বিজনে নিজের সঙ্গে দেখা
যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি
এখনও ফর্সা, স্লিম, প্রকৃত সুন্দরী পাত্রী চাই
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
খবরের কাগজের যে পৃষ্ঠা কিংবা পৃষ্ঠাগুলি আমি জীবনে কখনও পড়িনি কিংবা পড়ার দরকার হয়নি, তা হল পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনের পাতা। খুদে খুদে অক্ষর, সাংকেতিক ভাষায় লেখা ওই সব বিজ্ঞাপনে কখনও চোখ পড়ে গেলেও চোখ সরিয়ে নিয়েছি। মাত্র কয়েক দিন আগে এক বর্ষার বিকেলে মুড়ি-তেলেভাজা খাওয়ার জন্য টেবিলের উপর খবরের কাগজ পাতা হয়েছে, ঢেলে দেওয়া হয়েছে মুড়ি, বেগুনি এখনও ভাজা শেষ হয়নি, আমি আবার কাঁচালঙ্কার অর্ডার দিয়েছি, চোখের সামনে ছাপা অক্ষর থাকলে তাতে অলস ভাবে চোখ বোলাতেই হয়। সেই ছড়ানো দু’পাতা ভর্তি সবই পাত্র-পাত্রী সংবাদ। কয়েকটি পড়ার পর আমার সমস্ত শরীরে যেন একটা ঝাঁকুনি লাগল। এ সব আমি কাদের কথা পড়ছি? এই দেশ সম্পর্কে আমি এতই অজ্ঞ? এই সমাজে যে এত অসংখ্য জাতপাত ভেদ আছে, সে সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আমরা সমাজে যে একটা ছোট গোষ্ঠীর মধ্যে ঘোরাফেরা করি, সেখানে এখন প্রায় কেউ জাতপাত নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু তার বাইরের সমাজটা যে একেবারে শুদ্ধ হয়ে যায়নি, সে সম্পর্কেও ধারণা আছে। কিন্তু তা মোটা দাগের ধারণা। যেমন, বামুন, কায়েত, বৈদ্য-শূদ্র, আর ও-দিকে হিন্দু-মুসলমানের প্রভেদ। কিন্তু পূ: ব: কায়স্থ, সিংহ, সৌকালিন, দেবারি, কন্যারাশি, কলিস্থ দো: গহ, com.eng.31/5’4 পাত্রের জন্য স্বজাতীয় পাত্রী চাই। এর মানে কী? খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে অনেক পয়সা খরচ হয় আজকাল, তাই বক্তব্য যত দূর সংক্ষেপ করার জন্য নানা রকম সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করতে হয়। সেটা স্বাভাবিক। এ বিজ্ঞাপন যারা দেয় এবং যারা পড়ে তারা নিশ্চয়ই সংকেতগুলো বোঝে। আমাদের মতো অনধিকারীদের দুর্বোধ্য মনে হবে। যেমন উল্লিখিত বিজ্ঞাপনটির কলিস্থ দো গৃহ, অনেক চিন্তা করে এর অর্থ বের করলাম। খোদ কলকাতায় দোতলা বাড়ির মালিক। কেন? কিন্তু একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার পাত্র এতই জাত মানে যে শুধুই কায়স্থ পাত্রী হলে হবে না। গোত্রটোত্র সব মেলাতে হবে! সৌকালিন একটা গোত্রের নাম আমি জানি, কন্যারাশিও শুনেছি, কিন্তু দেবারিটা কী ব্যাপার? অন্য কয়েকটা বিজ্ঞাপন পড়ে বুঝলাম, ‘গণ’ বলে একটা ব্যাপার আছে। নরগণ, দেবগণ ইত্যাদি। আমার এতখানি বয়স হল, সত্যি এই ব্যাপারটা এত দিন জানা ছিল না। তা হলে ‘দেবারি’ ব্যাপারটাও বোঝা গেল, দেবগণ নরগণ-এর মতো