আলোর গন্ধ - স্মরণজিত চক্রবর্তী
স্মরণজিত্ চক্রবর্তীর ‘আলোর গন্ধ’ উপন্যাসটি পাঠক-সমাদৃত। সাম্প্রতিককালে তিনি অন্যতম বহুপঠিত লেখক। বঙ্গদেশে লেখক-লেখিকারা তাঁদের ‘উত্পাদিত পণ্য’ (অর্থাত্ সৃষ্টিশীল রচনা) সম্বন্ধে ঐতিহাসিকভাবে কতটা সচেতন, তা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। কোন পণ্যের উপভোক্তা কারা ও কেন, তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকলে পণ্যনির্মাতারই সুবিধে। একই সঙ্গে প্রকাশকদেরও লাভ, কারণ এ বিষয়ে বোঝাপড়া থাকলে, তাঁদের অবিক্রীত বইয়ের লোকসানের বোঝা টানতে হবে না। সবাই যে পাঠক নির্মাণ করবেন তা নয়, তবে বিশেষ শ্রেণির পাঠকের বেঁচে থাকার ছবিকে তুলে ধরতে পারলে, সেই উপভোগ্য দর্পণে পাঠকেরা ‘আপনার মুখ আপনি’ দেখতে চাইতে পারেন। উপভোক্তার মানচিত্র স্পষ্ট হলে পণ্যটি পরিবেশন করতে সুবিধে হয়। এর মধ্যে কিছু অগৌরব নেই। লেখক হিসেবে স্মরণজিত্ তাঁর রিডিং পাবলিকের গাঁই-গোত্র সম্বন্ধে সচেতন। এই সচেনতাই তাঁকে দিশাহীনতার হাতছানি থেকে দূরে রেখেছে। কাদের জন্য লিখব ও কী লিখব- এ নিয়ে স্মরণজিত্ কোনও টানাপড়েনে ভোগেন না।
নভেল- বাংলা ভাষায় এই শিল্পরূপটির আমদানি হয়েছিল পাশ্চাত্যের হাতফেরতা হয়ে। পরাধীন বঙ্গদেশে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় সাহিত্য-পড়ুয়া
যে-ভদ্রলোক শ্রেণির উদ্ভব, নভেল ছিল তাদের বিনোদনের সামগ্রী, দেশ ও সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার। অন্য অনেক কিছুর মতোই তার শরীরে মিশেছিল দেশজ প্রকরণের কারুকৃতি। সে সব উনিশ শতকের কথা। নভেলকে কী নামে ডাকা হবে- কথাগ্রন্থ, উপন্যাস, ক্ষুদ্রকথা নাকি বজায় রাখা হবে নভেল নামটাই, তাই নিয়ে নানা যুক্তির ওঠা-পড়া। শুধু নাম নয়, উঠল উত্পাদিত সাংস্কৃতিক পণ্যটির সৃজনের উদ্দেশ্য বিধেয়র প্রসঙ্গও। নভেল কেন লেখা হয়? বিনোদন বনাম দেশ নির্মাণ, সমাজ সংস্কার। বটতলার ‘দুই সতীনের ঝগড়া’ আর বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ রচনার উদ্দেশ্যে ভিন্ন। লেখকের অভিপ্রায় অবশ্য পাঠক মান্য করতে বাধ্য নন। বিষবৃক্ষ-র শেষে কথকের টিপ্পনী, বিষবৃক্ষ পড়ে ঘরে ঘরে অমৃত ফল ফলবে। অর্থাত্ পরকীয়ায় না মজে বাঙালি পুরুষ পত্নীনিষ্ঠ হয়ে সংসার প্রতিপালন করবেন। বঙ্কিমের উপন্যাস এই সাধু উদ্দেশ্যের প্রচারক হলেও পাঠক বঙ্কিমের লেখায় রূপমুগ্ধ। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্পের রায়বাহাদুর, যিনি নাকি বঙ্কিমের বন্ধু, তিনি মনে করেন বঙ্কিমের উপন্যাসে শুধু লাভ আর ওয়ার। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘অলীকবাবু’ নাটকের প্রেমে পাগল হেমাঙ্গিনী বঙ্কিম কোট করে। