হুমায়ূন আছেন হুমায়ূনের মতোই - বেলাল বেগ
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার যখনই দেখা হয়, কথাবার্তা শুরু হয় আগের দেখায় যেখানে শেষ হয়েছিল, সেখান থেকে। দুঃখের বিষয়, তাঁর দেখা পাওয়াটাই সংখ্যাতত্ত্বের ‘সম্ভাব্যতা’ অধ্যায়ের একটি খ্যাপা অঙ্ক। ওই অঙ্ক মেলাতে না পেরে তাঁর মায়ের স্বপ্ন ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যায়তন’ বীজতলায় ফেলেই আমি আমেরিকায় স্বনির্বাসনে এসেছি এক যুগ আগে। কয়েক বছর আগে নিউইয়র্কে শেষবার যখন দেখা হয়েছিল, কুশলাদির পর জানতে চাইলেন কী করছি। বললাম, নাতি-নাতনির বেবি-সিটিং করছি। উত্তরে খুশি হলেন না। সদাবিনয়ী মানুষটি অনেকটা ধমকের সুরে বললেন, ‘ওটা আপনার কাজ নয়, আপনি ফিরে চলুন, স্কুলটা চালু করুন। আমি গিয়ে সব ব্যবস্থা করব, আপনাকে চিঠি পাঠাব।’
স্কুলটার জন্য বিশেষ করে হুমায়ূনের মায়ের ইচ্ছাটা পূরণের জন্য সব সময় মন কাঁদত। হুমায়ূন জমি কিনলেন, স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উপলক্ষে ঢাকা থেকে যাওয়া একঝাঁক সাহিত্য-সংস্কৃতিকর্মী, গায়ক-বাদক, অভিনেতা-অভিনেত্রী নেত্রকোনার ছোট্ট গ্রাম কুতুবপুরে এলে আশপাশের গ্রাম থেকে লোক ভেঙে পড়ে। উৎসবের আনন্দ হঠাৎ শুরু হওয়া ঝড়-বৃষ্টিকেও উড়িয়ে নিয়ে গেল। হুমায়ূন আহমেদের গ্রাম কুতুবপুরে স্কুল হবে—এই সংবাদে গোটা এলাকা জেগে উঠল। গ্রামে যাওয়ার রাস্তা ছিল না। রাতারাতি রাস্তা হলো। বহু যুগের অন্ধকার তাড়িয়ে বিদ্যুতের আলো এল ঝলমলিয়ে। কাছাকাছি বসে যায় বিরাট বিপণিকেন্দ্র। সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা হাত বাড়াতেই পাওয়া গেছে। কারণ কী? শত সমস্যায় জর্জরিত, শত বছরের শোষণ-বঞ্চনায় নিষ্পেষিত সাধারণ বাঙালির ভেতরে যে অদম্য ও আনন্দপ্রিয় বাঙালিটি লুকিয়ে আছেন, তাঁকে প্রকাশ্য আলোকে মেলে ধরে মহিমান্বিত করেছেন যে মানুষটি, তাঁর জন্ম হয়েছিল ওই গ্রামে। সেবার যতক্ষণ হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ছিলাম, ততক্ষণ দেশে ফিরে গিয়ে আবারও স্কুলটার দায়িত্ব নিতে ইচ্ছা করছিল। হুমায়ূনের মনের গভীরতম দেশে তুচ্ছ কিংবা অতিমূল্যবান যেকোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছার জন্ম-মৃত্যু ফুটন্ত জলের মতো নাচে। মনে মনে ভাবলাম ডাক এলে যাব, না এলে খুশি হব; এ জন্য যে ‘পুরোনো মনটাতে আর সয় না কোনো নতুন জ্বালাতন’।
দিন যায়। একদিন পত্রিকায় পড়লাম হুমায়ূন অসুস্থ, তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, তাঁকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়েছে। সদাপ্রফুল্ল, সদাজাগ্রত, কৌতুকপ্রিয়, গভীর আনন্দপিয়াসী, সব মুহূর্তে অনুসন্ধিৎসু এই মানুষটির হার্ট অ্যাটাক হতে পারে না। কিন্তু হয়েছিল। পত্রিকার ছবিতে হার্ট অ্যাটাকে বাঁকা তাঁর মুখ যমুনাতটে তাজমহল হেলে পড়ার মতো মর্মান্তিক মনে হয়েছিল। তার পরের খবর হুমায়ূনের যেকোনো নাটকের চেয়ে নাটকীয় এবং অকল্পনীয় মর্মন্তুদ—হুমায়ূন আহমেদ সপরিবারে নিউইয়র্কে আছেন, তাঁর ক্যানসার হয়েছে। শুনলাম, হুমায়ূন এখন কারও সঙ্গে দেখা করবেন না। মনে হলো, আমি