গুপ্তধন পাওয়ার মতো ব্যাপার ঘটেছে। আমার হাতে বিশ্বকাপের দুটো টিকিট। বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ডের খেলা মাঠে বসে দেখতে পারব। টিকিট দুটি এমপি হিসেবে শাওনের মা পেয়েছেন। তাঁর হাত থেকে ছিনতাই করে নিয়ে নিয়েছে তাঁর ছোট দুই মেয়ে। শাওন দুই বোনের হাত থেকে গোপনে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে। চোরের ওপর বাটপারি একেই বলে।
আড়াইটার সময় খেলা শুরু হবে, আমরা সাড়ে ১২টার সময় ঘর থেকে বের হলাম। স্টেডিয়ামে ঢুকতে হলে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হবে, নিরাপত্তা চেকিং, আগেভাগে যাওয়াই ভালো।
স্টেডিয়ামে ঢোকার পথের রাস্তায় কোনো যানবাহন চলছে না। শত শত মানুষ হাঁটাহাঁটি করছে। এদের হাতে টিকিট নেই। যেখানে খেলা হবে, তার আশপাশেই থাকতে পারার আনন্দেই তারা অভিভূত।
রাস্তায় প্রচুর তরুণ-তরুণীকে দেখা গেল রংতুলি নিয়ে ঘুরছে। ক্রিকেটপ্রেমীদের মুখে বাংলাদেশ পতাকা আঁকছে। অতি উৎসাহীরা তাদের সারা মুখে হলুদ-কালো আঁকিবুঁকিতে বাঘ সাজছে। শাওন তার গালে বাংলাদেশের পতাকা আঁকাল। আমি তাকে বললাম, আমার বাঘ সাজার শখ! তোমার কি আপত্তি আছে?
শাওন বলল, আপত্তি থাকবে কেন? তোমার যা সাজার ইচ্ছা সাজ।
শেষ মুহূর্তে বাঘ সাজার পরিকল্পনা বাদ দিলাম। বৃদ্ধ বাঘ সেজে মাঠে ঢোকার মানে হয় না। মাঠে ঢুকবে তরুণ বাঘ এবং বাঘিনীরা।
প্রথম পর্যায়ের নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে আমি ধরা খেলাম। পকেটের সিগারেটের প্যাকেট-ম্যাচ ফেলে দিতে হলো। দ্বিতীয় পর্যায়ের নিরাপত্তা চেকিংয়ে শাওন ধরা খেল। তার হ্যান্ডব্যাগে পাওয়া গেল ফেস পাউডারের কৌটা, মেকআপের কিছু জিনিসপত্র ও চিরুনি। সব ফেলে দিতে হবে। শাওন করুণমুখে দেনদরবার করছে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি। দেনদরবারে লাভ হলো না। সব ফেলে দিতে হলো।
স্টেডিয়ামে ঢুকে ধাক্কার মতো খেলাম। সব ছবির মতো সুন্দর। আমি বিদেশি কোনো স্টেডিয়াম দেখিনি, কাজেই তুলনা করতে পারছি না। তুলনা ছাড়াই বলছি, আমাদের এই স্টেডিয়াম দৃষ্টিনন্দন। বড় কোনো হোটেলের ঘরে ঢুকলে প্রথমেই বাথরুম দেখতে ইচ্ছা করে। আমি স্টেডিয়ামের বাথরুমে উঁকি দিলাম, সব ঝকঝক তকতক করছে।
টিকিটে নম্বর দেওয়া ছিল। নম্বর মিলিয়ে বসেছি। আমাদের সামনে (মাঠের ওপাশে) বিশাল টিভি স্ক্রিন। আমি অস্বস্তি নিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে আছি। অস্বস্তির কারণ পুরো মাঠ একসঙ্গে দেখতে পাচ্ছি। আমার অভ্যাস টিভি স্ক্রিনে খেলা দেখা। সেখানে সবকিছুই খণ্ড খণ্ড করে দেখানো হয়। যখন বোলার বল হাতে ছুটে আসেন, তখন শুধু বোলারকে ধরা হয়। বল দেখানো হয় স্লোমোশনে। এখন সব খেলোয়াড়কে একসঙ্গে দেখব, ব্রেইন ব্যাপারটা গুছিয়ে নিতে পারছে না।
টস হয়ে গেছে। বাংলাদেশ টস জিতে ব্যাটিং নিয়েছে। সারা মাঠে আনন্দের ঢেউ (আক্ষরিক অর্থেই ঢেউ), এক প্রান্ত থেকে ঢেউ শুরু হয়ে অন্য প্রান্তে গিয়ে থামে। এর নাম মেক্সিকান ওয়েভ।
দুই দলের খেলোয়াড়েরা সার বেঁধে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন। সবার সামনে বাংলাদেশের একটি করে বালক বা বালিকা। সুন্দর দৃশ্য। শুরু হলো আয়ারল্যান্ডের জাতীয় সংগীত দিয়ে। অনেক দর্শক দেখলাম উঠে দাঁড়ালেন। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। আয়ারল্যান্ড আজ আমাদের শত্রু। শত্রুদের জাতীয় সংগীতে কি উঠে দাঁড়ানো উচিত?