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরত্চন্দ্রের উপন্যাস পড়ে বাঙালি পাঠকদের মনে নাকি লাভ-ওয়ার্ম-এর প্রবেশ। সাহিত্য পত্রিকায় তাই নিয়ে ধারাবাহিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ‘সাহিত্যের স্বাস্থ্যরক্ষা’র সেই প্রয়াস নিয়ে পরশুরাম তাঁর গল্পে ফুট কাটেন। এই প্রতর্কে বঙ্কিমের অমৃত ফলের ঘোষণা পাকে পড়ে। পাঠকচক্রে ঋষি বঙ্কিমের মূর্তি ভেঙে যায়। তর্ক শুধু উনিশ শতকের নয়, বিশ শতকেও তা সমান সজীব। বামপন্থী, প্রগতিবাদী রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসীরা উপন্যাসের কাছ থেকে যা চাইতেন, বিশুদ্ধ শিল্পবাদীরা তা চাইতেন না। পরে উপন্যাস রচয়িতাদের মধ্যে আরও নানা খোপ-খাপ গড়ে ওঠে।
ভুবনায়ন বাঙালিদের মধ্যে ‘neo-bhadralok’ শ্রেণির জন্ম দিয়েছে। এঁদের বিনোদন-বাসনা অনিবার্য। স্মরণজিত্ উপন্যাস লেখেন সব পাঠকের জন্য। কিন্তু তাঁর মূল লক্ষ্য সিনেমাখোর, টিভি সিরিয়ালসেবী বাঙালি পাঠকদের বিনোদন প্রদান। তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যাঁরা বাংলা বই পড়তে চান না, তাঁদের জন্য স্মরণজিত্ তাঁর উপন্যাসের পরতে পরতে নানা উপকরণ সাজিয়ে রেখেছেন। এমনকী সদ্য কৈশোরোতীর্ণ উনিশ-কুড়ির ছেলেমেয়েরা তাঁর উপন্যাস পড়ুক, এ-ও তিনি আন্তরিকভাবে চান। অন্তত তাঁর উপন্যাসের চলন-বলনে সে কথাই মনে হয়। এ বিষয়ে স্মরণজিতের পারঙ্গমতা অনেক সদ্য প্রতিষ্ঠিত লেখককে ছাড়িয়ে গিয়েছে। পুরনো জাতীয়তাবাদ, সমাজসংস্কার, রাজনৈতিক প্রগতি, বিশুদ্ধ শিল্পচর্চা এসব তাঁর প্রকল্পের অন্তর্গতই নয়, হওয়ার কারণও নেই। প্রথমত, এই প্রকল্পগুলি তাঁদের সাবেকি চেহারায় অতীত। দ্বিতীয়ত, কোনও কোনও প্রকল্পের নবায়ন ঘটেছে। আবার ঘটলেই যে কাউকে তা অনুসরণ করতে হবে, তারও কোনও মানে নেই। একজন যেভাবে করেন, অন্যজন সেভাবে না-ই করতে পারেন।
স্মরণজিতের ‘আলোর গন্ধ’ সংলাপবহুল। পারিবারিকতা, কমবয়সি ছেলেমেয়েদের নিজস্ব জগত্, প্রেম ও প্রেমকে ঘিরে হালকা দার্শনিকতা এর শরীরে মিশে আছে। উপন্যাসের শুরুতে জোনাথনদাদু মানব সম্পর্কের স্বরূপ বোঝাতে গিয়ে সৌরমণ্ডলের কথা খেয়াল করিয়ে দেন, ‘অনেকটা পৃথিবী আর সূর্যের মতো। দু’জন দু’জনকে ছাড়া থাকতে পারে না, কিন্তু দেখ, কাছেও আসতে পারে না।’ সম্পর্কের এই টানাপড়েনের ‘ক্রাইসিস’ একরকমভাবে এই উপন্যাসে আছে। জোনাথনদাদুর বাড়িতে পাঁচজনের যে-দল (তিনটি মেয়ে আর দু’টি ছেলে, বয়স কুড়ি-একুশ, তারা একজনের খোঁজ করছে) ঢুকে পড়ে, তাদের মধ্যে ব্যাকুলমুখ মেয়েটিকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘আগে বলো তো তুমি সূর্য, না পৃথিবী?’