মুষড়ে পড়ব। যে হুমায়ূন শিক্ষক বেলাল বেগকে নিজের একটি গল্পের বই উৎসর্গ করেছেন, রাতে আড্ডা শেষে যিনি আমাকে একা বাসায় ফিরতে দিতেন না, নিজহাতে টেবিলে খাবার সাজাতেন, নিজহাতে আমার বিছানা করেছেন, মশারি টানিয়েছেন, জগভর্তি পানি ও গ্লাস এনে শিয়রে রেখেছেন, যে হুমায়ূনের সঙ্গে আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের কটা দিন কেটেছে, হাতের এত কাছে পেয়েও তাঁকে যদি দেখতে না পাই।
পত্রিকায় তাঁর স্বাস্থ্য বুলেটিন একটাও বাদ দিই না। দ্বিতীয় কেমো নেওয়ার পর একদিন হঠাৎ করেই আমার টেলিফোন রিসিভার আমাকেই হতবাক করে দিল। ওই দিনই সন্ধ্যা ছয়টায় আমি হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে পারব। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে সাবওয়ের ট্রেনগুলোর সংখ্যা কম থাকে, আসে-যায়ও আয়েশিভাবে। তিনটি ট্রেন বদলিয়ে যেতে হবে নিউইয়র্কে হুমায়ূন আহমেদের বর্তমান নিবাসে। ট্রেন থেকে নেমে কয়েক মিনিটের পথ। পথে নামতেই হার্ট অ্যাটাকে বিপর্যস্থ, ভগ্নস্বাস্থ্য; কেমোথেরাপি নেওয়া, চুল পড়া, কঙ্কালসার হুমায়ূনের মুখের অস্থি-কোঠরের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়া রক্তাক্ত দুটি চোখ ভূতের মতো আমার ওপর আছর করে বসল। এখনো অদেখা ওই ভয়ংকর দৃশ্য আমি কিছুতেই মাথা থেকে নামাতে পারি না। একসময় বাড়ি খুঁজে পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলাম। ঢুকতেই রান্নাঘর, হুমায়ূনের নিকট আত্মীয়া জলি রান্না করছিল। ওই সময় চুলো ছেড়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। বললাম, আমি যে খালি হাতে এলাম। ছুটির দিন, আমাদের ওদিকে বড় দোকানগুলো বন্ধ। এদিকে এসে দেখলাম, কোথাও বড় দোকান নেই। কোনো কিছু চাইবা মাত্র ১০টা এসে পড়ে। বললাম, অন্তত ফুল তো আনতে পারতাম। ‘ওটা আপনি সবচেয়ে ভালো করেছেন, ডাক্তারের হুকুম, ফুল তাঁর ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারবে না।’ ওদিকে বুকের ভেতর টিপটিপ করছে, একটু পরেই তো বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত ক্যানসার রোগী বেরিয়ে আসবেন—একটা জীবন্ত কঙ্কাল, ভাঙা স্বরে, ক্যানক্যানে গলা, বিস্মিত চোখে মৃত্যুভয়—ভাবতে চাইলাম না। জলিকে জিজ্ঞাসা করতেও জোর পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ জলির গলার স্বরের কথা মনে এল, তার গলায় তো আতঙ্ক নেই। মনে একটু জোর পেলাম। হুমায়ূনের বড় ছেলে তিন পেরোনো নিষাদ জলির কাছে এসে আমাকে শান্ত মনে দেখে গেল। ছোট ভাই বছর পেরোনো নিনাতও বেডরুম থেকে বেরিয়ে এল তার গাড়ি হাতে নিয়ে। বড় শান্ত দুটি ছেলে। নিজেদের নিয়ে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ল। জলির রান্না শেষ হয়ে এসেছিল। একেবারেই তাজা আমেরিকান রুইয়ের দেশি রান্না। স্বাদ না হলে ভাই খাবেন না, জলি বলল। তাজা নয় বলে দেশি মাছ খান না। একেক দিন একেক জিনিস খেতে চান—ভুনা গরুর গোশত, কালিজিরা ভর্তা, কচুর লতি, চিংড়ি মাছ। কম খান কিন্তু খাওয়া উপভোগ করেন। মনের আনন্দে ভাইকে নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াতে জলির রয়েছে