বইটি ডাউনলোড করতে হলে নিচের ডাউনলোড অপশনে ক্লিক করুন
রংপেন্সিলঈর্ষা ও ভালোবাসা
হুমায়ূন আহমেদ
পবিত্র কোরআন শরিফের একটি আয়াতে আল্লাহপাক বলছেন, 'এবং বেহেশতে তোমরা প্রবেশ করবে ঈর্ষামুক্ত অবস্থায়।'
এর সরল অর্থ_শুধু বেহেশতেই মানুষ ঈর্ষামুক্ত, ধুলা-কাদার পৃথিবীতে নয়। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, ঈর্ষা এক অর্থে আমাদের চালিকাশক্তি। মানবসভ্যতার বিকাশের জন্য ঈর্ষার প্রয়োজন আছে। বেহেশতে যেহেতু সভ্যতা বিকাশের কিছু নেই, ঈর্ষারও প্রয়োজন নেই।
আমি নিজেকে ঈর্ষামুক্ত একজন মানুষ ভাবতে পছন্দ করি; যদিও জানি, এই মানবিক দুর্বলতামুক্ত হওয়া মহাপুরুষদের পক্ষেও সম্ভব নয়। একজন মহাপুরুষও ঈর্ষা করবেন আরেকজন মহাপুরুষকে। এটাই নিপাতনে সিদ্ধ।
যা-ই হোক, এক শ্রাবণ মাসের মেঘলা দুপুরে কলকাতার দেশ পত্রিকা খুলে হিংসা নামের সর্পের ছোবল অনুভব করলাম। পত্রিকায় একটি উপন্যাসের সমালোচনা ছাপা হয়েছে। সমালোচক বলছেন, এই উপন্যাসের লেখক বিভূতিভূষণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি। উপন্যাসটির নাম 'নূরজাহান'। লেখকের নাম
ইমদাদুল হক মিলন। দেশ পত্রিকায় এমন নির্ভেজাল প্রশংসা আমি আর কোনো লেখার হতে দেখিনি।
নূরজাহানের গল্প শেষ করতে মিলন প্রায় তেরো শ পৃষ্ঠা লিখেছেন। বাংলাদেশে এটিই মনে হয় সর্ববৃহৎ উপন্যাস। লেখক হিসেবে জানি একটি গল্পকে তেরো শ পৃষ্ঠা পর্যন্ত টানার অর্থ দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনীর পরিশ্রম, রাত্রি জাগরণ, ক্লান্তি ও হতাশা। হতাশার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি, যেকোনো রচনাতেই লেখকের নানান হতাশা থাকে। গল্পটা যেমন দাঁড় করানো দরকার সে রকম করা গেল না। বিশেষ কোনো চরিত্র আরো স্পষ্ট হওয়া উচিত, তা হলো না, এইসব।
হতাশার সঙ্গে আসে আনন্দ। গল্প শেষ করার আনন্দ। নিজের কথা বলি, মিসির আলি বিষয়ক মাত্র চলি্লশ পৃষ্ঠার একটি বড় গল্প (বৃহল্ললা) শেষ করে আমি গল্প শেষ হওয়ার আনন্দে অভিভূত হয়েছিলাম। নূরজাহান শেষ করে মিলনের আনন্দ নিশ্চয়ই আমার চেয়ে চৌত্রিশ গুণ বেশি হয়েছে। নূরজাহান বৃহল্ললার চেয়ে চৌত্রিশ গুণ বড়। সব লেখকই চান তাঁর নিজের আনন্দের ছায়া পাঠকের মধ্যে পড়ুক। লেখক যেন বুঝতে পারেন তাঁর কষ্ট জলে ভেসে চলে যায়নি।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও বাংলাদেশে মিলনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কেন জানি ঘটছে না। উদাহরণ দিয়ে স্পষ্ট করি। এখন দৈনিক পত্রিকাগুলোর ফ্যাশন হলো সাহিত্য বিচারকের ভূমিকায় অভিনয় করা। এরা বর্ষসেরা উপন্যাস, মননশীল লেখার তালিকা তৈরি করে এবং পাঠকদের ভাবতে বাধ্য করে, এসব রচনাই শ্রেষ্ঠ, বাকি সব আবর্জনা।
কালের কণ্ঠ দশটি সেরা উপন্যাসের তালিকা তৈরি করল, মিলনের নূরজাহান সে তালিকায় নেই। আমি ভাবলাম, মিলন এই পত্রিকায় কাজ করে বলেই হয়তো তার নাম নেই। লোকে না ভেবে বসে তারা নেপোটিজম করছে।
প্রথম আলোর সেরা দশেও মিলন নেই। এতে মিলনের মন খারাপ হয়েছে কি না জানি না, আমি বিরক্ত হয়েছি। মিলনকে ডেকে বলেছি, দৈনিক পত্রিকার সেরা দশের পুরো আয়োজনই ভুয়া। এই সেরা কারা নির্বাচন করেন? তাঁরা কি বছরে প্রকাশিত সব লেখা পড়েন?