রাক্ষসগণও হয়। কিন্তু রাক্ষসটা দেখতে খারাপ লাগে, তাই দেবারি হয়ে গেল। কেউ কেউ সঠিক অর্থ না বুঝে বানান ভুল করে দেবারীও লিখেছে। বিবাহ-মঙ্গল। ‘অপুর সংসার’ ছবির একটি দৃশ্য। অন্তত শতকরা আশি ভাগ বিজ্ঞাপন পূ: ব: কিংবা প: ব: দিয়ে শুরু। দেশ ভাগ হয়ে গেছে চৌষট্টি বছর আগে, পূর্ববঙ্গ নামে এখন কোনও স্থানই নেই, এখনকার ছেলেমেয়েরা বাপ-ঠাকুর্দার সেই দেশ চর্মচক্ষে দেখেইনি। তবু বিজ্ঞাপনে এর উল্লেখের অর্থ হল, যে সব পরিবারের ইস্টবেঙ্গল অরিজিন, সে রকম পরিবারের সঙ্গেই বৈবাহিক সম্পর্ক পাতাতে চায় বিজ্ঞাপনদাতা। আর প: ব: থাকা মানে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে তারা খাঁটি পশ্চিমবঙ্গীয়, বাঙাল বাড়ির পাত্র বা পাত্রী চায় না। অর্থাৎ শুধু জাতের মিল থাকলেই হবে না। বাঙাল-ঘটির ভেদাভেদ এখনও রয়ে গেছে পুরোমাত্রায়। একটি বিজ্ঞাপনে দেখলাম, পাত্রী শুধুমাত্র মেদিনীপুরের হওয়া আবশ্যক। কিছু কিছু শব্দের অর্থ আমি অনেক চেষ্টা করেও বুঝিনি। যেমন, ‘ফর্সা সুন্দরী, সু-উপায়ী মাঙ্গলিক সুপাত্র কাম্য’।
মাঝখানে কমা টমা কিছু নেই। সুউপায়ী কে? পাত্র না পাত্রী? আর মাঙ্গলিক কোন অর্থবোধক? অন্য একটি বিজ্ঞাপনে ‘কায়স্থ, আলিম্বান গোত্র’ এ রকম গোত্র হয়? ছাপার ভুল? শুদ্ধ রূপটাই বা কী হতে পারে? ‘পূ: ব: ব্রাহ্মণ, নরগণ, মকর, o+ ...’ কী ব্লাড গ্রুপ? মকর কী? প: ব: তন্তুবায় (gen) দেবারি ধনু’, gen-এর মানে বুঝলাম না, আর ধনু? আমি সরল ভাবে আমার অক্ষমতার কথা জানাচ্ছি, হয়তো অনেকেই এ সব বোঝে ও জানে। কবি তারাপদ রায়ের প্রচুর সরস গল্পের স্টক ছিল। সে আমাদের বলত যে সে নিয়মিত পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন পড়ে, নিজের জন্য নয় বা তার বউয়ের জন্যও নয়, কারণ সে মাঝে মাঝে এর মধ্যে অনেক মজার গল্পের সন্ধান পায়। যেমন, সে বলেছিল, একটি বিজ্ঞাপন, ‘গরিব বি এ প্লাকড, কোনো ভদ্র পরিবারে বিবাহ করিয়া ভাইয়ের মতো থাকিতে চাই।’ আর একটি ‘পাত্রী সুদর্শনা, বি এড, গৃহকর্মনিপুণা শুধু একটু গোঁফ আছে।’ এবং আর একটিতে পাত্রের যোগ্যতা, ‘গভ: ইঞ্জি: দৈনিক সাড়ে তিন যোগের বেশি না।’ এ সব সত্যি না তারাপদ রায় কল্পিত, তা অবশ্য জানি না। আমার কোলের সামনে পৃষ্ঠাগুলিতে এ রকম কোনও মজার কাহিনি নেই। শুধু একজন পাত্র লিখেছেন, মাথায় টাক আছে। আর একটি বিজ্ঞাপনে করুণ কাহিনির আভাস, ‘ফর্সা, স্লিম, IT-তে কর্মরতা, নামমাত্র বিবাহে সাড়ে তিন মাসেই ডিভোর্সি’।