মহা সুবিধা। তার সংগীতশিল্পী স্বামী আবেদিন স্বল্প নোটিশে বাঘের চোখও জোগাড় করে ফেলতে পারে। একসময় জলি সন্তর্পণে বেডরুমে যায়। ফিরে এসে বলল, ভাই, এখনই আসবেন। হুমায়ূনের দর্শন-ধাক্কা সামাল দিতে চোয়াল শক্ত করে বসলাম। কয়েক মুহূর্ত পর হুমায়ূন এলেন। এ কি হুমায়ূন! না কোনো অভিনেতা প্যান্ট-শার্ট পরা, ছোট কালো চুল, বয়স না বাড়া, আত্মসম্মানে আত্মস্থিত চিরকালের হুমায়ূন। শরীরে বা চেহারায় হার্ট অ্যাটাক বা ক্যানসারের যাতনার কোনো চিহ্ন নেই। সেই অতি পরিচিত সংযত হাসি, একাগ্র সম্বোধন। মুহূর্তে ফিরে গেলাম এক যুগ আগে তাঁর ধানমন্ডির বাসায় কিংবা অন্য কোনো বন্ধুর বাসার আড্ডায়। হুমায়ূনও ক্লিক করে তাঁর স্মৃতিতে আমার ফাইল খুললেন। কেমন আছি, কী করছি-জাতীয় কথার ফাঁকেই জলিকে নির্দেশ দিলেন শাওনকে যেন টেলিফোনে জানায় বেলাল ভাই এসেছেন, সে যেন এখনই চলে আসে। বললাম, আপনি আসার পর থেকেই আপনাকে একনজর দেখার জন্য খুব অধীর ছিলাম কিন্তু আপনার নিষেধ থাকায় ওই চেষ্টা থেকে বিরত থাকি। হুমায়ূন বললেন, শুরুর দিকে শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছিল না। শরীরে জুড়ে দেওয়া বিতিকিচ্ছি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দিনরাত ওষুধ ঢুকছে, তার ওপর লোকজনের ভিড় বিরক্তিকরই লাগছিল। লোকজনে আমার কখনো আপত্তি নেই। কিন্তু ওরা এসে এমন আচরণ ও কথাবার্তা বলতে থাকে, যেন এটাই আমাকে তাদের শেষ দেখা। রোজ রোজ মৃত্যুর কথা শুনতে কি ভালো লাগে? দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন হুমায়ূন। মৃত্যুর প্রসঙ্গ আমি বহু আগেই ভেবে শেষ করে রেখেছি। মৃত্যুচিন্তা আমার মাথায়ই আসে না, অথচ প্রতিদিন কেউ না কেউ এসে আমাকে মরার কথা একবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। আমাদের চা খাওয়ার সময় আরও একবার শাওন আসতে দেরি কেন করছে জানতে চাইলেন। আমি ভেবে বের করার চেষ্টা করছিলাম, আমার সঙ্গে শাওনের দেখা হওয়াটাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছিলেন কেন হুমায়ূন। তবে কি শাওনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার দিনগুলোর কোনো ঘটনার কোনো তথ্যের শূন্যস্থান পূরণ? চা তখনো শেষ হয়নি, একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মহিলা দক্ষিণের কোনো স্টেটে পড়ুয়া তাঁর বেশ সপ্রতিভ ও সুন্দর মেয়েটিকে নিয়ে সরাসরি ঘরে ঢুকে গেলেন। মা বললেন, মেয়েটি কালই চলে যাবে, তার আকুল আগ্রহের কারণেই এই হুট করে আসা। স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ের সঙ্গে হুমায়ূন মেয়েটির সঙ্গে আলাপ শুরু করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা গেল, মেয়েটির সংগ্রহে হুমায়ূন আহমেদের সব বই আছে। সে তাঁর সঙ্গে একটি ছবি না তুলে নিউইয়র্ক থেকে যাবে না। ছবি তুলতে তুলতেই শাওন এসে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই হুমায়ূন বললেন, বেলাল ভাইকে স্কুলের ছবিগুলো দেখাও। এবার আমার বিস্ময়ের পালা। স্কুল কখন তৈরি হয়েছে, কখন চালু হয়েছে আমি কিছুই জানি না। হুমায়ূন স্কুলের একটা নাতিদীর্ঘ ইতিহাস তুলে ধরলেন। কেমন করে