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র একসময় বই নামে পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করত (হয়তো এখনো করে), সেখানে প্রকাশিত বইগুলোর পরিচিতি ছাপা হতো। দায়িত্বে ছিলেন এক বিদগ্ধ সমালোচক। একদিন অবাক হয়ে দেখি, আমার গল্পগ্রন্থ 'আনন্দ বেদনার কাব্য' নিয়ে লেখা হয়েছে_হুমায়ূন আহমেদের কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো সুন্দর। কিছু কবিতায় ছন্দের ত্রুটি দেখা গেলেও রূপক নির্মাণে কবির দক্ষতা আছে।
আমি মিলনের নূরজাহান প্রখম খণ্ড অনেক আগেই পড়েছিলাম। কালের কণ্ঠ ও প্রথম আলোর ভূমিকায় ব্যথিত হয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড পড়ে শেষ করলাম। অবশ্যই এই গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। আমি হলে বইটি তিন শ পৃষ্ঠাতে সীমাবদ্ধ রাখতাম। নূরজাহানের প্রধান ত্রুটি, এর লেখক 'কড়ি দিয়ে কিনলামের' বিমল মিত্র হতে চেয়েছেন। যেন সবাই বলে, এই দেশের সবচেয়ে বড় উপন্যাস ইমদাদুল হক মিলন লিখেছেন। বৃহৎ উপন্যাস রচিত হবে_এটি কোনো লেখার চালিকাশক্তি হতে পারে না।
কবি ড ই ণবধঃং তাঁর ছেলেকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, লেখকদের জন্য আলাদা নরক যদি থাকে, সেখানে থাকবে তাঁদের শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো। যেসব ভুল এই লেখাগুলোতে করা হয়েছে, তা লাল কালিতে চিহ্নিত থাকবে। বাহুল্য দাগানো থাকবে। যা বাদ পড়েছে তাও উল্লেখ করা হবে। লেখক তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনাগুলোর ত্রুটি দেখে নরকযন্ত্রণায় অনন্তকাল দগ্ধ হবেন।
কবি ণবধঃং-এর কথা ধরে বলি, বিভূতিভূষণের নরকে থাকবে পথের পাঁচালি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নরকে থাকবে পুতুল নাচের ইতিকথা এবং ইমদাদুল হক মিলনের নরকে নূরজাহান। এই অর্জনই বা কম কী! ইমদাদুল হক মিলনকে অভিনন্দন!
