বসন্ত বিলাপ: হুমায়ূন আহমেদ
এই বইয়ের সূচিপত্রে চোখ বোলালেই প্রাথমিকভাবে এ রকমের একটা ধারণা পাওয়া যাবে যে লেখক হুমায়ূন আহমেদ কত বিচিত্র বিষয়কে ধারণ করতে চেয়েছেন! দুটি মাত্র ছোটগল্প ছাড়া নানা উপলক্ষে লেখা এই বইয়ের অন্তর্গত রচনা ও প্রদত্ত সাক্ষাৎকারগুলো পাঠককে বিষয়সম্পৃক্ত দিকগুলো নিয়ে কেবল নতুন করে ভাবাবে না, এ রকম সিদ্ধান্তেও তাকে আসতে প্রাণিত করবে যে হুমায়ূন কল্পনাবিলাসী কথাসাহিত্যিক মাত্র নন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মৌলিক চিন্তাভাবনারও অধিকারী। ‘আমরা কোথায় চলেছি?’ এবং ‘বাউল ভাস্কর্য/এখন কোথায় যাব, কার কাছে যাব’ শীর্ষক মন্তব্য-ভাষ্যে যে বক্তব্য তিনি পেশ করেন, তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ কোথায়?
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তাঁর যে হাহাকারদীর্ণতা, তা যেন হয়ে উঠেছে সারা জাতিরই মর্মচেরা বিলাপের ধ্বনি।
‘স্মৃতি’ পর্বের লেখাগুলোর মাধ্যমে হুমায়ূন পাঠককে অন্য এক জগতে নিয়ে যাবেন। পরিহাসপ্রিয়তায় সিক্ত রচনার পাশাপাশি এখানে আছে স্মৃতিমেদুর একটি লেখা। শিরোনাম ‘আমার বাবার জুতা’। ‘এক এবং একা’, ‘হাবলঙ্গের বাজার’ ও ‘বসন্ত বিলাপ’ পড়া শেষে মন যেমন হালকা মেঘের সওয়ার হয়ে উঠবে, তেমনি ‘আমার বাবার জুতা’ সংবেদনশীল পাঠককে নিমেষে আবেগকম্পিত করে তুলবে। সামান্য নিদর্শন তুলে ধরা যাক স্মৃতিকাতর সেই রচনা থেকে। তার আগে জানাই, হুমায়ূনের বাবাকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করেছিল। কিন্তু খবরটি তাঁর মা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। হুমায়ূনের ভাষায়, এই দুঃসংবাদ শোনার পর তাঁর মা ডেকে বললেন, ‘তোরা এই লোকগুলোর কথা বিশ্বাস করিস না। তোর বাবা সারা জীবনে কোনো পাপ করেনি। এ রকম মৃত্যু তার হতে পারে না। তোর বাবা অবশ্যই বেঁচে আছে।’
কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হুমায়ূনের সেই মা ঢাকা থেকে পিরোজপুরে গেলেন। নদীর পাড়ে, যেখানে বাবাকে কবর দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছে, সেই জায়গা নিজে উপস্থিত থেকে খোঁড়ালেন। কবর থেকে লাশ তোলা হলো। শরীর পচে গলে গেছে, কিন্তু নাইলনের মোজা অবিকৃত। মা পায়ের মোজা, দাঁত, মাথার চুল দেখে বাবাকে শনাক্ত করলেন, তাঁর স্বামী বেঁচে নেই। এভাবে ব্যক্তিজীবনের যে বিয়োগান্ত ঘটনা হুমায়ূন তুলে ধরেন, তা আর কেবল তাঁর একার হয়ে থাকে না, প্রতিটি শহীদ পরিবারে পরিব্যাপ্ত হয়ে যায়।
‘ক্রিকেট’ পর্বে আছে মোট তিনটি লেখা। রম্যধাঁচের লেখাগুলোর ভেতর দিয়ে ফুটে উঠেছে খেলাটির প্রতি হুমায়ূনের গভীর প্রীতি ও ভালোবাসার কথা। ‘মাঠরঙ্গ’ রচনাটি পাঠককে দেবে অনাবিল আনন্দ। প সাহিত্যকর্মের বাইরে সংস্কৃতির ভিন্ন দুটি শাখায় হুমায়ূনের আত্মনিবেদনের বিষয়ে জানতে হলে এই নিবন্ধ চারটি পড়া বাঞ্ছনীয়।