এটি তিলে তিলে তৈরি হয়েছে, কেমন করে একটি একটি করে ক্লাস বেড়ে দশম শ্রেণী পর্যন্ত হয়েছে। সবচেয়ে আনন্দ লাগল পড়াশোনার ক্ষেত্রে স্কুলটির সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে দেখে। হুমায়ূন নিজেই বললেন, ওই স্কুলটি ইতিমধ্যেই শিক্ষামোদীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শাওন ল্যাপটপে অনেক খোঁজাখুঁজি করে স্কুলের বিল্ডিং থেকে আরম্ভ করে ক্লাসরুম, মাঠে ছাত্রছাত্রীদের অ্যাসেম্বলি ইত্যাদি বহু ছবি দেখাল আমার ছানাবড়া চোখ ও হাঁ করা মুখের ওপর। স্কুল ভবনটি দেখে আমি মুগ্ধ ও যারপরনাই বিস্মিত হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, এটার স্থপতি কে? শাওন একগাল হেসে বলল, আপনি কি জানতেন না আমি একজন স্থপতি?
নিজে ব্যর্থ হওয়ায় আমি স্কুলটিকে মন থেকে মুছেই ফেলেছিলাম। কিন্তু হুমায়ূন মোছেননি। স্কুলটি একটি অসাধারণ প্রেমের গল্প, এটা মোছা যায় না। একাত্তরে শহীদ স্বামীর স্মৃতি চিরজাগরুক রাখার জন্য একজন নারী তাঁর সন্তানকে অনুরোধ করেন। ওই সন্তান একাত্তরকে আরও অনেক তীব্রভাবে দেখেছেন। মাকে মুখের ওপর বলেছিলেন, ‘একাত্তরে আমার বাবা একা শহীদ হননি। দেশের বহু মানুষ শহীদ হয়েছেন। একজনের নয়, সব শহীদের স্মৃতি রাখতে হবে।’ শহীদ স্মৃতি বিদ্যায়তনের কৃতিত্ব ও গৌরবের মধ্য দিয়ে বাংলার একজন নারী তাঁর স্বামীকে এবং সেই সঙ্গে ৩০ লাখ শহীদকে মৃত্যুঞ্জয়ী করতে চান। শহীদ স্মৃতি বিদ্যায়তন বাঙালি জাতির গৌরব ও অহংকারের একটি মহীরুহ হোক।
আমি একজন ক্যানসার রোগী দেখতে এসেছিলাম। তাঁর দেখা পেলাম না। তবে সৌভাগ্যবশত দেখা হয়ে গেল আমাদের কালে অবিরাম সৃষ্টিশীল, জীবনে জীবন যোগ করার মহান কারিগর হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে। বিদায়ের সময় শেষ চমকও দিলেন হুমায়ূন। বললেন, স্কুল যাঁরা গড়ে তুলেছেন, তাঁদের নাম খচিত করা হয়েছে একটি স্মরণ বোর্ডে। সবার ওপরের নামটি বেলাল বেগ। মানুষকে এত সম্মান যিনি দিতে পারেন, পৃথিবীর রোগ-শোক-জরা-মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। হুমায়ূন আছেন এবং থাকবেন।
You can follow us on Twitter or join our Facebook fanpage to keep yourself updated on all the latest from Bangla Literature.
Download Bangla books in pdf form mediafire.com and also read it online. Read it from iPad, iPhone. Humayun-Achhen-Humayuner-Motoi-Belal-Beg, bangla ebooks, free download , mediafire , humayun ahmed , zafar iqbal , sunil gangopadhaya , suchitra , bengali ebooks, free bangla books online, ebooks bangla, bangla pdf, bangla books, boi, bangla boi, amarboi.
Download Bangla books in pdf form mediafire.com and also read it online. Read it from iPad, iPhone. Humayun-Achhen-Humayuner-Motoi-Belal-Beg, bangla ebooks, free download , mediafire , humayun ahmed , zafar iqbal , sunil gangopadhaya , suchitra , bengali ebooks, free bangla books online, ebooks bangla, bangla pdf, bangla books, boi, bangla boi, amarboi.
1 Comments