চিলেকোঠার সেপাই
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
১৯৬৯ সালের পূর্ব বাংলা। কী এক জীবনস্পর্ধী মন্ত্রের মুখে বিস্ফোরিত চারদিক। কেঁপে ওঠে নগর ঢাকা। কাঁপে শহর, বন্দর, গঞ্জ, নিভৃত গ্রাম, এমনকি যমুনার দুর্গম চর এলাকা। কখনো কঠিন বুলেটের আঘাতে, কখনো ঘুম-ভেঙ্গে-দেওয়া আঁধির ঝাপটায়। মিটিং আর মিছিল আর গুলিবর্ষণ আর কারফ্যু-ভাঙ্গা আর গণআদালত - সব জায়গায় ফেটে পড়ে ক্ষোভ ও বিদ্রোহ। সব মানুষেরই হৃদয়ের অভিষেক ঘটে একটি অবিচল লক্ষ্যে - মুক্তি। মুক্তি? তার আসার পথও যে একরকম নয়। কারো স্লোগান, ‘দিকে দিকে আগুন জ্বালো’, কারো ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’।
আরোপ করা সামরিক শাসনের নির্যাতন শুরু হলে বন্ধুরা যখন বিহ্বল, ওসমানের ডানায় তখন লাগে প্রবল বেগ। সহনামী কিশোরকে সে চুম্বনে রক্তাক্ত করে, বিকৃত যৌনতার বশে নয়, আত্মপ্রেমে পরাজিত হয়ে। ওসমান ‘একজন’।
সে এক নার্সিসাস। কিন্তু এখানে তার শেষ নয়। নিজের খাঁচা থেকে বেরুবার জন্য তার ডানা ঝাপটানো পরিণত হয় প্রচন্ড ক্রোধে। রঞ্জুকে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেওয়ার জন্য সে প্রানান্ত উদ্যোগ নেয়। এ কি তার আত্মপ্রেম বিসর্জনের প্রস্তুতি? পরিচিত সবাই ওসমানকে চিহ্নিত করে বদ্ধ পাগল হিসেবে। অনুরাগী বন্ধুরা তাকে বন্দী করে রাখে নিজের ঘরে। এখন এই বিচ্ছিন্ন ঘর থেকে ওসমানকে উদ্ধার করতে পারে কে? এক-নেতায় বিশ্বাসী আলাউদ্দিন? ভোটের রাইট-প্রার্থী আলতাফ? রাজনীতি-বিশ্লেষক বামপন্থী আনোয়ার? - না এরা কেউ নয়। চিলেকোঠার দুর্গ থেকে ওসমানকে বেরিয়ে পড়তে প্ররোচনা দে হাড্ডি খিজির যে নিজের বাপের নাম জানে না, যে বড় হয়েছে রাস্তায় রাস্তায়, যার মা বৌ দুজনেই মহাজনের ভোগ্য এবং গণঅভ্যুত্থানের সদস্য হওয়ার অপরাধে মধ্যরাতে কারফ্যু-চাপা রাস্তায় যে প্রাণদন্ডে দন্ডিত হয় মিলিটারির হাতে। নিহত খিজিরের আমন্ত্রণে ও আহ্বানে সক্রিয় সাড়া দিয়ে ওসমান ঘরের তালা ভাঙে। সবার অগোচরে সে বেরিয়ে আসে রাস্তায়, কারফ্যুর দাপট অগ্রাহ্য করে। তার সামনে এখন অজস্র পথ। পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ - সব দিক তার খোলা। ওসমান যেদিকেই পা বাড়ায় সেদিকেই পূর্ব বাঙলা।