সাবিত্রী উপখ্যান - হাসান আজিজুল হক
ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
হাসান আজিজুল হকের সম্প্রতি প্রকাশিত উপন্যাস সাবিত্রী উপাখ্যান এমনই অসহ্য কিন্তু নাছোড় এক কাহিনি, যা পড়তে পড়তে মনে হয়, স্নায়ু ছিঁড়ে যাচ্ছে। লেখকের বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু উপন্যাস লিখেছেন মোটে দুইখানা। প্রথমটা আগুনপাখি, লিখেছেন ত্রিকালদর্শী এক বৃদ্ধার প্রত্যক্ষ জবানে। ওইটাতে গল্প বলার ভার তাঁকে বইতে হয়নি। কিন্তু সাবিত্রী দেবীর আখ্যান তিনি রচেছেন নিজের বয়ানে, লেখক হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করে। সাবিত্রী যখন বুড়ি হয়ে গেছেন, পুরোনো দিনের কথাগুলো আর স্মরণ করতে পারছেন না, তখন লেখক নিজেই সে দায়িত্ব নিচ্ছেন; গল্প শুরু করার খানিক পরই আটকে গিয়ে বলছেন, ‘ঠিক আছে। বুড়ি মনে করতে পারছেন না। আমি পরিষ্কার করে বলছি। আমি লেখক। আমি সর্বজ্ঞ। বাইরে যা ঘটেছিল তা জানি, আর মনের ওপরে, মাঝখানে, তলায় যা যা ঘটেছিল তা-ও জানি। আমি বলছি ও শুধু ঘোলা-ময়লা চোখ দুটো মেলে জানতে চায়, এখন চাঁদের সময় না আঁধারের সময়। কেন জানতে চায় তা সে একটুও ভাবে না। অথচ কারণটা কোথাও আছে, নিশ্চয় আছে। খুঁজে পাওয়া যায় না।’
লেখকের বয়ান থেকে আমরা কারণটা খুঁজে পাই—এক অসম্ভব চাঁদনী রাতে সাবিত্রী দেবীর জীবনে সর্বনাশ নেমেছিল। সর্বনাশ মানে সম্পূর্ণ সর্বনাশ, তার সারাটি জীবন ধরে কেবলই সর্বনাশের পুনরাবৃত্তি। এক নারী কতবার কতজনের দ্বারা কত দিন ধরে একের পর এক ধর্ষিত হলে সে কাহিনি অবিশ্বাস্য বলে মনে হতে পারে? বিশ শতকের অবিভক্ত বাংলায় এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে, তারপর আরও এক গ্রামে, তারপর আরও আরও গ্রামে, হিন্দু-মুসলমান, যুবা-প্রৌঢ় যেন এককাট্টা হয়ে নির্বিচারে উপর্যুপরি সাবিত্রী নামের একরত্তি মেয়েকে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কেবলই ধর্ষণ করে চলে। লেখকের বয়ানে সেসব ছবি এমন জ্যান্ত হয়ে ওঠে যে তা সহ্য করা যায় না; অসম্ভব, অবিশ্বাস্য ভেবেও চোখের সামনেই তা দেখতে দেখতে মনে হয় স্নায়ুতন্ত্রের ওপর দিয়ে বুলডোজার চলে যাচ্ছে।
একদম প্রথমে একসঙ্গে তিন পুরুষের কবলে পড়ে সাবিত্রী। তাদের পাশবিকতার বর্ণনা করছেন লেখক, ‘দুর্গাপদ হাত বাড়িয়ে সাবিত্রীকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বালির ওপর শুয়ে পড়ল। বটা, হাত দুটো চেপে ধর। সবুর, তুই ধর পা দুটো। আগে ধর তো, তারপর দেখছি।...