‘মৃত্যুচিন্তা’ পর্বে আছে মাত্র একটি সংক্ষিপ্ত অথচ পরমপাঠ্য নিবন্ধ। শিরোনাম ‘মাইন্ডগেম’।
‘ছোটগল্প’ পর্বে আছে দুটি গল্প। একটির শিরোনাম ‘শবযাত্রী’, অন্যটির ‘রস, কষ, সিঙাড়া, বুলবুলি, মস্তক’। অনন্য এই গল্প দুটি পাঠ করে পাঠক অভাবিত আনন্দের সহচর হবেন।
এই গ্রন্থের ‘সাক্ষাৎকার’ পর্বটি সবচেয়ে ঋদ্ধ অংশ। মোট আটটি ছোট-বড় সাক্ষাৎকারে হুমায়ূন আহমেদ এমন অনেক কথা বলেছেন, যা গভীর থেকে গভীরতর অনুভবসিক্ত উচ্চারণেরই নামান্তর। তিনি যখন এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘সমুদ্র আমাদের মা। সমুদ্র আমাদের ডাকবে না তো কে ডাকবে? আমরা হচ্ছি স্তন্যপায়ী’ অথবা ওই একই সাক্ষাৎকারে যখন তিনি জানান, ‘আমাদের প্রাণের শুরু সমুদ্র থেকে। সে জন্য আমাদের রক্তের ঘনত্ব আর সমুদ্রের পানির ঘনত্ব এক। আমাদের রক্তের আরএইচ আর সমুদ্রের আরএইচ এক। আমাদের শরীরের লবণাক্ততা সমুদ্রেরই মতো। সেহেতু সমুদ্র দেখলে সমুদ্রের কাছে যেতে ইচ্ছে করে আমাদের’, তখন থমকে গিয়ে ভাবতে হয়। অথবা যখন তিনি বলেন, ‘নিজের লেখা সম্পর্কে আমার অহংকার অনেক বেশি’, তখনো কি মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যাবে লেখক হুমায়ূনের দিক থেকে?
বস্তুত, এ বইয়ের সাক্ষাৎকারগুলো থেকে তাঁর মনোজগৎ অর্থাৎ তাঁর মনস্তত্ত্ব, তাঁর জীবন-দর্শন, সমাজ, রাজনীতি ও পরিপার্শ্ব ভাবনা, নিজের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে তাঁর মনোভঙ্গি, তাঁর জীবনাচার, জীবন ও মৃত্যু, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, আধিভৌতিকতা, ধর্মবোধ, সর্বোপরি মানবিক মানুষ হুমায়ূন সম্পর্কে একটা সার্বিক ধারণা পাওয়ার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারি আমরা। সে বিচারে এ বই হুমায়ূন আহমেদের প্রায় আত্মজীবনীরই নিকটাত্মীয়।
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন \ প্রকাশকাল: নভেম্বর ২০১২ \ প্রচ্ছদপট: কাইয়ুম চৌধুরী \ পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৬০
এই বইয়ের সূচিপত্রে চোখ বোলালেই প্রাথমিকভাবে এ রকমের একটা ধারণা পাওয়া যাবে যে লেখক হুমায়ূন আহমেদ কত বিচিত্র বিষয়কে ধারণ করতে চেয়েছেন! দুটি মাত্র ছোটগল্প ছাড়া নানা উপলক্ষে লেখা এই বইয়ের অন্তর্গত রচনা ও প্রদত্ত সাক্ষাৎকারগুলো পাঠককে বিষয়সম্পৃক্ত দিকগুলো নিয়ে কেবল নতুন করে ভাবাবে না, এ রকম সিদ্ধান্তেও তাকে আসতে প্রাণিত করবে যে হুমায়ূন কল্পনাবিলাসী কথাসাহিত্যিক মাত্র নন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মৌলিক চিন্তাভাবনারও অধিকারী। ‘আমরা কোথায় চলেছি?’ এবং ‘বাউল ভাস্কর্য/এখন কোথায় যাব, কার কাছে যাব’ শীর্ষক মন্তব্য-ভাষ্যে যে বক্তব্য তিনি পেশ করেন, তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ কোথায়?