পাদটীকা-১
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ আমাকে এবং মিলনকে একটি বই উৎসর্গ করেছিলেন। বইটির নাম 'সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে'। ঔপন্যাসিক হিসেবে আমরা দুজনই নষ্ট_এমন সূক্ষ্ম ইঙ্গিত। আমি বিষয়টায় মজা পেয়ে হাসলাম। মিলন প্রতিশোধের বাসনায় হুমায়ুন আজাদকে একটি বই উৎসর্গ করল। বইটির নাম 'বনমানুষ'।
অধ্যাপক আজাদ এ ঘটনায় যথেষ্টই বিরক্ত হয়েছিলেন।
পাদটীকা-২
ইমদাদুল হক মিলনের মতো ধৈর্য আমার নেই। কাজেই তেরো শ পৃষ্ঠার রং পেন্সিল লিখতে পারছি না। এই পর্বেই ইতি টানছি। পাঠকদের সঙ্গে আবারও কোনো এক প্রসঙ্গে দেখা হবে। বিদায়।
এর সরল অর্থ_শুধু বেহেশতেই মানুষ ঈর্ষামুক্ত, ধুলা-কাদার পৃথিবীতে নয়। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, ঈর্ষা এক অর্থে আমাদের চালিকাশক্তি। মানবসভ্যতার বিকাশের জন্য ঈর্ষার প্রয়োজন আছে। বেহেশতে যেহেতু সভ্যতা বিকাশের কিছু নেই, ঈর্ষারও প্রয়োজন নেই।
আমি নিজেকে ঈর্ষামুক্ত একজন মানুষ ভাবতে পছন্দ করি; যদিও জানি, এই মানবিক দুর্বলতামুক্ত হওয়া মহাপুরুষদের পক্ষেও সম্ভব নয়। একজন মহাপুরুষও ঈর্ষা করবেন আরেকজন মহাপুরুষকে। এটাই নিপাতনে সিদ্ধ।
যা-ই হোক, এক শ্রাবণ মাসের মেঘলা দুপুরে কলকাতার দেশ পত্রিকা খুলে হিংসা নামের সর্পের ছোবল অনুভব করলাম। পত্রিকায় একটি উপন্যাসের সমালোচনা ছাপা হয়েছে। সমালোচক বলছেন, এই উপন্যাসের লেখক বিভূতিভূষণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি। উপন্যাসটির নাম 'নূরজাহান'। লেখকের নাম
ইমদাদুল হক মিলন। দেশ পত্রিকায় এমন নির্ভেজাল প্রশংসা আমি আর কোনো লেখার হতে দেখিনি।
নূরজাহানের গল্প শেষ করতে মিলন প্রায় তেরো শ পৃষ্ঠা লিখেছেন। বাংলাদেশে এটিই মনে হয় সর্ববৃহৎ উপন্যাস। লেখক হিসেবে জানি একটি গল্পকে তেরো শ পৃষ্ঠা পর্যন্ত টানার অর্থ দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনীর পরিশ্রম, রাত্রি জাগরণ, ক্লান্তি ও হতাশা। হতাশার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি, যেকোনো রচনাতেই লেখকের নানান হতাশা থাকে। গল্পটা যেমন দাঁড় করানো দরকার সে রকম করা গেল না। বিশেষ কোনো চরিত্র আরো স্পষ্ট হওয়া উচিত, তা হলো না, এইসব।
হতাশার সঙ্গে আসে আনন্দ। গল্প শেষ করার আনন্দ। নিজের কথা বলি, মিসির আলি বিষয়ক মাত্র চলি্লশ পৃষ্ঠার একটি বড় গল্প (বৃহল্ললা) শেষ করে আমি গল্প শেষ হওয়ার আনন্দে অভিভূত হয়েছিলাম। নূরজাহান শেষ করে মিলনের আনন্দ নিশ্চয়ই আমার চেয়ে চৌত্রিশ গুণ বেশি হয়েছে। নূরজাহান বৃহল্ললার চেয়ে চৌত্রিশ গুণ বড়। সব লেখকই চান তাঁর নিজের আনন্দের ছায়া পাঠকের মধ্যে পড়ুক। লেখক যেন বুঝতে পারেন তাঁর কষ্ট জলে ভেসে চলে যায়নি।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও বাংলাদেশে মিলনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কেন জানি ঘটছে না। উদাহরণ দিয়ে স্পষ্ট করি। এখন দৈনিক পত্রিকাগুলোর ফ্যাশন হলো সাহিত্য বিচারকের ভূমিকায় অভিনয় করা। এরা বর্ষসেরা উপন্যাস, মননশীল লেখার তালিকা তৈরি করে এবং পাঠকদের ভাবতে বাধ্য করে, এসব রচনাই শ্রেষ্ঠ, বাকি সব আবর্জনা।
কালের কণ্ঠ দশটি সেরা উপন্যাসের তালিকা তৈরি করল, মিলনের নূরজাহান সে তালিকায় নেই। আমি ভাবলাম, মিলন এই পত্রিকায় কাজ করে বলেই হয়তো তার নাম নেই। লোকে না ভেবে বসে তারা নেপোটিজম করছে।
প্রথম আলোর সেরা দশেও মিলন নেই। এতে মিলনের মন খারাপ হয়েছে কি না জানি না, আমি বিরক্ত হয়েছি। মিলনকে ডেকে বলেছি, দৈনিক পত্রিকার সেরা দশের পুরো আয়োজনই ভুয়া। এই সেরা কারা নির্বাচন করেন? তাঁরা কি বছরে প্রকাশিত সব লেখা পড়েন?