এই লেখাতে কলকাতার কথা উঠে এসেছে। কলকাতার হালের বাঙালিদের একশ্রেণির অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে লেখক লিখেছেন, ‘লোন নিয়ে গাড়ি আর বাড়ি বাঙালির অ্যান্টাসিড অ্যাডিকশনের চেয়েও সাংঘাতিক হয়েছে আজকাল। ছোট ছোট বুট জুতোর মতো দেখতে গাড়িগুলো পোকার মতো ঘুরে বেড়ায় শহরের রাস্তাঘাট দিয়ে।’
অর্থনীতির পালাবদলের ফলবাহী কলকাতার মধ্যে অবশ্য অন্য অর্থনৈতিক বাস্তবে বসবাসকারী মানুষজনেরাও আছেন। এই উপন্যাসের গুন্ডা ছেলেটির অবস্থা ভাল নয়, তবে পড়াশোনায় ভাল। চুটিয়ে টিউশনি করে। বলে, ‘আমার ফ্যামিলিতে ন’জন থাকে। মাস্টারবেট করার পর্যন্ত প্রাইভেসি পাই না। বাবার চটকল বন্ধ। দাদার কেরানিগিরি আর ঘুষের টাকায় বেঁচে থাকি।’ যাদবপুর কলোনির গুন্ডা বিশ্বায়িত কলকাতার সহপাঠীদের বলে, ‘ম্যানার্স মারাস না।’ তখন উত্তেজনায় তার শরীরে জলের মতো ঢেউ খেলছে। বোঝা যায়, সমকালকে বিশেষ ভাষায় রূপে বুনে দিতে পারেন বলেই স্মরণজিত্ নবীন পাঠকদের কাছে সমাদৃত। কিন্তু তিনি টানাপড়েন ও সঙ্কটকে চূড়ান্ত জটিলতায় নিয়ে যান না। বস্তুত, ভুবনায়নের ফলে যে-নব্য ভদ্রলোক শ্রেণি গড়ে উঠেছে, তাঁরাও একরকম ‘বেশ আছি’ পরিবেশে নিজেদের ভুলিয়ে রাখতে চান। অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়তে তাঁরা নারাজ, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে কে আর চায়!
এদিক থেকে স্মরণজিতের লেখায় যেন তারই আত্মপ্রকাশ। জিয়ানার মা জিয়ানাকে বলে, ‘তুই বারান্দায়, তোর বাপি ব্যস্ত। আমার টিভি ছাড়া আর কে আছে বল?’ সঙ্কট ভুলে থাকার নানা সরঞ্জাম আমাদের চারপাশে। জিয়ানাকে অফিসে ‘এনিমিটি সহ্য করতে হয়’। খুরানাজি ওকে পছন্দ করেন বলে অনেকের রাগ। আবডালে বলে, জ়িরো আউটপুট দিয়ে মাইনে নেয়। এর মধ্যে নীল চোখের কিগানের সঙ্গে আবার দেখা, ফ্যাক্টরির প্রোডাকশান ইনচার্জ সে। জিয়ানা কিগানকে ছাত্রজীবনে ফিরিয়ে দিয়েছিল। জিয়ানার মা শঙ্কিত, জিয়ানা নয়, সে কিগানকে আবার নতুন করে বুঝতে চায়। জিয়ানা বিয়ে করেছে, সেই বিয়েতে বিপত্তি, কিন্তু কিগান এখনও একা। কিগান, মাথা ঠান্ডা, নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া ও ফিরে আসা কিগান। সূর্য আর পৃথিবী, কাছে আসা দূরে যাওয়া। সূর্যকে ঘিরে অন্য গ্রহও কিন্তু আছে।
‘আলোর গন্ধ’ শেষ পর্যন্ত পাঠককে কোনও গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি করে না। আমাদের ভুবনায়িত ফিল গুড বাঙালির বাইরের চিত্র-বিচিত্র জীবনযাপনকে ও খানিক গহন ভেতরকে চিনিয়ে দেয়। এই চিনিয়ে দেওয়ার কাজটি স্মরণজিত্ নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন।
Download and Comments/Join our Facebook Group