ঘর
সেলিনা হোসেন
মুশফিকের সঙ্গে আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়ার দিনটি তাহমিনা মনে রাখে। কেন রাখে সেটা তার নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়। রাখাটা জরুরি তাও মনে করে না। সাত বছর হয়ে গেল। এর পরও কত কিছু যে বোঝার বাইরে থাকে। এভাবেই কখনও নিজের অজান্তে একটি অস্পষ্ট ধারণার মধ্যে হাবুডুবু খাওয়া, যার উত্তর নিজের কাছে থাকে না। কাউকে জিজ্ঞেস করাও যায় না। এমনই জটিলতা আক্রান্ত করে রাখে চারদিক। তাহমিনা এখন তেমন সময়ে আছে।
নিজেকে দেখার জন্য আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। বুঝতে পারে একাকী জীবনের নিঃসঙ্গতা তাকে ক্লান্ত করেছে। আঁচল দিয়ে মুখ মুছে কী যেন করতে চাইল, কিন্তু ভাবতে পারল না কী? শুধু মনে হলো অফিসে যেতে হবে। তৈরি হওয়া দরকার। তৈরি হতে তার সময় লাগে না। যে কোনো রঙের সুতির শাড়ি তার চয়েস, সঙ্গে ম্যাচ করা টিপ। ব্যস হয়ে গেল। চুল ছেঁটে রাখে, আঁচড়ালেই হয়। লম্বা চুল ম্যানেজ করার ঝামেলা নেই। আর কী? পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা বলে হিল জুতা পরতে হয় না। সেখানেও কোনো ঝামেলা নেই। ঝামেলা কোথায়? তাহমিনা এক মুহূর্ত ভাবল। মূল ঝামেলা মুশফিকের সঙ্গে, আর কোথাও ঝামেলা নেই। যে ধরনের ঝামেলা আছে এটা জীবনযাপনের সঙ্গে না থাকলে ঘরগেরস্তি বড় বেশি চাঁচাছোলা হয়ে যায়। তাহমিনা ভেবে দেখল, ওর জীবনের কোথাও কোনা অভাববোধ নেই।
গত সপ্তাহে সুদীপ মেলবোর্নে গেছে। তাহমিনার ছোট বোনের ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করার জন্য বছরখানেক ওর কাছে ছিল। ভারি প্রাণবন্ত, চমৎকার হাসিখুশি ছেলে। ফিজিক্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছে। তবে মেলবোর্নে যাওয়ার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ও সিগারেটে জমে গিয়েছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে টানত। ধোঁয়া, গন্ধে বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল তাহমিনা। চলে যাবে বলে তাকে কিছু বলেনি।
কিন্তু মুশফিকের সিগারেটের নেশা ওর ভীষণ অপছন্দের ছিল। রাতের বেলার অন্তরঙ্গ মুহূর্তে মুখে তামাকের গন্ধ এবং দিনের বেলার খোলামেলা পরিবেশে ধোঁয়া ওর প্রচণ্ড বিরক্তির কারণ ছিল। সিগারেটের টুকরায় বোঝাই হয়ে থাকা অ্যাশট্রে ও অনেক দিনই বাইরে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু ওর বিরক্তিতে মুশফিকের কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। ও মনে করত, এসব গুরুত্ব দিলে নিজের অস্তিত্ব ক্ষুণ্ন হয়। ওর ইচ্ছাকেই তাহমিনার মেনে নিতে হবে; কিন্তু এই মেনে নেওয়াটা কঠিন ছিল তাহমিনার জন্য।
সুতরাং সময়ে-অসময়ে যখন তখন বেধে যেত দু'জনের। খুটখাট লেগে যাওয়া কোনো ব্যাপার ছিল না। কোনো কোনো রাতে বিছানা আলাদা হয়ে গেলে মুশফিক সিগারেট খেয়ে ঘরের মেঝে ভরিয়ে ফেলত ছাই আর টুকরা দিয়ে। তাহমিনার রাগ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য এভাবে উস্কে দিত ওকে। এটা বুঝতে ওর অসুবিধা হতো না। সকালে ঘরে ঢুকেই চেঁচামেচি করত তাহমিনা।
এসব কী করছ?