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র একসময় বই নামে পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করত (হয়তো এখনো করে), সেখানে প্রকাশিত বইগুলোর পরিচিতি ছাপা হতো। দায়িত্বে ছিলেন এক বিদগ্ধ সমালোচক। একদিন অবাক হয়ে দেখি, আমার গল্পগ্রন্থ 'আনন্দ বেদনার কাব্য' নিয়ে লেখা হয়েছে_হুমায়ূন আহমেদের কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো সুন্দর। কিছু কবিতায় ছন্দের ত্রুটি দেখা গেলেও রূপক নির্মাণে কবির দক্ষতা আছে।
আমি মিলনের নূরজাহান প্রখম খণ্ড অনেক আগেই পড়েছিলাম। কালের কণ্ঠ ও প্রথম আলোর ভূমিকায় ব্যথিত হয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড পড়ে শেষ করলাম। অবশ্যই এই গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। আমি হলে বইটি তিন শ পৃষ্ঠাতে সীমাবদ্ধ রাখতাম। নূরজাহানের প্রধান ত্রুটি, এর লেখক 'কড়ি দিয়ে কিনলামের' বিমল মিত্র হতে চেয়েছেন। যেন সবাই বলে, এই দেশের সবচেয়ে বড় উপন্যাস ইমদাদুল হক মিলন লিখেছেন। বৃহৎ উপন্যাস রচিত হবে_এটি কোনো লেখার চালিকাশক্তি হতে পারে না।
কবি ড ই ণবধঃং তাঁর ছেলেকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, লেখকদের জন্য আলাদা নরক যদি থাকে, সেখানে থাকবে তাঁদের শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো। যেসব ভুল এই লেখাগুলোতে করা হয়েছে, তা লাল কালিতে চিহ্নিত থাকবে। বাহুল্য দাগানো থাকবে। যা বাদ পড়েছে তাও উল্লেখ করা হবে। লেখক তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনাগুলোর ত্রুটি দেখে নরকযন্ত্রণায় অনন্তকাল দগ্ধ হবেন।
কবি ণবধঃং-এর কথা ধরে বলি, বিভূতিভূষণের নরকে থাকবে পথের পাঁচালি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নরকে থাকবে পুতুল নাচের ইতিকথা এবং ইমদাদুল হক মিলনের নরকে নূরজাহান। এই অর্জনই বা কম কী! ইমদাদুল হক মিলনকে অভিনন্দন!
পাদটীকা-১
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ আমাকে এবং মিলনকে একটি বই উৎসর্গ করেছিলেন। বইটির নাম 'সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে'। ঔপন্যাসিক হিসেবে আমরা দুজনই নষ্ট_এমন সূক্ষ্ম ইঙ্গিত। আমি বিষয়টায় মজা পেয়ে হাসলাম। মিলন প্রতিশোধের বাসনায় হুমায়ুন আজাদকে একটি বই উৎসর্গ করল। বইটির নাম 'বনমানুষ'।
অধ্যাপক আজাদ এ ঘটনায় যথেষ্টই বিরক্ত হয়েছিলেন।
পাদটীকা-২
ইমদাদুল হক মিলনের মতো ধৈর্য আমার নেই। কাজেই তেরো শ পৃষ্ঠার রং পেন্সিল লিখতে পারছি না। এই পর্বেই ইতি টানছি। পাঠকদের সঙ্গে আবারও কোনো এক প্রসঙ্গে দেখা হবে। বিদায়।
আপনাদের সহযোগীতা না পেলে এই সাইট সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। তাই যদি বইটি ভালো লেগে থাকে তাহলে দুচার লাইন লিখে আপনার অভিব্যাক্তিগুলো জানিয়ে রাখুন আমাদের কমেন্টস বক্সগুলোতে। আর শুধু মাত্র তাহলে আমরা আরও অনেক বই নিয়ে আপনাদের সামনে আসতে পারবো। ধন্যবাদ।
নতুন বই ইমেইলে পেতে হলে
1 Comments