সাবিত্রী এখন শুধুই মাথা নাড়তে পারে, মাথার পেছনটা ঠুকতে পারে বালির ওপর আর একটানা না না, আমার সব্বোনাশ কোরো না কোরো না। ভীষণ বিরক্ত দুর্গাদাস বটার দিকে চেয়ে বলল, মুখটা চেপে ধরতে পারছিস না! দুই হাতের ওপর বোস, মুখটা চেপে ধর! খুব ধীরে ধীরে কাজ এগোতে লাগল। দুর্গাপদ সাবিত্রীকে ভালো করে শুইয়ে দিচ্ছে। তারপর নাভির ওপর ধীরে ধীরে চেপে বসছে, সবুর আস্তে আস্তে পা দুটো হাঁটু অবধি গুটিয়ে দিচ্ছে, শাড়িটা এতক্ষণে বাতাসে উড়ে গিয়ে একটা মাটির ঢিবিতে আটকে রক্ত-পতাকার মতো পতপত করে উড়ছে। দুর্গাপদ সযত্নে শুয়ে পড়ল সাবিত্রীর ওপর। ইস্পাতের একটা বল্লম স্বচ্ছ আচ্ছাদনটুকু ছিঁড়ে মাখনের শেষ মাথায় গিয়ে পৌঁছাল। সাবিত্রী আর একবার মাত্র চিৎকার করে উঠল। পৃথিবীতে বিশুদ্ধ, সংক্ষিপ্ত মৃত্যু-চিৎকার একটাই।’
সাধারণত গল্প-উপন্যাসের চূড়ান্ত মুহূর্ত বা ক্লাইমেক্স হয় এ রকম। এরপর আর বিশেষ কিছু থাকে না। পাঠকেরও আর ধৈর্য থাকে না এরপর। কিন্তু হাসান আজিজুল হকের সাবিত্রী উপাখ্যান-এর এ কেবল শুরু। পুরো আখ্যানটিই আসলে সাবিত্রীর এমন অকহতব্য নিগ্রহের বিবরণ। সেই বিবরণে উঠে এসেছে বিচিত্র সব ব্যক্তিচরিত্র, তিনের দশকের সমাজ-চরিত্র, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের চিত্রও বাদ যায়নি। আসলে, কেবল একজন নারীর সীমাহীন নিগ্রহের আখ্যান এটি নয়, সমাজেরও চিত্র বটে। লেখকের সঙ্গে আলাপ থেকে জেনেছি, ১৯৩৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে এ রকম একটি চাঞ্চল্যকর ধর্ষণ-মামলার খবর ও নথিপত্র অবলম্বন করে তিনি রচনা করেছেন এই উপন্যাস। এই লেখায় তিনি সে মামলার কিছু নথিপত্র ব্যবহারও করেছেন। কিন্তু সেটা কাহিনির কঙ্কাল মাত্র। সেই কঙ্কালের গায়ে তিনি যে মেদ-মাংস জুড়েছেন, তা কেবল একজন দক্ষ কথাশিল্পীর হাতেই সম্ভব। শিল্পীর হাত বলেই এ কাহিনি নিছক একটা ফৌজদারি কেস স্টাডি বা সমাজ-গবেষণার প্রতিবেদন না হয়ে হয়েছে অপূর্ব এক সাহিত্যকর্ম।
কিন্তু এই সাহিত্যকর্মের আঘাত করার ক্ষমতা এমনই মারাত্মক যে সে আঘাত সহ্য করা প্রায় অসম্ভব বলে বোধ হয়। সাবিত্রীর নিগ্রহ-নিপীড়নের বর্ণনা দিতে দিতে একটা পর্যায়ে এমনকি খোদ লেখককেও ক্লান্ত হয়ে পড়তে দেখি। শেষের দিকে লেখক বলছেন, ‘না, এ গল্প আর চালানো যাচ্ছে না, কেবলই বেঁকে যাচ্ছে অক্ষর।’
হাসান আজিজুল হক একবার প্রশ্ন তুলেছিলেন, সাহিত্য সমালোচনা কি আদৌ সম্ভব? আমার মনে হয়, না, সম্ভব নয়। যা সম্ভব বলে মনে হয়, তা হলো পাঠের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা এবং সেটা একান্তই ব্যক্তিগত বিচার, সর্বজনীন কিছু নয়। তাঁর সাবিত্রী উপাখ্যান পড়ে আমার প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক। আমি রীতিমতো ধরাশায়ী বোধ করেছি। আর মনে হয়েছে, তিনি এই অসহ্য উপাখ্যান রচনা করেছেন বাংলাভাষী সাহিত্য-পাঠকের মানসিক সুস্থতা ও স্নায়বিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে।
উপরের আলোচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয়ে দৈনিক প্রথম আলোতে।