দেখতেই তো পাচ্ছ, কী করেছি।
ভালো হবে না বলছি।
ভালো তো হবেই না জানি। আমার যা খুশি তা-ই করব।
কাল তুমি বেডরুম পাবে না।
থেকো তুমি বেডরুমে। আমি ড্রইংরুমে যাব।
হ্যাঁ, তা-ই হবে। রাহেলা ঝাড়ূটা নিয়ে আয় তো।
হো-হো করে হাসে মুশফিক।
লজ্জা করে না তোমার?
একটুও না। বরং তোমার রাগ দেখে আনন্দ হয়। মজা পাই।
শয়তান।
শয়তানের বউ।
আবার হো হো হাসি।
তাহমিনা চেঁচিয়ে বলে, মানবজাতির জন্য স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করেছিল প্রমিথিউস। দেবতা জিউসের কাছ থেকে কঠিন শাস্তি ভোগ করল। আর তোমরা পুরুষরা আগুনের ব্যবহার করলে বিড়ি আর সিগারেট খেয়ে।
ও তাই, ভালোই তো বিশ্লেষক হয়েছ। একদম তাত্তি্বক আলোচনা। ভালোই ঝেড়ে দিলে। তো নারী এমন কোন বাহাদুরির কাজ করল শুনি?
নারীই তো আগুনের সঠিক ব্যবহার করেছে। প্রমিথিউসের সার্থক উত্তরাধিকারী নারী। নারী আগুনের সঠিক ব্যবহার করে পুরুষকে ভাত দিয়েছিল বলেই তো সভ্যতা টিকে গেছে। বুঝলে?
বুঝলাম।
মুশফিক চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকে। ওর চোখে আগুন। তাহমিনা সে আগুনে পোড়ে না, প্রীত হয়।
হাসতে হাসতে বলে, আজ চুলোয় আগুন জ্বালব না। পরিজ বানাতে পারব না। ডিম পোজও না। দেখি কী করো।
সেদিন মুশফিকের নাশতা হয় না। এক কাপ চাও না।
তাহমিনা নিজের কাজে বেরিয়ে যায়। দু'জনই না খেয়ে বের হয় এবং দু'জনই অফিসে গিয়ে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমার কি খিদে পেয়েছে? একদিন মুশফিক এক প্যাকেট সিগারেট চমৎকার কাগজে মুড়ে ওকে উপহার দিয়েছিল। ভেতরে ছোট একটা কাগজে লেখা ছিল_ একটা টেনে দেখো না। দেখবে?
ছোট কাগজের টুকরাটিকে ওর সামনে দিয়াশলাই জ্বেলে আগুন ধরালে মুশফিক হাসতে হাসতে বলেছিল, আগুনের অপব্যবহার করলে কিন্তু! তুমি না প্রমিথিউসের যোগ্য উত্তরসূরি?
সেদিন তাহমিনা ওই আগুন থেকে একটি একটি করে সিগারেট পুড়িয়ে শেষ করে বলেছিল, আগুনের সবচেয়ে ভালো ব্যবহার করলাম।
মুশফিক বারান্দায় গিয়ে চুপ করে বসে ছিল। সিগারেটের ছাই এবং টুকরায় নোংরা করেছিল বারান্দা। রাতে ভাত খায়নি এবং বেডরুমে ঘুমুতেও আসেনি। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিল তাহমিনা নিজেও।
বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে তাহমিনার মনে হয় বিষয়টি একটু বেশি হয়ে যাচ্ছিল? নাকি নিজেকে আরেকটু সরিয়ে রাখলে হতো? তাহলে মুশফিকই বা নিজেকে সরাল না কেন? এ প্রশ্নের উত্তর নেই বলেই তো দু'জনের আজ এই দূরত্বে অবস্থান। অথচ ডিভোর্সও নেয়নি কেউ।
ছোট বোনের স্বামী চট্টগ্রামে বদলি হয়ে গেলে সুদীপ ওর কাছে থাকতে এসেছিল। মাস ছয়েক থেকেছিল ভাইয়ের মেয়ে নিমা। নিমাও স্বামীর সঙ্গে লন্ডনে চলে গেছে। এখন ওর কাছে নিজের কেউ নেই।
দু'দিন আগে ফোন করেছিল মুশফিক। বিভিন্ন জনের কাছে শুনেছে, মুশফিকের সিগারেট খাওয়া বেড়েছে। এখন ও চেইন স্মোকার। ফোনে তাহমিনাকে বলেছিল, জীবনকে নতুন করে দেখার জন্য সিগারেট ছেড়ে দেব কি-না ভাবছি।
হঠাৎ এমন ভাবনা?
