Ticker

6/recent/ticker-posts

উপন্যাস ভুল ভোর - আনিসুল হক


” এক ছিল ব্যাঙ্গমা।
আরেক ছিল ব্যাঙ্গমি। একটা আমগাছের ডালে ছিল তাদের বাস। একদিন তারা দু’জনে কথা বলছিল।
ওই আমগাছটা কোথায় ছিল?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোথায়?
পূর্ব পাকিস্তানে।”
---------খ্যাতনামা লেখক, সাংবাদিক আনিসুল হক তার ”ভুল ভোর” উপন্যাসের ১ম পর্বের শুরুটা এভাবে করেছেন।

এ উপন্যাসে ত্রিকালদর্শী এক ব্যাঙ্গমা আর এক ব্যাঙ্গমির কথোপথনের মধ্য দিয়ে একদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং তাজউদ্দিন আহমেদ এর শৈশব থেকে শুরু করে স্কুল জীবন, কলেজ জীবন, বিয়ে, তাদের রাজনৈতিক জীবন ইত্যাদি এবং অপরদিকে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার আন্দোলন, মুসলীম লীগের রাজনীতি, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতি, ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ৭৫ মিলিয়ন লোকের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন।

এ উপন্যাসে মূলত: ১৯৪৩ সালের পঞ্চাশের মন্বন্তর থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট পর্যন্ত রাজনীতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। সাথে সাথে চমৎকারভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং তাজউদ্দিন আহমেদ এর চারিত্রিক বৈশিষ্টের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন।
উপন্যাসের শুরুতে তিনি শেখ মুজবুর রহমান সম্পর্কে বলেছেন যে, তিনি কখনোই পূর্ব পাকিস্তান শব্দটি উচ্চারন করতেন না, ১৯৪৭ সালের পরেও তিনি জন্মভূমিকে ডাকতেন "পূর্ব বাংলা" বলে আর বিশ শতকের ষাটের দশকের শেষের দিকে তিনি এর নাম দিয়েছিলেন "বাংলাদেশ"।

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমির বাসস্থানের বর্ননা করতে গিয়ে তিনি প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনের খোলা চত্বরে যে আমগাছটা ছিল, যে আমগাছের ছায়াতলে সমবেত হয়ে ১৯৫২ সালে ঢাকার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবীতে সরকারের নিষেধ উপেক্ষা করে মিছিল শুরু করেছিল, সেই আমগাছের উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীতে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের চত্বরে অবস্থিত বটগাছের কথা বলেছেন, যার ছায়াতলে ষাটের দশকের শেষের দিকে তীব্র গণ-আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যেখানে আন্দোলনের দিনগুলোয় ছাত্র-সভাসমাবেশ হতো। সবশেষে, রমনা পার্কের অশ্বত্থগাছের কথা বলেছেন যেখানে ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালীদের বাঁধা দিতে লাগল রবীন্দ্রসংগীত গাইতে আর রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে। তখন এই অশ্বত্থতলে সমবেত হতো বাঙালীরা প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে, বাংলা নববর্ষ পালনের উদ্দেশ্যে।

উপন্যাসের দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুতে জনাব তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রশ্ন করা হয়েছিল,
”আপনি কাকে বেশী ভালবাসেন? বঙ্গবন্ধুকে না বাংলাদেশকে?”

প্রশ্নটি করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন তার গনসংযোগ কর্মকর্তা আলী তারেক। জবাবে তাজউদ্দিন দ্বিধাহীন কন্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, ’আমি বঙ্গবন্ধুকে বেশী ভালবাসি’। কারন তাজউদ্দিন জানতেন, গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, বাংলা, বাংলাদেশ আর বাঙালীর প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ভালবাসার কোন তল ছিল না। কোন খাদ ছিল না। মুজিব সারাটা জীবন ধরে একটা জিনিসই চেয়েছেন, তা হলো বাঙালির মুক্তি। কাজেই মুজিবকে ভালবাসার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশকে ভালবাসা চরিতার্থ হয়ে যায়। খুবই দৃঢ়চেতা, সাহসী আর পরিশ্রমী শেখ মুজিব সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাজউদ্দিন আহমেদ একাত্তরের যুদ্ধের সময় জয়বাংলা পত্রিকায় ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে বলেছিলেন,

” সেই চুয়াল্লিশ সাল থাইকা পরিচয়, আমি মুজিব ভাইরে কোনো দিন হারতে দেখি নাই। এইবারও ওনার জয় হইব”।

