Ticker

6/recent/ticker-posts

১৯৭১ - হুমায়ূন আহমেদ

amarboi.com


১৯৭১ - হুমায়ূন আহমেদ

১৯৭১
হুমায়ূন আহমেদ
প্রকাশক: আফসার ব্রাদার্স
ছোট্ট একটি গ্রাম নীলগঞ্জ। ময়মনসিংহ-ভৈরব লাইনের একটি স্টেশন নান্দাইল রোড। দশ মাইল উত্তরে গেলে রুলাইল বাজার। বর্ষাকালে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। আরও মাইল ত্রিশেক উত্তরে মধুবন বাজার। শীতকালে গরুর গাড়ি চলে। বর্ষায় হাঁটতে হয়। পুবদিকে সাত-আট মাইল গেলে মধুবনের জঙ্গলা মাঠ। তার ‘পেছনে নীলগঞ্জ গ্রাম। দরিদ্র শ্রীহীন ত্রিশ-চল্লিশ ঘরের একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ।’ নীলগঞ্জের জলাভূমির দিকটায় একদল কৈবর্ত থাকে। গ্রামের সঙ্গে তাদের খুব একটা যোগ নেই। হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাসোম রচনা ১৯৭১-এর ঘটনা এই নীলগঞ্জের।
এ রকম দুর্গম ও প্রায় বিচ্ছিন্ন একটা জনপদে একদল মিলিটারি এসে স্কুলঘর দখল করে বসেছে। উপন্যাসে কোনো যুদ্ধের ঘটনা নেই। পাকিস্তানি সৈনিকদের কমান্ডার এজাজ আহমেদের সঙ্গে ফুলপ্যান্ট এবং নীল রঙের হাফশার্ট পরা রফিক নামে এক যুবককে দেখা যায়। তার মাধ্যমেই মেজর এজাজ লোকজন ডেকে জেরা করছেন আর শাস্তি দিচ্ছেন। এজাজের ধারণা, জঙ্গলের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে আছে, সৈনিকও থাকতে পারে। 
গ্রামের মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখব আপাত দৃষ্টিতে তাদের আত্মসম্মানবোধ নেই। তারা ভীরু। মেজর এজাজ যে রকম মনে করেন, ‘কুকুরেরও আত্মসম্মানবোধ থাকে, এদের তাও নেই।’ গল্পটি আমাদের শেষ পর্যন্ত এমন এক জায়গায় নিয়ে যাবে, যেখানে দেখব চাইলেই যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া যায় না। জীবন হয়ে ওঠে তুচ্ছ। 
কৈবর্ত মনাকে আগের একটা খুনের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে তার ১১ বছরের ভাইকেসহ প্রকাশ্যে গুলি করে মারা হলো পাকিস্তানি মেজর এজাজের নির্দেশে। এটা করেছেন একটা ‘নিষ্ঠুরতার নমুনা’ হিসেবে। মেজর বলেন, ‘মানুষকে ভয় পাইয়ে দেবার একটা আলাদা আনন্দ আছে।’ এই বিকৃত-মস্তিষ্ক লোকটি আবার এই নৃশংসতাকে বৈধতা দিতে চায় এভাবে—‘আমরা একটা যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি। সারভাইভালের প্রশ্ন। এ সময়ে অন্যায় কিছু হবেই।’ পৃথিবীতে মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের নৃশংসতা ও অপকীর্তিকে এভাবে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টাই শুধু চলে না, তাকে শ্রেয়তর এবং মহত্তর করার চেষ্টা চলে সবসময়।
কিন্তু মনা ভয় পায় না। ভাইকেও অভয় দেয়, আমাকে শক্ত কইরা ধর। আজিজ মাস্টারকে যখন উলঙ্গ করে গ্রামের ঘোরাবার নির্দেশ দিলেন মেজর এজাজ, আজিজ মাস্টার বললেন, ‘মেজর সাহেব, আমি মরবার জন্য প্রস্তুত আছি।’ অসহায় সফরউল্লাহও অবশেষে তার স্ত্রী ও বোনের চরম অপমান ও নিপীড়নের প্রতিশোধ নিতে এক সুবেদার ও এক রাজাকারের খোঁজে মাঠে নেমে পড়েছে। উপন্যাসের শুরুতে এদের এই ভূমিকা কল্পনাও করা যায়নি।
মিলিটারির উপস্থিতিতে খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখাল না মীর আলি। আজ নিজাম হলো আনন্দিত। একজন অন্ধ, অন্যজন পাগল। নিজাম যে পাগল, রফিক তা কীভাবে বুঝল? মেজরের এ প্রশ্নে রফিকের উত্তর, ‘ও মিলিটারি আসায় অত্যন্ত খুশি হয়েছে।’ মিলিটারি আসায় যে লোক খুশি, সে পাগল নয় তো কি। মিলিটারি নয় বরং ঝড় খুবই আতঙ্কিত করেছে অন্ধ মীর আলিকে। এই অন্ধ ও পাগল দুই চরিত্র নীলগঞ্জের এই দুর্যোগের মধ্যে দুই ব্যতিক্রম। আর ব্যতিক্রম কুকুর, গিরগিটি, শেয়াল। ‘নিম্নশ্রেণীর প্রাণীরা অনেক কিছু বুঝতে পারে। তারা টের পায়।’
গল্পটা এক পাকিস্তানি মেজর ও এক বাংলাদেশি গ্রামের গল্প। কিন্তু এক সূক্ষ্ম পথে গল্পটি একজন পাকিস্তানি সৈনিক ও এক বাঙালি যুবকের গল্প হয়ে উঠেছে। এই যুবক রফিক, শুরু থেকেই তাকে পাকিস্তানি মেজরকে সহায়তা করতে দেখি কিন্তু তার জীবনদৃষ্টি পাকিস্তানি মেজরের সম্পূর্ণ উল্টো। বাঙালিদের আত্মসম্মানবোধ নিয়ে মেজর রসিকতা করেন। তিনি যোদ্ধাদের খবর বের করার জন্য নৃশংসতার চূড়ান্ত করেন। তার কথা শুনতে রফিক বাধ্য। কিন্তু নির্দেশ মানার এবং মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে আগাগোড়া একটা সূক্ষ্ম সীমারেখা টেনে রেখেছেন লেখক কৃতিত্বের সঙ্গে।
উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদের স্বভাবসুলভ কিছু মজা আছে। মানুষের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কিছু আচরণ, প্রবণতা নিয়ে তিনি মজা করেন। কিন্তু সবকিছুর ভেতর দিয়ে প্রায় দুর্গম নিস্তরঙ্গ একটি গ্রামে অল্পকিছু সময়ের মধ্যে যে ঘটনাগুলো ঘটে, তাতে দেখা যায় যুদ্ধকালের রুদ্ধশ্বাস পরিবেশ আর মানুষের ঘুরে দাঁড়ানো, মুত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো সাহসী হয়ে ওঠা।

Post a Comment

1 Comments

Tearless said…
Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks Thanks