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সময় অদ্ভুত দৃশ্যের অবতারণা হলো। দর্শকেরা সবাই উঠে দাঁড়িয়েছেন। গানের সঙ্গে গলা মিলাচ্ছেন। আমি লক্ষ করলাম, আমার চোখে পানি এসে গেছে।
খেলা শুরু হয়েছে। তামিমের দুর্দান্ত ঝোড়ো ব্যাটিং। আমাদের পেছনে বসা কিছু তরুণের মন্তব্য শুনে মজা পাচ্ছি।
‘তামিম তক্তা বানায়ে দাও।’
‘মুখ বরাবর বল মারো। বদগুলোর মুখ ভোঁতা করে দাও। কত বড় সাহস! বাংলাদেশের সঙ্গে খেলতে আসে।’
‘তামিমের আজ যে অবস্থা সাড়ে তিন শ থেকে চার শ রান উঠবে। আয়ারল্যান্ড আজ মাঠেই হাগামুতা করবে।’
আমি এদের উত্তেজনায় যুক্ত হতে পারছি না, কারণ বল চোখে দেখছি না। বল কোন দিকে যাচ্ছে তাও বুঝতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছে, টিভি পর্দায় খেলা দেখা উচিত ছিল। মাঠে এসে ভুল করেছি।
আমার সামনের সারিতে এক তরুণ ও তরুণীও আমাকে খেলায় মন দিতে দিচ্ছে না। তারা হয় নতুন বিয়ে করেছে কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকা। তারা সারাক্ষণই একে অন্যের ছবি তুলছে। একজন অন্যজনের গায়ে পড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে পায়ের খেলাও খেলছে। পায়ে পায়ে ঠোকাঠুকি। ভুভুজেলা নামক বাদ্যযন্ত্রটি এই স্টেডিয়ামে নিষিদ্ধ, কিন্তু এই যুগল ভুভুজেলার একটি মিনি সংস্করণ জোগাড় করেছে। বস্তুটি বাঁশির মতো না, চারকোনা, ফুঁ দিলেই ভুভুজেলার চেয়েও বিকট শব্দ হয়। এরা ক্ষণে ক্ষণে ভুভুজেলা বাজিয়ে আমাকে চমকাচ্ছে।
আমার পাশে এক ভদ্রলোক বসেছেন। তিনি সারাক্ষণই উচ্চস্বরে মোবাইল ফোনে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে চলেছেন। খেলা কী হচ্ছে বা না হচ্ছে এদিকে তার ভ্রুক্ষেপও নেই।
কে সামছু! আমি তো মাঠে খেলা দেখছি। ফজলু কই? তারে টেলিফোনে পাচ্ছি না। ফজলুকে বল, আমারে যেন কল দেয়। রংমিস্ত্রি পেয়েছ? আচ্ছা আমি পাত্তা লাগাচ্ছি।
খেলা এগোচ্ছে মোবাইলওয়ালা রংমিস্ত্রির অনুসন্ধানে ব্যস্ত আছেন।
খাদক প্রজাতির একজনকে দেখলাম, খেলা শুরু থেকেই তিনি খাবার স্টল থেকে একের পর এক খাবার নিয়ে আসছেন। শেষ হচ্ছে, আবার আনছেন। খাদ্য গ্রহণ চলছেই। আবহসংগীতের মতো মুরগির হাড় চিবানোর শব্দ আসছে।
পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যকে দেখে খুব মায়া লাগল। তাদের ডিউটি পড়েছে বক্সের দর্শকদের দিকে তাকিয়ে থাকার। চমৎকার খেলা হচ্ছে, বেচারারা উপস্থিত থেকেও খেলা দেখতে পারছে না, তাদের তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে উল্লসিত দর্শকদের মুখের দিকে। উল্লাসের কারণ জানার অধিকার তাদের নেই।
উল্লাসে বাধা পড়ল, ইমরুল কায়েস আউট। বাংলাদেশের টিমে ডমিনো এফেক্ট প্রবল। একা কেউ আউট হয় না, দলবল নিয়ে হয়। দেখতে দেখতে চার ব্যাটসম্যান শেষ। সাবিকের আউটে মাঠে নেমে এল কবরের নিস্তব্ধতা।
শেষ ভরসা আশরাফুল। সাত নম্বরে নেমে সে সবাইকে চমকাবে—এই আমাদের বিশ্বাস। মাঠে আশরাফুল ঢোকামাত্র, আমরা হাততালি দিলাম। আমাদের মধ্যে স্বস্তির ভাব ফিরে এল। হায় খোদা! এ তো দেখি পুরোনো আশরাফুল। এক রান করে আউট। ব্যাট নিয়ে প্র্যাকটিস করতে করতে হাসিমুখে মাঠ থেকে বিদায়।
আমার পেছনে বসা তরুণের দল বলল, আশরাফুলকে এমন শাস্তি দেওয়া দরকার, যেন তার সারা জীবন মনে থাকে। একটা লম্বা বাঁশ এনে...।
বাক্যটি লিখলাম না। পাঠকদের কল্পনায় ছেড়ে দিলাম।
আশরাফুল আউট হওয়ার পরপর আমি উঠে দাঁড়ালাম। শাওনকে বললাম, বাংলাদেশের পরাজয় আমি এত মানুষের সঙ্গে দেখব না। আমি চললাম।
শাওনও উঠে দাঁড়াল। দুঃখিত গলায় বলল, মাঠে বসে বাংলাদেশের বিজয় দেখবে বলে তোমাকে মাঠে নিয়ে এসেছি। এমন অবস্থা হবে কে জানত! সরি।
বাংলাদেশের ব্যাটিং বিপর্যয়ের খবর রাস্তায় দাঁড়ানো মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। তাদের হতাশায় ম্রিয়মাণ মুখ দেখে দেখে ফিরছি। আমার হূদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। শাওন বলল, প্লিজ, এত মন খারাপ করবে না। পরের ম্যাচে আমরা অবশ্যই জিতব। এত মানুষের ভালোবাসা কখনো বৃথা যেতে পারে না।
পাদটীকা
একি কাণ্ড! এই খেলায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ জিতেছে। অভিমান করে মাঠ ছেড়ে চলে আসায় আসল খেলাটা দেখা হলো না। আফসোস, আফসোস এবং আফসোস!
2 Comments