মহাত্মা লালন ফকির - শ্রীবসন্ত কুমার পাল
লালন সাঁই বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতির পুরোধা ও রেনেসাঁ ব্যক্তিত্ব। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমান সম্মানীয়। তাঁর গান প্রায় সবারই দৃষ্টি ও মনোযোগ কেড়েছে।
অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে অগোচরে ছিল লালন ও তাঁর বাউলসংগীত। শুধু শিষ্য-প্রশিষ্য ও ভক্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এর প্রচার-প্রচারণা ও আবেদন। যদিও এখন লালন সর্বজনীন সম্পদ ও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিগণিত হয়েছে। ছেউড়িয়ার এক বাউলের গানে টুটে গেছে গ্রাম-শহরের বিভেদরেখা।
লালনকে জানার প্রথম প্রামাণ্য কাজটি করেন বসন্তকুমার পাল। রচনা করেন প্রথম প্রামাণ্য লালন জীবনী। প্রসঙ্গত, তাঁর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গান সংগ্রহ ও প্রকাশ করেন।মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত হিতকরী পত্রিকায় লালনের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়। প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত বসন্তকুমারের লালন-সম্পর্কিত প্রবন্ধ লালনচর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করে। আজ থেকে দীর্ঘ ৫৭ বছর আগে প্রকাশিত তাঁর মহাত্মা লালন ফকির বইটি দীর্ঘকাল ধরেই দুষ্প্রাপ্য ছিল।
লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরীর সম্পাদনায় বইটির প্রতিলিপি সংস্করণ এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদক দীর্ঘ ভূমিকায় লালনচর্চার প্রেক্ষাপটে বসন্তকুমার পালের জীবন ও সাহিত্যকর্মের তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ দিয়েছেন। সংযোজন করেছেন অপ্রকাশিত পত্রাবলি, অগ্রথিত রচনা, আলোকচিত্র, গ্রন্থ সমালোচনা ও শ্রাদ্ধপত্র।
বসন্তকুমার পালেরমহাত্মা লালন ফকির-এর সমালোচনা ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে: ‘...শত শত হিন্দু ও মুসলমানের গুরুপদে বৃত হইয়া সমাজ-নির্বিশেষে বহু লোকের অধ্যাত্ম-জীবনকে ফুটাইয়া তুলিতে সমর্থ হয় তাঁহারই বিচিত্র কাহিনী এই পুস্তকে সুন্দর ভাষায় বর্ণিত হইয়াছে। ... লালনের গান সব সময় পাওয়া যায় না। সুতরাং এই পুস্তকে সংগৃহীত রচনাগুলিও বাউল গানের সংগ্রহ হিসেবে আদরণীয় হইবে।’
উল্লেখ্য, বৃহত্তর নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার কুমারখালী থানার ধর্মপাড়া গ্রামে বসন্তকুমার পাল (১৮৯০-১৯৭৫) জন্মগ্রহণ করেন। গড়াই নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত ধর্মপাড়াসংলগ্ন গ্রাম ভাঁড়ারা ফকির লালন সাঁইয়ের জন্মস্থান। সাধক লালন দেহত্যাগ করেন বাংলা ১২৯৭ সনের ১ কার্তিক, আর লালনচর্চার পথিকৃৎ বসন্তকুমার পালের জন্ম ওই একই সালে, একই মাসে। আজীবন তিনি একাগ্র নিষ্ঠায় লালনচর্চায় নিবেদিত ছিলেন। বইয়ে শুধু লালনের জীবনী নয়, বেশ কিছু গান সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যেমন: ‘আছে আদি মাক্কা এই মানবদেহে। ‘দ্যাখনা রে মন! ভেয়ে/দেশ দেশান্তর দৌড়ে এবার মরিস কেন হাঁপিয়ে।/ক’রে অতি আজব ভাক্কা/গড়ছে সাঁই মানুষ মাক্কা। কুদরতি নূর দিয়ে/ও তার চারধারে চার নূরের ইমাম/মধ্যে সাঁই বসিয়ে...।’ গানটির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে: ‘ভাবের কথা ছাড়িয়া দিয়া এই সঙ্গীতটির শব্দবিন্যাস, হ্রস্ব ও দীর্ঘস্তরের সন্নিবেশ... ও ছন্দজ্ঞানের পাণ্ডিত্য পরিষ্কার হূদয়ঙ্গম করা যায় অথচ তিনি লেখাপড়া জানিতেন না।...এই দেহেই তিনি বিরাজিত, এই মানুষের মধ্যেই ভগবানের বিকাশ, ইহার মধ্যেই তাঁহার বিলাস এবং এই মানবজগৎ লইয়াই যে তাঁহার লীলাখেলা এই কথাই তিনি পুনঃ পুনঃ আলোচনা করিয়া গিয়াছেন।’ অর্ধশত বছর আগে লালনের গানের এমন মূল্যায়ন শ্লাঘা বৈকি।
আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত লালনচর্চার আকরগ্রন্থটি, লালন অনুরাগী ও লালনচর্চার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে নতুন ভাবনা ও বোধের খোরাক জোগাবে। বসন্তকুমারের দৃষ্টিতে ও সম্পাদকের ভূমিকার আলোকে খুঁজে পাওয়া যাবে বাঙালি সংস্কৃতির পুরোধা লালন সাঁইকে।
মহাত্মা লালন ফকির—শ্রীবসন্ত কুমার পাল \ আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত \ পাঠক সমাবেশ \ প্রচ্ছদ: সেলিম আহমেদ \
11 Comments
Dhonnobad
subscriber only.