সুনীল বড় লেখক ছিলেন, মানুষ হিসেবে মোটে নয় - তসলিমা নাসরিন

 যে কোনও মৃত্যুই খুব বেদনার৷ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবর শুনে গত কাল আমি চমকেছি , বেদনাবোধ করেছি৷ বার বার ভেবেছি , কত লোক খামোকাই বেঁচে আছে , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আরও কিছু বছর বেঁচে থাকলেই পারতেন , লিখতে পারতেন আরও কিছু লেখা৷ আজকাল আটাত্তর বা ঊনআশি বছর বয়সকে মৃত্যুর উপযুক্ত বয়স বলে মনে হয় না৷ দীর্ঘকাল চলত্শক্তিহীন অবস্থায় বিছানায় পড়ে না থাকলে , মাথা সম্পূর্ণ অকেজো না হয়ে গেলে , বয়স নব্বইয়ের ওপর না উঠলে মৃত্যুকে মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হয়৷


প্রায় অর্ধেক দিন টেলিভিশন খোলা ছিল৷ টেলিভিশনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শেষ দিককার কিছু ছবি দেখে অবাক হয়েছি৷ তাঁর স্বাস্থ্য যে এত ভেঙে পড়েছিল , আমার জানা ছিল না৷ বড়ই রুগ্ন এবং অসুস্থ দেখাচ্ছিল৷ জানি না কোনও কঠিন অসুখে ভুগছিলেন কি না৷ অবাক হয়েছি আরও একটি কারণে৷ শিল্পী -সাহিত্যিকদের মধ্যে দু’একজন , যাঁদের আমি ব্যক্তিগত ভাবে জানি ভীষণ নিন্দা করেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের , তাঁরা ভূয়সী প্রশংসা করছিলেন৷ প্রকাশ্যে মনের কথা বলার লোক এত কমে যাচ্ছে চারদিকে৷


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা -গল্প -উপন্যাস -নিবন্ধ পড়ছি সেই কিশোর -বয়স থেকে৷ তাঁর খুব কম লেখাই আছে , যে গুলোকে ‘যাচ্ছেতাই ’ বা ‘কিচ্ছু হয়নি ’ বলে নাকচ করে দিয়েছি৷ তাঁর যে জিনিসটা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত , তা হল নাস্তিকতা নিয়ে তাঁর লুকোছাপা না করা৷ ধর্মনিরপেক্ষতা , দেশভাগ , মুক্তিযুদ্ধ, হিন্দু-মুসলমান , বাংলা এবং বাঙালি , নাস্তিক্যবাদ , অস্তিত্ববাদ ইত্যাদি নিয়ে তাঁর যে মত ছিল , তা একেবারেই আমার মত৷ এত মতের মিল যাঁর সঙ্গে , তাঁর সঙ্গে বিরোধ কেন ! অবশ্য বিরোধটা আমার দিক থেকে কখনও ছিল না৷ তিনিই গোপনে গোপনে আমার পায়ের তলার মাটি সরাতে চেষ্টা করছিলেন৷ কেন করছিলেন , কী প্রয়োজন ছিল তাঁর , আজও জানি না৷


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে চিনি বাংলাদেশ থেকেই৷ আশির দশকের শেষ দিকে পরিচয়৷ বাংলাদেশে দেখা হত , কলকাতায় বেড়াতে এলেও দেখা হত৷ বাড়িতে নেমন্তন্ন করতেন৷ কবিতা এবং কলাম লিখে তখন আমার বেশ নাম হয়েছে দেশে৷ তার পর বিরানব্বইয়ের ‘আনন্দ পুরস্কার ’ পাওয়ার পর তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আবারও দেখা হল৷ অনেককে বলতেও শুনেছি , ‘সুনীলই তো তসলিমাকে আনন্দ পুরস্কার পাইয়ে দিয়েছে৷ ’ আমিও তাই ভেবেছিলাম৷ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেও এমন মন্তব্যের প্রতিবাদ করতে দেখিনি৷ বেশ কয়েক বছর পরে অবশ্য জেনেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাাধ্যায়ই ‘আনন্দ পুরস্কার ’ কমিটির দশ জন সদস্যের মধ্যে একমাত্র সদস্য যিনি ৷