এটুকু পড়লেই আহা রে বলতে ইচ্ছে করে। আমাদের গল্প-উপন্যাসে প্রেমের ঘটনার ছড়াছড়ি। কিন্তু এখনও জনসাধারণের অধিকাংশই প্রেম-ট্রেম নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিংবা অল্প বয়সে ও সব একটু হলেও তার সঙ্গে বিয়ের কোনও সম্পর্ক নেই। বিয়ে হয় বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনের উদ্যোগে অথবা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনে। ওই সব প্রেম কিংবা ছেলেমেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্তে বিয়ে কিংবা বিয়ে ভাঙা একটা বিশেষ ক্ষুদ্র শ্রেণির ব্যাপার। জাত গোত্র মিলিয়ে বিয়ে এখনও পর্যন্ত নিরাপদ। বড় শহরে হয়তো কেউ ও নিয়ে ততটা মাথা ঘামায় না। কিন্তু দেশ মানে তো শুধু শহর নয়। অন্য জাতের ছেলেকে বা মেয়েকে বিয়ে করলে বাবা-মা নিজেদের হাতে ছেলে বা মেয়েকে কিংবা দু’জনকেই খুন করে। এমন তো প্রায়ই শোনা যায়। গ্রামাঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমান ছেলে মেয়ের বিয়ে হলে তাদের প্রাণের ভয়ে পালাতে হয়। এমনকী কলকাতা শহরেও তো কিছু কাল আগে রিজওয়ানুর নামে একটি সুদর্শন শিক্ষিত মুসলমান ছেলে প্রিয়ঙ্কা নামে মাড়োয়ারি কন্যাকে বিয়ে করার ফলে কী ভয়ঙ্কর কাণ্ডই হল। এই ধরনের ঘটনা যখন খবরের কাগজে পড়ি, তখনই আমার মনে হয়, আমরা এখনও প্রকৃত সভ্য হইনি। আমার ধারণা ছিল, পণপ্রথা যেমন বেআইনি হয়ে গেছে, সে রকম এই সব বিজ্ঞাপনে ফর্সা কালোর উল্লেখ করা নিষিদ্ধ। কী ভুল, কী ভুল সেই ধারণা! পণপ্রথাও যেমন আড়াল দিয়ে অনেকটাই চলে, তেমনই বিজ্ঞাপনে ফর্সা পাত্রী চাওয়া হয় নির্লজ্জ ভাবে। আমেরিকার বর্ণবৈষ্যমের আমরা কত নিন্দে করেছি, দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে আফ্রিকার অন্য কয়েকটি রাজ্যে শ্বেতাঙ্গরা বহু কাল অত্যাচার করার পর এখন হার মেনে কৃষ্ণাঙ্গদের শাসন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর ভারতে আমরা এখনও প্রকাশ্যে ফর্সা মেয়ে চাইছি। পাত্রী পক্ষের বিজ্ঞাপনে একটিও ফর্সা ছেলে চাওয়া হয়নি। বরং নিজেদের পরিচয়ে অনেক ক্ষেত্রে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে উ: শ্যা: অর্থাৎ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। পাত্রপক্ষের বিজ্ঞাপনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফর্সা রঙের দাবি আবশ্যিক। একটি বিজ্ঞাপনে দেখলাম, সদর্প ঘোষণা: ‘ফর্সা প্রকৃত সুন্দরী ছাড়া যোগাযোগের আবশ্যকতা নাই’।
প্রকৃত সুন্দরী কাকে বলে? চল্লিশ শতাব্দী ধরে কবির দল তার সংজ্ঞা গুনে চলেছে আর বাংলার পাত্রপক্ষ তা জানে। মেয়েদের শরীরের গড়ন সম্পর্কে স্লিম কথাটি প্রায় সর্বত্র। অথচ বাংলায় ‘তন্বী’ একটা কী সুন্দর শব্দ আছে। বাংলা কাগজে কেউ কেউ ইংরেজি বিজ্ঞাপন দেয়। ‘E B Brahmin bride 27, fair, beautiful...’ আমার ধারণা ছিল ব্রাইড শব্দটার অর্থ বিবাহ-উৎসবের দিনে কোনও রমণী, বিয়ের আগে কিংবা পরে কী করতে ব্রাইড বলে? কনে শব্দটা যেমন বিয়ের রাতে তো শুধু কনেও এখন বোধহয় অর্থের ব্যাপ্তি ঘটেছে। শতকরা আশিটি বিজ্ঞাপনেও জাতপাতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মিল খোঁজা হয়েছে। একটি বিজ্ঞাপনে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে পাত্রীকে হতে হবে নিরামিষভোজী। আর একটি বিজ্ঞাপনে খুবই আশ্চর্যজনক ভাবে দাবি করা হয়েছে, মা-বাবা-ভাই-বোন থাকা আবশ্যিক। এই সব বিজ্ঞাপন থেকে সমাজচিত্রের কিছু কিছু পরিবর্তনও নিরীক্ষণ করা যেতে পারে। কিছু কিছু বিজ্ঞাপনদাতা প্রগতিশীল হচ্ছেন, জানিয়ে দিচ্ছেন অসবর্ণে আপত্তি নাই। কেউ কেউ বলছেন স/অ চলতে পারে। অর্থাৎ সবর্ণ বা অসবর্ণ। একটি বিজ্ঞাপনে দেখলাম, ‘স/উ: অ’-এর মানে প্রথমে বুঝতে না পেরে অনেক গবেষণা করে বার করতে হল, সবর্ণ অথবা উচ্চ অসবর্ণে আপত্তি নাই। উচ্চ অসবর্ণ কী জিনিস, তা আমার বুদ্ধির অগম্য। বস্তুতপক্ষে এই যে গোত্র, বর্ণ ইত্যাদি সবই আসলে ভাবের ঘরে চুরি। হাজার হাজার বছর ধরে এগুলি অবিকৃত বা শুদ্ধ আছে না ছাই। টাকা থাকলেই ইচ্ছে মতো জাত কেনা যায়। বিশ্বামিত্র নাকি তপস্যার জোরে ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণ হয়েছিলেন। এ যুগে তপস্যা-টপস্যা লাগে না। যদি অধ্যাবসায় থাকে, সৎ বা অসৎ পথে বহু অর্থ উপার্জন করা যায়। তা হলে যে কোনও জাতি ধর্মকে সে তুচ্ছ করে দিতে পারে। কিছু কিছু মুসলমান পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনেও রয়েছে দেখলাম, ইসলামে এত জাতপাতের বিভেদ নেই। কিন্তু প্রতিটি বিজ্ঞাপনেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, পাত্র বা পাত্রী সুন্নি মুসলিম এবং তারা সুন্নি পাত্র পাত্রীই চায়। আমাদের এ অঞ্চলে শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলিম নেই বললেই চলে। তবু এই সতর্কতা। একটি প্রায় বিপ্লবী বিজ্ঞাপন উদ্ধৃত করে আপাতত শেষ করা যেতে পারে। “প: ব: ব্রাহ্মণ (নাস্তিক) ৩০/৫’ 7’’ চার্টার্ড অ্যাকা: ৭৫,০০০।
একমাত্র সন্তান। কোনও দাবি নাই। শিক্ষিতা সুন্দরী ফর্সা ও কেবলমাত্র রেজিস্ট্রি বিবাহে আগ্রহী।” নাস্তিক হলে কী করে ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দেওয়া যায়, জানি না। সে প্রশ্ন তুলছিও না। এই বিজ্ঞাপনকে প্রায় বিপ্লবী বলার কারণ, ফর্সা শব্দটি বাদ দিলেই ঠিক মানানসই হত। আমি নিজে ঝিরকুট্টি কালো। আমার বউ কালো ছাতা ব্যবহার করলে মিশে যাব বলে আমার পরিবারের সকলেই ঝড়ের আগে মেঘবর্ণ। তাই কালোদের প্রতি আমার দুর্বলতা তো থাকবেই! তারাপদ রায় উবাচ সম্রাট শের শাহ প্রথম ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেন। তার আগে ঘোড়ারা বুঝি ডাকত না?
বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক!