৎঃু বা ধর্ম। আল্লাহপাকের অনুগ্রহে আল্লাহপাক যে জ্ঞান আদমকে দিলেন সব ফেরেশতা তা থেকে বঞ্চিত হলো।
আমরা মানব সন্তানরা বস্তুর নাম জানি। আগ্রহ নিয়ে নতুন নতুন নাম দেই। গ্যালাক্সির নাম দিলাম 'এনড্রমিডা'। মঙ্গলগ্রহের দুই চাঁদের একটির নাম দিলাম 'ডিমোস', আরেকটি 'ফিবোস'।
কিছু কিছু নাম আমরা আবার বাতিলও করে দেই। উদাহরণ 'মীরজাফর'। বাংলাদেশের কোনো বাবা-মা ছেলেমেয়ের নাম 'মীরজাফর' রাখবেন না। 'মীরজাফর' এবং 'বিশ্বাসঘাতকতা' আজ সমার্থক। মীরজাফরের চেয়েও বড় বিশ্বাসঘাতক ছিল সিরাজের হত্যাকারী মিরন। তার প্রতি আমাদের তেমন রাগ নেই, যেমন আছে মীরজাফরের প্রতি। মিরন নাম নিষিদ্ধ না, কিন্তু মীরজাফর নিষিদ্ধ। কেন?
কুখ্যাতদের নামে বাবা-মা তাঁদের সন্তানদের নাম রাখেন না, আবার অতি বিখ্যাতদের নামেও রাখেন না। ইংল্যান্ডের বাবা-মারা তাঁদের সন্তানের নাম শেক্সপিয়র রাখেন না। আইনস্টাইন নাম রাখা হয় না। তবে আমেরিকার ফার্গো শহরে আমার এক অধ্যাপকের কুকুরের নাম ছিল আইনস্টাইন। তিনি আইনস্টাইনকে সম্মান দেখানোর জন্য তাঁর প্রিয় কুকুরের এই নাম রেখেছিলেন।
চিন্তায় এবং কর্মে আমেরিকানদের মতো জাতি দ্বিতীয়টি নেই। তাদের দুটো নামের নমুনা দেই (এই দুজন নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ক্লাসের ছাত্র)
গৎ. খড়হম ঋৎড়ম (লম্বা ব্যাঙ)
গৎ. ইৎড়হি ঋড়ী (খয়েরি শিয়াল)
এখন আমার নিজের নামের জটিলতা বিষয়ে বলি। ১৯৭২ সাল। মা গিয়েছেন বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলতে। টাকা তুলতে পারলেন না। কারণ বাবা কোনো এক অদ্ভুত কারণে মাকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের নমিনি করে যাননি। তিনি নমিনি করে গেছেন তাঁর বড় ছেলেকে। কাজেই আমি গেলাম। আমিও টাকা তুলতে পারলাম না। কারণ বাবা তাঁর ছেলের নাম লিখেছেন শামসুর রহমান। আমার নাম হুমায়ূন আহমেদ। আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমার বাবার অনেক অদ্ভুত স্বভাবের একটি হচ্ছে তিনি কিছুদিন পর পর ছেলেমেয়েদের নাম বদলাতেন। শুরুতে আমার নাম ছিল শামসুর রহমান। তিনি আমার নাম বদলে হুমায়ূন আহমেদ রেখেছেন, কিন্তু এই তথ্য প্রভিডেন্ট ফান্ডের কাগজপত্রে দিতে ভুলে গেছেন।
যাকে এত কথা বলা হলো তিনি মুখ গম্ভীর করে বললেন, আপনি প্রমাণ করুন যে, শুরুতে আপনার নাম ছিল শামসুর রহমান।
আমি অতি দ্রুত তা প্রমাণ করলাম। ভদ্রলোকের হাতে এক শ টাকা ধরিয়ে দিলাম। জীবনে প্রথম কাউকে ঘুষ দেওয়া।
আমাদের নবীজি (দ.) সন্তানের নামকরণ বিষয়ে উপদেশ দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা সন্তানদের জন্য সুন্দর সুন্দর নাম রাখবে। যেমন, আসিয়া নামটা রাখবে না। আসিয়া নামের অর্থ দুঃখিনী। দুঃখিনী নাম কেন রাখবে?