উপন্যাসের চতুর্থ অধ্যায়ে আনিসুল হক শেখ মুজবর রহমান এবং তার স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছার শৈশবকালের নিখাদ বর্ননা দিয়েছেন। শৈশবে শেখ মুজিবকে খোকা এবং ফজিলাতুন্নেছাকে রেনু নামে ডাকা হতো। রেনুর বয়স যখন ৩ বছর তখন তার বাবা মারা যান এবং ৫ বছর বয়সে মা ও মারা যান। রেনু এবং খোকার বিয়ে হয় সেই শিশুকালেই। বিয়ের মর্ম কি তা তারা বুঝে না। তাহলে কেন এ বিয়ে? পড়েই দেখুন না, জানতে পারবেন।

শেখ মুজিবর রহমান ৪র্থ শ্রেনীতে পড়ার সময়েই হামিদ মাষ্টরের কাছে শুনতেন মাষ্টার দা সূর্যসেনের গল্প, তিতুমীরের গল্প আর ক্ষুদিরামের গল্প। আরো জানলেন, দেশের জন্য কেউ হাতকড়া পড়লে, দেশমাতা তাকে গলায় ফুলের মালা পড়াবেন। দেশের জন্য জেলে যাওয়া গৌরবের ব্যাপার। বালক শেখ মুজিবের চোখে জল আসে। তার মনে হয়, সেও যদি যোগ দিতে পারত বিপ্লবীদের দলে, এমনি করে দেশমাতার জন্যে যদি সেও ফাসিঁতে ঝুলতে পারত। আস্তে আস্তে তার রক্তেও বাজে-
” ভারতবর্ষ স্বাধীন করতে হবে, ইংরেজ তাড়াতে হবে”।

এদিকে তাজউদ্দিনও স্কুলের ছাত্র অবস্থাতেই রাজনীতিতে ঢুকে পড়েন। কিন্তু তাই বলে পড়ালেখা ছেড়ে দেন নি। ম্যাট্রিকুলেশনে প্রথম বিভাগে মেধাতালিকায় স্থান করে নেন। কলেজে ভর্তি হয়ে তিনি পুরোপুরি রাজনীতিতে নেমে পড়েন। দ্বায়িত্ব দেয়া হয় ঢাকার উত্তর মহকুমার মুসলীম লীগ গড়ার। তিনি সেই দ্বায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেছেন।

উপন্যাসের শেষ অংশে শেখ মুজিব এবং তাজউদ্দিন এর রাজনীতিই তুলে ধরেছেন। যেমন: মুসলিম লীগের সম্মেলন, মুসলিম লীগের পালামেন্টারী বোর্ড গঠন, কেন্দ্রীয় আইনসভা নির্বাচন, বঙ্গীয় আইনসভা নির্বাচন ইত্যাদি।

তারা চেয়েছিলেন, অখন্ড স্বাধীন বাংলা হবে।
কিন্তু হলো ভারত ও পাকিস্তান। কিভাবে ?? পড়েই দেখুন না।

নিচের ডাউনলোড অপশনে ক্লিক করে বইটি সংগ্রহে রাখুন।
সংক্ষিপ্ত লেখক জীবনীঃ
আনিসুল হকের জন্ম ১৯৬৫ সালের ৪ মার্চ রংপুরের নীলফামারীতে। পিতা মোঃ মোফাজ্জল হক, মাতা মোসাম্মৎ আনোয়ারা বেগম।
তিনি রংপুর জিলা স্কুল থেকে ১৯৮১ সালে এস.এস.সি. এবং রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে ১৯৮৩ সালে এইচ.এস.সি. পাস করেন। উভয় পরীক্ষাতেই সম্মিলিত মেধাতালিকায় স্থান পান। এরপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের(বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করেন।
তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকারের রেলওয়ে বিভাগে যোগদান করেন। অল্প কিছুদিন চাকরির পরই তা ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতায় চলে আসেন। তিনি ১৯৮৭ সালে সাপ্তাহিক দেশবন্ধু পত্রিকার সহসম্পাদক, ১৯৮৯ সালে সাপ্তাহিক পূর্বাভাস পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক, ১৯৯১ সালে সাপ্তাহিক খবরের কাগজের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হন। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত দৈনিক ভোরের কাগজের সহকারী সম্পাদক দায়িত্ব পালন করেন। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত দৈনিক প্রথম আলোর সাথে যুক্ত আছেন। তাঁর মূল ঝোঁক লেখালেখিতে। পত্রিকায় তিনি নিয়মিত কলাম লেখেন।বুয়েটে পড়ার সময় কবিতার দিকে বেশি ঝোঁক ছিল। পরবর্তীতে এর পাশাপাশি কথাসাহিত্যেও মনোযোগী হন। উপন্যাস, বিদ্রুপ রচনা, নাটক রচনায় প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন।

শ্রেষ্ঠ টিভি নাট্যকার হিসেবে পুরস্কার, টেনাশিনাস পদকসহ বেশ কয়েকটা পুরস্কার পেয়েছেন। সাহিত্যের জন্য পেয়েছেন খুলনা রাইটার্স ক্লাব পদক, কবি মোজাম্মেল হক ফাউন্ডেশন পুরস্কার।