আমার পুরস্কার পাওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন৷ শুধু বিরানব্বইয়ে নয় , দু’হাজার সালেও বিরোধিতা করেছেন , যখন দ্বিতীয়বার ‘আনন্দ পুরস্কার ’ পেয়েছি৷ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখে অবশ্য কখনও আমি বুঝতে পারিনি তিনি গোপনে গোপনে আমার বিরুদ্ধে কাজ করেন৷ বন্ধুর মতো , শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো , দাদার মতো , পিতার মতো তিনি পাশে ছিলেন বলেই বিশ্বাস করতাম৷ অবশ্য সব ভাবনার অবসান হল , যখন তিনি প্রকাশ্যে আমার ‘দ্বিখণ্ডিত ’ বইটি নিষিদ্ধ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবদার করলেন এবং বইটি শেষ অব্দি নিষিদ্ধ করিয়ে ছাড়লেন৷ একজন লেখকের জন্য এর চেয়ে ভয়ঙ্কর হূদয়বিদারক আর কী হতে পারে , যখন সে প্রত্যক্ষ করে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ লেখক তার বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গিয়ে , মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এই অজুহাতে তার বই নিষিদ্ধ করার জন্য রাজা -মন্ত্রীর কাছে দৌড়ায় ! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অবিশ্বাস্য বিরোধিতা সত্ত্বেও , কখনও দেখা হলে স্বভাবসুলভ সশ্রদ্ধ আন্তরিক ব্যবহারই ৷


যে গৃহহীন মানুষটা পশ্চিমবঙ্গকে ভালবেসে সব ছেড়েছুড়ে এসেছিল , তাকেই কি না তাড়িয়ে দেওয়ার ষ ..ডযন্ত্র ! রাজনীতিতে কত কাণ্ডই ঘটে! কিন্ত্ত তাই বলে সাহিত্যিকরা আচরণ করবেন রাজনীতিকের মতো !৷


করেছি৷ কখনও আমি ভুলে যাইনি তিনি আমার প্রিয় লেখক , কিশোর বয়স থেকে আমি তাঁর লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি , কখনও ভুলে যাইনি অন্য একশ বিষয়ে তাঁর মতের সঙ্গে মেলে আমার মত৷ নিজেকে বুঝিয়েছি৷ তিনি মুখে আমার লেখা ভীষণ পছন্দ করেন বললেও হয়তো সত্যিকার পছন্দ করতেন না , সেই কারণেই আমার পুরস্কার পাওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন৷ নিজেকে বুঝিয়েছি , মুক্ত চিন্তার পক্ষে বললেও তিনি হয়তো আমার লেখা পছন্দ করতেন না বলে আমার বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন , এই যাওয়ার অধিকার হয়তো তাঁর আছেই৷


কলকাতায় দু’হাজার চার সাল থেকে নিজের মতো বাস করতে শুরু করেছি সাহিত্যের গুরুকে গুরুপ্রণাম না করেই৷ তার পর আমার নিষিদ্ধ হওয়া ‘দ্বিখণ্ডিত ’কে হাইকোর্ট থেকে মুক্ত করিয়ে এনেছি৷ আমার স্পর্ধার ফল অবশ্য পেতে শুরু করেছি শীঘ্র৷ লক্ষ্য করলাম আমি প্রায় সবখানে ব্রাত্য৷ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বন্ধুরা , যারা এক সময় আমারও বন্ধু ছিল , আমাকে রীতিমত ত্যাজ্য করেছেন৷ ধীরে ধীরে কিছু পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা বন্ধ হয়ে গেল , কিছু প্রকাশক আমার বই প্রকাশও বন্ধ করে দিলেন৷ আমি অনেকটা একঘরে৷ এক সময় তো সরকার থেকে চাপ এল আমি যেন কলকাতা ছেড়ে চলে যাই৷ যে গৃহহীন মানুষটা পশ্চিমবঙ্গকে ভালোবেসে সব ছেড়েছুড়ে এসেছিল , তাকেই কি না তাড়িয়ে দেওয়ার ষ ..ডযন্ত্র ! ৷