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তাঁর যে হাহাকারদীর্ণতা, তা যেন হয়ে উঠেছে সারা জাতিরই মর্মচেরা বিলাপের ধ্বনি।
‘স্মৃতি’ পর্বের লেখাগুলোর মাধ্যমে হুমায়ূন পাঠককে অন্য এক জগতে নিয়ে যাবেন। পরিহাসপ্রিয়তায় সিক্ত রচনার পাশাপাশি এখানে আছে স্মৃতিমেদুর একটি লেখা। শিরোনাম ‘আমার বাবার জুতা’। ‘এক এবং একা’, ‘হাবলঙ্গের বাজার’ ও ‘বসন্ত বিলাপ’ পড়া শেষে মন যেমন হালকা মেঘের সওয়ার হয়ে উঠবে, তেমনি ‘আমার বাবার জুতা’ সংবেদনশীল পাঠককে নিমেষে আবেগকম্পিত করে তুলবে। সামান্য নিদর্শন তুলে ধরা যাক স্মৃতিকাতর সেই রচনা থেকে। তার আগে জানাই, হুমায়ূনের বাবাকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করেছিল। কিন্তু খবরটি তাঁর মা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। হুমায়ূনের ভাষায়, এই দুঃসংবাদ শোনার পর তাঁর মা ডেকে বললেন, ‘তোরা এই লোকগুলোর কথা বিশ্বাস করিস না। তোর বাবা সারা জীবনে কোনো পাপ করেনি। এ রকম মৃত্যু তার হতে পারে না। তোর বাবা অবশ্যই বেঁচে আছে।’
কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হুমায়ূনের সেই মা ঢাকা থেকে পিরোজপুরে গেলেন। নদীর পাড়ে, যেখানে বাবাকে কবর দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছে, সেই জায়গা নিজে উপস্থিত থেকে খোঁড়ালেন। কবর থেকে লাশ তোলা হলো। শরীর পচে গলে গেছে, কিন্তু নাইলনের মোজা অবিকৃত। মা পায়ের মোজা, দাঁত, মাথার চুল দেখে বাবাকে শনাক্ত করলেন, তাঁর স্বামী বেঁচে নেই। এভাবে ব্যক্তিজীবনের যে বিয়োগান্ত ঘটনা হুমায়ূন তুলে ধরেন, তা আর কেবল তাঁর একার হয়ে থাকে না, প্রতিটি শহীদ পরিবারে পরিব্যাপ্ত হয়ে যায়।
‘ক্রিকেট’ পর্বে আছে মোট তিনটি লেখা। রম্যধাঁচের লেখাগুলোর ভেতর দিয়ে ফুটে উঠেছে খেলাটির প্রতি হুমায়ূনের গভীর প্রীতি ও ভালোবাসার কথা। ‘মাঠরঙ্গ’ রচনাটি পাঠককে দেবে অনাবিল আনন্দ। প সাহিত্যকর্মের বাইরে সংস্কৃতির ভিন্ন দুটি শাখায় হুমায়ূনের আত্মনিবেদনের বিষয়ে জানতে হলে এই নিবন্ধ চারটি পড়া বাঞ্ছনীয়।
‘মৃত্যুচিন্তা’ পর্বে আছে মাত্র একটি সংক্ষিপ্ত অথচ পরমপাঠ্য নিবন্ধ। শিরোনাম ‘মাইন্ডগেম’।
‘ছোটগল্প’ পর্বে আছে দুটি গল্প। একটির শিরোনাম ‘শবযাত্রী’, অন্যটির ‘রস, কষ, সিঙাড়া, বুলবুলি, মস্তক’। অনন্য এই গল্প দুটি পাঠ করে পাঠক অভাবিত আনন্দের সহচর হবেন।
এই গ্রন্থের ‘সাক্ষাৎকার’ পর্বটি সবচেয়ে ঋদ্ধ অংশ। মোট আটটি ছোট-বড় সাক্ষাৎকারে হুমায়ূন আহমেদ এমন অনেক কথা বলেছেন, যা গভীর থেকে গভীরতর অনুভবসিক্ত উচ্চারণেরই নামান্তর। তিনি যখন এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘সমুদ্র আমাদের মা। সমুদ্র আমাদের ডাকবে না তো কে ডাকবে? আমরা হচ্ছি স্তন্যপায়ী’ অথবা ওই একই সাক্ষাৎকারে যখন তিনি জানান, ‘আমাদের প্রাণের শুরু সমুদ্র থেকে। সে জন্য আমাদের রক্তের ঘনত্ব আর সমুদ্রের পানির ঘনত্ব এক। আমাদের রক্তের আরএইচ আর সমুদ্রের আরএইচ এক। আমাদের শরীরের লবণাক্ততা সমুদ্রেরই মতো। সেহেতু সমুদ্র দেখলে সমুদ্রের কাছে যেতে ইচ্ছে করে আমাদের’, তখন থমকে গিয়ে ভাবতে হয়। অথবা যখন তিনি বলেন, ‘নিজের লেখা সম্পর্কে আমার অহংকার অনেক বেশি’, তখনো কি মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যাবে লেখক হুমায়ূনের দিক থেকে?
বস্তুত, এ বইয়ের সাক্ষাৎকারগুলো থেকে তাঁর মনোজগৎ অর্থাৎ তাঁর মনস্তত্ত্ব, তাঁর জীবন-দর্শন, সমাজ, রাজনীতি ও পরিপার্শ্ব ভাবনা, নিজের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে তাঁর মনোভঙ্গি, তাঁর জীবনাচার, জীবন ও মৃত্যু, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, আধিভৌতিকতা, ধর্মবোধ, সর্বোপরি মানবিক মানুষ হুমায়ূন সম্পর্কে একটা সার্বিক ধারণা পাওয়ার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারি আমরা। সে বিচারে এ বই হুমায়ূন আহমেদের প্রায় আত্মজীবনীরই নিকটাত্মীয়।
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন \ প্রকাশকাল: নভেম্বর ২০১২ \ প্রচ্ছদপট: কাইয়ুম চৌধুরী \ পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৬০