Download Now
ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
হাসান আজিজুল হকের সম্প্রতি প্রকাশিত উপন্যাস সাবিত্রী উপাখ্যান এমনই অসহ্য কিন্তু নাছোড় এক কাহিনি, যা পড়তে পড়তে মনে হয়, স্নায়ু ছিঁড়ে যাচ্ছে। লেখকের বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু উপন্যাস লিখেছেন মোটে দুইখানা। প্রথমটা আগুনপাখি, লিখেছেন ত্রিকালদর্শী এক বৃদ্ধার প্রত্যক্ষ জবানে। ওইটাতে গল্প বলার ভার তাঁকে বইতে হয়নি। কিন্তু সাবিত্রী দেবীর আখ্যান তিনি রচেছেন নিজের বয়ানে, লেখক হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করে। সাবিত্রী যখন বুড়ি হয়ে গেছেন, পুরোনো দিনের কথাগুলো আর স্মরণ করতে পারছেন না, তখন লেখক নিজেই সে দায়িত্ব নিচ্ছেন; গল্প শুরু করার খানিক পরই আটকে গিয়ে বলছেন, ‘ঠিক আছে। বুড়ি মনে করতে পারছেন না। আমি পরিষ্কার করে বলছি। আমি লেখক। আমি সর্বজ্ঞ। বাইরে যা ঘটেছিল তা জানি, আর মনের ওপরে, মাঝখানে, তলায় যা যা ঘটেছিল তা-ও জানি। আমি বলছি ও শুধু ঘোলা-ময়লা চোখ দুটো মেলে জানতে চায়, এখন চাঁদের সময় না আঁধারের সময়। কেন জানতে চায় তা সে একটুও ভাবে না। অথচ কারণটা কোথাও আছে, নিশ্চয় আছে। খুঁজে পাওয়া যায় না।’
লেখকের বয়ান থেকে আমরা কারণটা খুঁজে পাই—এক অসম্ভব চাঁদনী রাতে সাবিত্রী দেবীর জীবনে সর্বনাশ নেমেছিল। সর্বনাশ মানে সম্পূর্ণ সর্বনাশ, তার সারাটি জীবন ধরে কেবলই সর্বনাশের পুনরাবৃত্তি। এক নারী কতবার কতজনের দ্বারা কত দিন ধরে একের পর এক ধর্ষিত হলে সে কাহিনি অবিশ্বাস্য বলে মনে হতে পারে? বিশ শতকের অবিভক্ত বাংলায় এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে, তারপর আরও এক গ্রামে, তারপর আরও আরও গ্রামে, হিন্দু-মুসলমান, যুবা-প্রৌঢ় যেন এককাট্টা হয়ে নির্বিচারে উপর্যুপরি সাবিত্রী নামের একরত্তি মেয়েকে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কেবলই ধর্ষণ করে চলে। লেখকের বয়ানে সেসব ছবি এমন জ্যান্ত হয়ে ওঠে যে তা সহ্য করা যায় না; অসম্ভব, অবিশ্বাস্য ভেবেও চোখের সামনেই তা দেখতে দেখতে মনে হয় স্নায়ুতন্ত্রের ওপর দিয়ে বুলডোজার চলে যাচ্ছে।
একদম প্রথমে একসঙ্গে তিন পুরুষের কবলে পড়ে সাবিত্রী। তাদের পাশবিকতার বর্ণনা করছেন লেখক, ‘দুর্গাপদ হাত বাড়িয়ে সাবিত্রীকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বালির ওপর শুয়ে পড়ল। বটা, হাত দুটো চেপে ধর। সবুর, তুই ধর পা দুটো। আগে ধর তো, তারপর দেখছি।...