রাজনীতিতে কত কাণ্ডই ঘটে! কিন্ত্ত তাই বলে সাহিত্যিকরা আচরণ করবেন রাজনীতিকের মতো ! যখন আমি পশ্চিমবঙ্গের মাটি কামড়ে পড়েছিলাম , বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছেন , পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায় আমাকে তাড়াবার নানা রকম আয়োজন করে হেরে যাচ্ছেন , তখন স্বয়ং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ফোন করে আমাকে বলেছেন রাজ্য ছাড়তে৷ বলেছেন , ‘‘আমাদের কাছে খবর আছে , তোমাকে মেরে ফেলার জন্য এক দল লোক তৈরি হচ্ছে , তুমি রাজ্য ছাড়ো ’’৷ ঠিক যেমন ‘দ্বিখণ্ডিত ’ নিষিদ্ধ করার জন্য ‘আজকাল ’ পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন , ‘‘আমাদের কাছে খবর আছে , এই বইয়ের জন্য দাঙ্গা বাধবে , তাই আমরা বই নিষিদ্ধ করেছি , স্ফুলিঙ্গকে বারুদের কাছে যেতে দিইনি ’’৷ শাসকের সুরে কথা বলতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়৷


এই সমাজ সাংঘাতিক নোংরা , পুরুষতান্ত্রিক বলে সুনীলকে ‘বড় মানুষ ’ আখ্যা দিয়ে গুণকীর্তন করে চাটুকাররা৷ যারা সুনীলের যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছে , তারা মুখ বুজে থাকলেও জানে এবং মানে যে সুনীল মানুষ হিসেবে বড় ছিলেন না৷ সে দিন কথা প্রসঙ্গে আমাকে এবং আরও মেয়েকে সুনীল যৌন হেনস্থা করেছেন , এ কথা বলার পর সুনীলকে দোষ দেওয়ার বদলে লোকেরা দোষ দিল আমাকে৷ ছি ছি করল আমাকে ! সুনীলও দিব্যি অস্বীকার করলেন খবর৷ যেমন অস্বীকার করেন আমার বই নিষিদ্ধ করার জন্য তিনি যে উঠে পড়ে লেগেছিলেন , সে সব ঐতিহাসিক ঘটনা৷ এত বড় লেখক কী নির্দ্বিধায় মিথ্যে বলেন ! আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই৷ আজ যদি কোনও সভ্য দেশে কোনও পুরুষ লেখকের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আসে , লোকেরা লেখককে , সে যত ব .ড লেখকই হোক না কেন , ছি ছি করবে৷ কিন্ত্ত এ দেশে উল্টো ! হবে না কেন , এখনও ধর্ষিতা হলে ধর্ষণের জন্য বেশির ভাগ লোক ধর্ষিতাকেই দোষী সাব্যস্ত করে৷ এ দেশের থেকে এর চেয়ে ভালো আশা করার কী -ই -বা আছে !যত শত্রুতাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় করুন না কেন , আমি নিজেকে তাঁর থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রেখেছিলাম , তাঁর শত্রুতা করিনি বা তাঁর পাকা ধানে মই দিইনি৷ আমি বিশ্বাস করি , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক৷ আমি হয়তো কাছ থেকে তাঁর চরিত্রের মন্দ দিকটা দেখেছি , বাইরের লোকদের তা দেখা সম্ভব হয় না বলে ভাল দিকটাই দেখেন৷ তাতে কী ? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা তাঁরা যেমন ভালোবাসেন , আমিও তেমন বাসি৷ এবং এ -ও জানি , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে যদি সামান্য কোনও সততা থেকে থাকে , তিনি নীরবে নিভৃতে আমার সততার কারণে আমাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করেছেন৷ তাঁর অজস্র চাটুকার ছিল৷ চাটুকাররা প্রতিদিন তাঁর কাছে ভিড় করত৷ ওদের ছাড়া সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রাত কাটেনি দিন কাটেনি , কিন্ত্ত ওদের তিনি খুব ভালোবাসতেন বা শ্রদ্ধা করতেন বলে আমার কখনও মনে হয়নি৷


Post a Comment