কারণ, আমি তো তোমাকেই চাই। অন্য কোনো নারীকে আমার জীবনে ঢোকাতে পারব না।
তাহমিনা হাসতে হাসতে বলেছিল, বেশ রোমান্টিক নায়কের মতো কথা বলছ!
হালকাভাবে নিও না তাহমিনা। আমার ধারণা, তুমিও আমার জন্যই অপেক্ষায় আছ।
তাহলে আমরা কি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বোঝার জন্য জীবন নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করলাম?
হ্যাঁ হ্যাঁ, তা-ই। এটারও দরকার ছিল। আমার তো মনে হয়েছে জীবনের এই আলাদা বাসের সময়টুকু আমাদের দারুণ জার্নি। আমি এনজয় করেছি। এখনও করছি। তুমি?
তাহমিনা এক মিনিট নীরব থেকে বলেছিল, জানি না।
জানো না? এটা হতেই পারে না। এমন তাত্তি্বক মানুষ তুমি, কত তত্ত্বকথা তোমার মাথায় গজগজ করে।
কী বললে? তাহমিনার রাগত স্বর শুনে লাইন কেটে দিয়েছিল মুশফিক।
বাথরুমে ঠাণ্ডা পানি গায়ে ঢাললে শরীর জুড়িয়ে যায়। ভাবে, মুশফিককে ওর বলা উচিত ছিল যে, এই একা থাকার সময় ও নিজেও খুব এনজয় করেছে। বলল না কেন? নিজেকে প্রশ্ন করলে শরীরে আর পানি ঢালা হয় না। তাহলে কি ও মনে করেছে উপভোগের আনন্দের সময় মুশফিক না থাকায় অভাব ছিল আনন্দে? না, তা নয়। ও নিজেও তো নিজের মতো করে সময় উপভোগ করেছে। আসলে কারও জন্য কারও সময়ের অপেক্ষা কম থাকে_ এটাই মনে হয় তাহমিনার। মৃত্যু একটি প্রবল শূন্যতা সৃষ্টি করে। সেটা একটা স্থায়ী শূন্যতা। এর সঙ্গে অন্যের দূরত্বের বিচ্ছেদ এক হয় না। সুতরাং মুশফিক কাছে না থাকায় ওর জীবনে বড় ধরনের ভেদ তৈরি হয়নি। সিদ্ধান্তে আসতে পেরে আনন্দের সীমা নেই বলে ও অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে ভেজাতে থাকে।
অফিসে বের হওয়ার মুখে ফোন করে মুশফিক।
মিনু, অফিসে যাচ্ছ?
হ্যাঁ। ফোন করেছ ক্যান?
এমনি। মনে হলো তোমাকে বলি যে সকাল থেকে একটাও সিগারেট খাইনি।
আমাদের সম্পর্কে সিগারেটটা উপলক্ষ মাত্র। প্রধান বিষয় না।
তাহলে কী?
কী সেটা, তোমাকে অনেকবার বলেছি।
আবার বলো।
বিষয়টা হলো তোমার মনোভঙ্গি। তুমি আমার সঙ্গে ব্যাটাগিরি দেখাও। এটা মানা আমার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। তুমি আমার মাস্টার নও। হতে চাওয়াও ভুল।
বুঝেছি।
তাহলে এমন আচরণ করো কেন?
ঘর। ঘরই আমাকে অন্য মানুষ করে দেয়।
মানে?
যখন আমি ঘরে ঢুকি। দু'জনের সংসার দেখি। তোমাকে আমার হাতের কাছে পাই তখনই আমার মধ্যে কে যেন ঢোকে। ওই আমি প্রভুত্ব করে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে ওপর থেকে দেখতে বলে দেয়।
হো-হো করে হাসে তাহমিনা।
হেসো না মিনু। এটা মোটেই হাসির কথা নয়।
তুমি এখন কী চাও?
তোমাকে।
তাহমিনা আবার হাসে।
এই যে এত বছর ধরে আমি একটু একটু করে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে বিষয়টি বুছেছি তার কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে?
অবশ্যই আছে।
তাহলে?