সাবিত্রী এখন শুধুই মাথা নাড়তে পারে, মাথার পেছনটা ঠুকতে পারে বালির ওপর আর একটানা না না, আমার সব্বোনাশ কোরো না কোরো না। ভীষণ বিরক্ত দুর্গাদাস বটার দিকে চেয়ে বলল, মুখটা চেপে ধরতে পারছিস না! দুই হাতের ওপর বোস, মুখটা চেপে ধর! খুব ধীরে ধীরে কাজ এগোতে লাগল। দুর্গাপদ সাবিত্রীকে ভালো করে শুইয়ে দিচ্ছে। তারপর নাভির ওপর ধীরে ধীরে চেপে বসছে, সবুর আস্তে আস্তে পা দুটো হাঁটু অবধি গুটিয়ে দিচ্ছে, শাড়িটা এতক্ষণে বাতাসে উড়ে গিয়ে একটা মাটির ঢিবিতে আটকে রক্ত-পতাকার মতো পতপত করে উড়ছে। দুর্গাপদ সযত্নে শুয়ে পড়ল সাবিত্রীর ওপর। ইস্পাতের একটা বল্লম স্বচ্ছ আচ্ছাদনটুকু ছিঁড়ে মাখনের শেষ মাথায় গিয়ে পৌঁছাল। সাবিত্রী আর একবার মাত্র চিৎকার করে উঠল। পৃথিবীতে বিশুদ্ধ, সংক্ষিপ্ত মৃত্যু-চিৎকার একটাই।’
সাধারণত গল্প-উপন্যাসের চূড়ান্ত মুহূর্ত বা ক্লাইমেক্স হয় এ রকম। এরপর আর বিশেষ কিছু থাকে না। পাঠকেরও আর ধৈর্য থাকে না এরপর। কিন্তু হাসান আজিজুল হকের সাবিত্রী উপাখ্যান-এর এ কেবল শুরু। পুরো আখ্যানটিই আসলে সাবিত্রীর এমন অকহতব্য নিগ্রহের বিবরণ। সেই বিবরণে উঠে এসেছে বিচিত্র সব ব্যক্তিচরিত্র, তিনের দশকের সমাজ-চরিত্র, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের চিত্রও বাদ যায়নি। আসলে, কেবল একজন নারীর সীমাহীন নিগ্রহের আখ্যান এটি নয়, সমাজেরও চিত্র বটে। লেখকের সঙ্গে আলাপ থেকে জেনেছি, ১৯৩৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে এ রকম একটি চাঞ্চল্যকর ধর্ষণ-মামলার খবর ও নথিপত্র অবলম্বন করে তিনি রচনা করেছেন এই উপন্যাস। এই লেখায় তিনি সে মামলার কিছু নথিপত্র ব্যবহারও করেছেন। কিন্তু সেটা কাহিনির কঙ্কাল মাত্র। সেই কঙ্কালের গায়ে তিনি যে মেদ-মাংস জুড়েছেন, তা কেবল একজন দক্ষ কথাশিল্পীর হাতেই সম্ভব। শিল্পীর হাত বলেই এ কাহিনি নিছক একটা ফৌজদারি কেস স্টাডি বা সমাজ-গবেষণার প্রতিবেদন না হয়ে হয়েছে অপূর্ব এক সাহিত্যকর্ম।
কিন্তু এই সাহিত্যকর্মের আঘাত করার ক্ষমতা এমনই মারাত্মক যে সে আঘাত সহ্য করা প্রায় অসম্ভব বলে বোধ হয়। সাবিত্রীর নিগ্রহ-নিপীড়নের বর্ণনা দিতে দিতে একটা পর্যায়ে এমনকি খোদ লেখককেও ক্লান্ত হয়ে পড়তে দেখি। শেষের দিকে লেখক বলছেন, ‘না, এ গল্প আর চালানো যাচ্ছে না, কেবলই বেঁকে যাচ্ছে অক্ষর।’
হাসান আজিজুল হক একবার প্রশ্ন তুলেছিলেন, সাহিত্য সমালোচনা কি আদৌ সম্ভব? আমার মনে হয়, না, সম্ভব নয়। যা সম্ভব বলে মনে হয়, তা হলো পাঠের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা এবং সেটা একান্তই ব্যক্তিগত বিচার, সর্বজনীন কিছু নয়। তাঁর সাবিত্রী উপাখ্যান পড়ে আমার প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক। আমি রীতিমতো ধরাশায়ী বোধ করেছি। আর মনে হয়েছে, তিনি এই অসহ্য উপাখ্যান রচনা করেছেন বাংলাভাষী সাহিত্য-পাঠকের মানসিক সুস্থতা ও স্নায়বিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে।
উপরের আলোচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয়ে দৈনিক প্রথম আলোতে।
Download Now