আমার বড় চাচির নাম আসিয়া। দুঃখে দুঃখে তাঁর জীবন কেটেছে। শেষজীবনে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
আমরা বাংলাদেশি মুসলমানরা ছেলেমেয়েদের ইসলামী নাম রাখতে আগ্রহী। আল্লাহর নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম। যেমন_আব্দুল কাদের (আল্লাহর দাস), গোলাম রসুল (রসুলের গোলাম)।
আল্লাহর নামের সঙ্গে মিলিয়ে কখনো কোনো মেয়ের নাম কেন রাখা হয় না? আল্লাহপাক তো নারী-পুরুষের ঊধর্ে্ব, তারপরেও তাঁর নাম পুরুষবাচক কেন ভাবা হয়? এই বিষয়ে জ্ঞানীরা কেউ কি আমার প্রশ্নের জবাব দেবেন?
বাংলাদেশের শিক্ষিত এবং ২১ ফেব্রুয়ারির ভাবে উজ্জীবিতরা সন্তানদের জন্য বাংলা নাম খোঁজেন, তবে ডাকনাম। ভালো নাম অবশ্যই ইসলামী।
বাংলা নাম নিয়ে আমি আছি বিপদে। অনেকেরই ভুল ধারণা আছে যে লেখকরা সুন্দর সুন্দর নাম জানেন। আমি কিন্তু জানি না। তাতে রক্ষা নেই, পরিচিতজনদের নাম দেওয়ার জন্য আমাকে প্রস্তুত থাকতে হয়। সিলেটের নাট্যকর্মী আরজুর ছেলে হয়েছে। নামের জন্য দিনে চার-পাঁচবার টেলিফোন। আকিকা আটকে আছে।
আমি বললাম, নাম রাখো 'মানব'।
আরজু বিস্মিত হয়ে বলল, স্যার, সে তো মানবই, অন্য কিছু তো না। তাহলে মানব কেন রাখব?
আমি বললাম, সেটাও একটা কথা। এক মাস সময় দাও নাম ভাবতে থাকি।
না স্যার, খাসি কেনা হয়ে গেছে। আজই নাম রাখা হবে। মানবই রাখা হবে।
হবিগঞ্জের আরেক অভিনেতার নাম সোহেল। তার প্রথম ছেলে হয়েছে। নামের জন্য অস্থির। নাম আমাকেই রাখতে হবে। আমি বললাম, যেহেতু প্রথম সন্তান নাম রাখো প্রথম।
সোহেল বলল, নাম খুবই পছন্দ হয়েছে স্যার। অদ্ভুত।
এক বছর না ঘুরতেই আবারও তার এক ছেলে। তার নাম রাখলাম দ্বিতীয় এবং সোহেলকে বললাম, তৃতীয় ছেলেমেয়ে যাই হয় আমার কাছে নাম চাইবে না। সরাসরি নাম রাখবে তৃতীয়। পরেরজন চতুর্থ, তারপরের জন পঞ্চম... এইভাবে চলবে। ঠিক আছে?
জি স্যার, ঠিক আছে।
সম্প্রতি ছেলের নামের জন্য আমার কাছে এসেছে অভিনেতা মিজান। আমি বললাম, নাম রাখ 'লুব্ধক'।
মিজান মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, লুব্ধক জিনিসটা কী স্যার?
আমি বললাম, আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। ইংরেজিতে বলে ঝরৎরঁং.
মিজান-পুত্র এখন আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কেউ যখন আর্কিটেক্টকে দিয়ে বাড়ি বানায়, তখন বেশ আয়োজন করে বলে তার কী কী প্রয়োজন। যেমন_মাস্টার বেডরুমের সঙ্গে বারান্দা থাকতে হবে। ফ্যামিলি স্পেসে বই রাখার লাইব্রেরি হবে। সার্ভেন্টস টয়লেট আলাদা হবে। ইত্যাদি।
আমার কাছে যারা নাম চাইতে আসে, তারাও বেশ আয়োজন করেই তাদের দাবিগুলো তোলে। যেমন_এক মা তার ছেলের নামের জন্য এসেছে_
স্যার! ছেলের নামের প্রথম অক্ষর হবে আ। কারণ আমার নামের প্রথম অক্ষর 'আ', আতিয়া। শেষ অক্ষর হবে 'ল'। কারণ ছেলের বাবার নামের প্রথম অক্ষর 'ল', লতিফ। নামের অর্থ যদি নদী, আকাশ বা মেঘ হয়, তাহলে খুব ভালো হয়। তার চেয়েও বড় কথা_নামটা হতে হবে আনকমন।
আমি বললাম, ছেলের নাম রাখো আড়িয়াল খাঁ। নদীর নামে নাম। আড়িয়াল খাঁ নামে আমাদের একটা নদী আছে, জানো নিশ্চয়ই?