আমার অফিসের গাড়ি এসে গেছে। যাচ্ছি।
তাহমিনা ফোন রেখে দেয়। দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভাবে, ঘর এবং নারী পেলেই পুরুষের প্রভুত্ব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কখনও কখনও নারীরও। তাহলে ঘর কি একটি ভীষণ জটিল জায়গা! হবে হয়তো। ভেবে দেখার সুযোগ হয়নি। গাড়ি চলতে শুরু করলে শিপ্রার কথা মনে হয়। এসব নিয়ে শিপ্রার ভাবনা অনেক এগোনো। ও বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখে।
একদিন শিপ্রাকে জিজ্ঞেস করেছিল, সারাক্ষণ এত রূপচর্চা কেন শিপ্রা? এমন ঘটা করে নিজেকে পণ্য বানোনোর চেষ্টা কেন?
ও দু'হাত মেলে বলে, নারীর রূপচর্চা তো অর্থনীতির থিয়োরি।
মানে? ঠিক করে বলো।
বিষয়টি সোজা। নারী-পুরুষের সম্পর্ক একটি বাজার সম্পর্ক। নারী কুৎসিত পুরুষের কাছে নিজের সৌন্দর্য বিক্রি করে। নারী যখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে তখন ঘরের প্রয়োজন হবে না। বিয়েকে জীবিকা নির্বাহের উপায় ভাববে না। তাকিয়ে দেখ জাপানের দিকে। ওখানে বিয়ের হার কমেছে। কারণ ওরা অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল নয়।
তাহমিনা হাসতে হাসতে বলেছিল, তাহলে মানবজাতির কী হবে? মানুষ কি বিলুপ্ত প্রাণী হবে? সেটা পুরুষরাই বুঝবে। নারীর ওপর কত ষোলআনা চালাতে হবে সেটা বোঝে, আর এটা বুঝবে না?
তাহমিনার মনে হয় শিপ্রার হা-হা হাসি এখনও ওর কানে লেগে আছে। সেটা এখন ঢোলের মতো শব্দ করে বাজছে। সেদিন হাসতে হাসতে শিপ্রা আরও বলেছিল, পুরুষ নিজের মনের দিকে তাকিয়ে আকাল ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না। বুঝলে?
তাহমিনা মৃদু হেসে মাথা নেড়েছিল।
গাড়ি এসে অফিসে থামলে তাহমিনা দেখতে পায় মাহবুব দাঁড়িয়ে আছে। মাস ছয়েক আগে ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। একটি বাচ্চা আছে।
কেমন আছেন?
এই তো।
তাহমিনা পাশ কাটিয়ে যেতে চায়। মাহবুব সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে। দু'জনে এক অফিসে চাকরি করে।
ভদ্রতার খাতিরে তাহমিনা জিজ্ঞেস করে, আপনার মেয়ে কেমন আছে?
ও তো ওর মায়ের সঙ্গে থাকে।
খোঁজ নেন না?
নেব না কেন, অবশ্যই নেই। মাসে মাসে ওর খরচ দেই। বাবার দায়িত্ব পালন করতে ভুলি না।
শুধু দায়িত্ব?
আমি তো একা থাকি। নইলে ওকে আমার কাছেই রাখতাম।
ও আচ্ছা।
এদিক থেকে আপনারা বেশ আছেন।
হ্যাঁ, আমাদের বাচ্চা নেই।
নতুন করে কিছু ভাববেন না?
তাহমিনা এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে লিফট আসে। দু'জনে লিফটে ওঠে। আর কেউ নেই। মাহবুব অনুরাগের দৃষ্টি মেলে বলে, আমরা কি কিছু একটা ভাবতে পারি?
মানে?
ঘর করা।
লিফট পাঁচতলায় থামে। তাহমিনা নামতে নামতে বলে, মুশফিকের জন্যই আমার সবটুকু ভালোবাসা জমা আছে। আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়নি। আমরা সম্পর্কের সিজফায়ারে আছি।
মানে?
বুঝবেন না। আর কোনোদিন এমন আচরণ করলে_
তাহমিনা বাক্য শেষ করে না। নিজের ঘরে গিয়ে ঢোকে। ও এসব আচরণ উপেক্ষা করতে পারে। দেখা তো কম হয়নি। বয়সও কম হয়নি। কাগজপত্র ওল্টাতে শিপ্রার কথাগুলো ওর বুকের ভেতর তোলপাড় করতে থাকে।
অনেক রাতে ফোন করে মুশফিক।
ঘুম ভাঙালে কেন? ইদানীং তুমি ঘনঘন ফোন করছ।
তোমার ঘুম ভাঙা কণ্ঠস্বর শুনতে আমর ভালো লাগছে।
তুমি বাড়াবাড়ি করছ মুশফি।
আহ, কতদিন পর তোমার মুখ থেকে মুশফি শুনলাম।
তুমি আমাকে কী নামে যেন ডাকতে?