ছেলের মা গম্ভীর মুখে বললে, আড়িয়াল খাঁ নাম রাখব?
হ্যাঁ, তোমার সব ইচ্ছা এই নামে পূরণ হচ্ছে। নদীর নামে নাম, আনকমন নাম, শুরু হয়েছে তোমার নামের আদ্যক্ষর 'আ' দিয়ে, শেষ হচ্ছে তোমার স্বামীর নামের আদ্যক্ষর দিয়ে।
আমার স্বামীর বংশ খাঁ বংশ না।
তাতে কী? তোমার ছেলে খাঁ বংশের পত্তন করবে। তার থেকেই শুরু হবে খাঁ বংশ।
স্যার। আপনাকে আমার ছেলের নাম রাখতে হবে না। ধন্যবাদ।
তোমাকেও ধন্যবাদ।
শুধু যে ছেলেমেয়েদের নাম তা-না, আমাকে অনেক স্থাপনার নামও রাখতে হয়েছে। কাকলী প্রকাশনীর মালিক সেলিম সাহেব উত্তরায় বিশাল চারতলা বাড়ি তুললেন। আমাকে নাম রাখতে হলো। নাম রাখলাম 'বৃষ্টি বিলাস'।
সেলিম সাহেব বাড়ির সামনে শ্বেতপাথরের ফলকে লিখলেন_ এই বাড়ির নাম রেখেছেন...।
সময় প্রকাশনীর ফরিদ ময়মনসিংহে বাড়ি করবে। বাড়ির নাম আমি ছাড়া কে রাখবে? নাম দিলাম 'ছায়াবীথি'।
নামকরণ চলছেই। এই নামকরণের একটা ভালো দিক হচ্ছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের নামের পরিবর্তন হবে না।
পাদটীকা
ওল্ড ফুলস ক্লাবের সান্ধ্যসভায় কলকাতার এক ভাষাতত্ত্ববিদ উপস্থিত হলেন। আমরা সবাই চেষ্টা করতে লাগলাম জ্ঞানী টাইপ কথা বলার। তেমন কোনো জ্ঞানী কথা খুঁজে না পেয়ে আমি বললাম, আচ্ছা ভাই। আম নামটা কিভাবে এল? আমের বদলে জাম নাম আমরা কেন রাখলাম না?
ভদ্রলোক বললেন, আমের নাম যদি জাম রাখা হতো তাহলে আপনি বলতেন, জাম রাখা হলো কেন? কেন আম রাখা হলো না?
আমি বললাম, অত্যন্ত সত্যি কথা। বাংলা ভাষাভাষী বিশাল ভূখণ্ডে সবাই একসঙ্গে আমকে আম ডাকা শুরু করল কেন? মিটিং করে কি ঠিক করা হয়েছিল এই ফলটার নাম হবে আম? আমি যত দূর জানি অতি প্রাচীনকালে মানবসমাজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। এক দলের সঙ্গে আরেক দলের যোগাযোগই ছিল না। অথচ সবাই একটা ফলের নাম রাখল 'আম'। এক হাজার মাইল লম্বা নদী ব্রহ্মপুত্র। সবাই তাকে ব্রহ্মপুত্রই ডাকছে। কে রেখেছিল আদি নাম?
ভাষাতত্ত্ববিদ হকচকিয়ে গেলেন। আবোল-তাবোল কথা বলা শুরু করলেন। তাঁর জন্য ওই দিনের আসর ছিল শিক্ষাসফর।
কুইজ
আমাদের পাঁচ আঙুলের একটির নাম অনামিকা (রিং ফিঙ্গার) অর্থাৎ নামহীন। এই আঙুলটির নাম নেই কেন?
উত্তর : মহাদেব শিব তাঁর হাতের অনামিকা দিয়ে চারমাথা ব্রহ্মার একটা মাথা ঘাড় থেকে ফেলে দিয়েছিলেন।
এই কাজের পর পর মহাদেব অনুতাপে দগ্ধ হলেন। যে আঙুল দিয়ে তিনি এই কাজটি করেছেন, সেই আঙুলকে তিনি অভিশাপ দিলেন। বললেন, আজ থেকে তুই নাম গ্রহণের যোগ্যতা হারালি। আজ থেকে তুই অনামিকা।
[উৎস : বাংলা শব্দের উৎস অভিধান। ফরহাদ খান।]
0 Comments