তাথৈ
তাহমিনা চুপ করে থাকে।
কথা বলছ না কেন তাথৈ? আমাদের সময় ফুরিয়েছে। আর অপেক্ষা নয়। আমি অনেক কিছু বুঝেছি তাথৈ। সম্পর্কের জটিলতাকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছি।
ঘরকে ঘরের মতো বুঝবে তো? ঘরটা দু'জনেরই সমান।
হ্যাঁ, সেটাই তো এত বছর ধরে অনুভব করলাম। আর পারছি না তাথৈ।
আচ্ছা ভেবে দেখি।
তাহমিনা ফোন রেখে দেয়। ঘুমুতে পারে না। কিছুক্ষণ পায়চারি করে। চা বানায়। চা নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে। দু'জনের যখন আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত হয় তখন মুশফিক শুধু কাপড় দিয়ে চলে গিয়েছিল। বলেছিল, আবার যদি ফিরি সংসারটা এমনই চাই। দেয়ালে কাইয়ুম চৌধুরীর পেইন্টিংটা আমি অনেক পছন্দ করে কিনেছি।
তুমি একা কেননি। দু'জনে মিলে কিনেছি।
তাহমিনার আপত্তি উপেক্ষা করে ও বলে, যা রেখে যাচ্ছি তার সবটুকুই আমার জন্য থাকবে। অসম্ভব। আবার তোমার প্রভুত্বের কথা ফলাচ্ছ। যদি ফিরে এসো যা রেখে যাচ্ছ তা চাইছ কেন? আমি তো কিছু জিনিস বাড়াতে পারি। নিজের পছন্দমতো ফার্নিচারগুলো অন্যভাবে রাখতে পারি। পর্দা বদলাতে পারি। দু'জনে মিলে কুশন কিনেছিলাম সেগুলো বদলাতে পারি। সবচেয়ে বড় কথা কাইয়ুম চৌধুরীর পেইন্টিংটি যে দু'জনের টাকায় কিনেছি সেখান থেকেও তুমি আমাকে খারিজ করে দিচ্ছ। নিজেকে বড় বেশি চেনো।
তোমার এত কথা আমি শুনতে পারব না।
ভালোই তো শুনো না। যাও। কে শুনতে বলে?
চলে গিয়েছিল মুশফিক। পেছন ফিরে তাকায়নি। যাচ্ছি বলেনি। দরজাটা হালকা শব্দে টেনে দিয়েছিল মাত্র। তারপর কতদিন কেটেছে তার হিসাব নেই। দু'জনে কেউ কারও খোঁজ রাখেনি।
এসব ভাবছে কেন ভেবে তাহমিনা নিজের ওপর বিরক্ত হয়। ইদানীং মুশফিক ফোন করছে, গভীর রাতও বিবেচনা করছে না, এটাই ভেবে দেখার বিষয়। ঘনঘন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নিজেকে সামলায় তাহমিনা। চা শেষ হলে টেলিভিশন ছাড়ে। একটি ইংরেজি সিনেমা চলছে। মন বসাতে পারে না তাহমিনা। জানালায় এসে দাঁড়ায়। চারতলার ওপর থেকে দেখা যায় নিচের রাস্তাটি ভীষণ একাকী। দু-একটা গাড়ি যাচ্ছে মাত্র। বড় গাছটার ছায়া পড়ে আছে মাটিতে। ও ভাবল, আজকের রাতটি কি অন্যরকম? দরজায় টুকটাক শব্দ হয়। তাহমিনা কান খাড়া করে। আবার শব্দ।
কে?
তাথৈ আমি। দরজা খোল।
মুশফিকের কণ্ঠ খানিকটা উচ্চকিত হয়।
আমি একদম খালি হাতে এসেছি তাথৈ।
তাহমিনা দরজা খোলে। মুশফিক দরজার ওপর হাত রেখে বলে, দেখো আমার সঙ্গে কিচ্ছু নেই।
এসো
মুশফিক ঘরে ঢোকে।