হিমুর গল্প - হুমায়ূন |
১৩ নভেম্বর বাংলা সাহিত্যের সম্রাট হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে হিমু দিবস পালিত হয়েছে। হিমুকে নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আয়োজনের রেশ এখনো কাটেনি। হুমায়ূন আহমেদের চোখে হিমু কেমন ছিল? তারই একটি ধারণা পাওয়া যাবে এই লেখায়।
ময়ূরাক্ষীর তীরে প্রথম হিমু
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। লেকচারার থেকে অ্যাসিসটেন্ট প্রফেসর হয়েছি। বেতন বাড়েনি, যন্ত্রণা বেড়েছে। আমাকে দূর-দূরান্তরে পরীক্ষা নিতে পাঠানো হচ্ছে। পটুয়াখালী, বরিশাল, ফরিদপুর। কলেজগুলিতে পড়াশোনা হয় না বললেই চলে। প্রাকটিক্যাল ক্লাসের সুযোগ-সুবিধাও নেই। ছাত্ররা কিছুই পারে না। অতি সহজ প্রশ্নে মাথা চুলকায়, ঘাড় চুলকায়। মাথা এবং ঘাড় থেকে প্রশ্নের উত্তর আসে না। অনার্স পরীক্ষা দিচ্ছে এমন ছেলেকে যখন জিজ্ঞেস করি, পানির ফর্মুলা কী? সে আমতা আমতা করে বলে, ঔ২ৃ। যেন তার সন্দেহ আছে আসলেই ঔ২ৃ কিনা। তারপর জিজ্ঞেস করি, ঊ২ৃ কী? যারা কেমিস্ট্রি জানেন না তাদের বলছি, ঊ২ৃ হচ্ছে হেভি ওয়াটার। হাইড্রোজেন অ্যাটমে প্রোটন থাকে একটা, এখানে দুটা। ঊ হলো হাইড্রোজেনের একটা অ্রর্মমযণ. অতি সহজ এই প্রশ্নে পরীক্ষার্থী পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে বলে, স্যার ঊ২ৃ হচ্ছে ঢাকার পানি।
তাহলে রাজশাহীর পানির ফর্মুলাটা কী?
স্যার ৗ২ৃ।
বরিশালের পানি?
স্যার ঈ২ৃ।
বরগুনার পানি?
এইবার ছাত্র উৎসাহী। সে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। সে হাসিমুখে জবাব দেয়, বরগুনার পানিরও স্যার একই ফর্মুলা ঈ২ৃ।
আমি হতাশ চোখে পরীক্ষার্থীর দিকে তাকিয়ে থাকি। ইন্টারনাল একজামিনার হাত কচলাতে কচলাতে বলেন, পাস করিয়ে দিতে হবে স্যার। গরিবের ছেলে। কষ্ট করে লেখাপড়া করছে। ভাবটা এরকম যে, ধনীর ছেলেমেয়েদের কেমিস্ট্রি জেনে পাস করতে হবে। গরিবের ছেলের পাসটা প্রয়োজন। কেমিস্ট্রি জানা প্রয়োজন না।
বাইরে পরীক্ষা নিতে গেলে ভাইভা বিষয়ক অতি ক্লান্তিকর অবস্থার ভেতর যেতে হয়। ছাত্রদের ফেল করাতে ইচ্ছা করে না, আবার পাস করাতেও ইচ্ছা করে না।
ভাইভা নিতে কষ্ট। থাকা-খাওয়াতেও কষ্ট। এক্সটারনাল শিক্ষকদের থাকার জায়গা হয় সাধারণত ল্যাবরেটরির লাগোয়া ঘরে। উদাহরণ বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ। সেখানে পরীক্ষা নিতে গিয়ে ঐ ঘরে অনেকদিন থেকেছি। একবার ভূতও দেখেছিলাম! যেসব কলেজে এরকম কোনো ঘর নেই সেখানে থাকার ব্যবস্থা হয় কোনো শিক্ষকের বাসায়। ভদ্রলোক হয়তো পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করছেন, সেখানে মূর্তিমান উপদ্রবের মতো অচেনা অজানা একজন মানুষ থাকতে আসেন। যাকে আপন করে নেয়া যায় না, আবার দূরেও ঢেলে রাখা যায় না। এক্সটারনাল ভদ্রলোক ইচ্ছা করলেই ভাইভায় প্রচুর ফেল করিয়ে ঝামেলা করতে পারেন। একবার কেমিস্ট্রির এক শিক্ষকের বাসায় আমার থাকার জায়গা হলো। ভদ্রলোকের বাসায় একটা বাথরুম। সেই বাথরুম স্বামী-স্ত্রীর শোবার ঘরের সঙ্গে এটাচড। আমার আবার রাতে কয়েক দফা বাথরুমে যেতে হয়। ভদ্রলোক অবশ্যি খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, আমার শোবার ঘরের দরজা খোলা থাকবে। আপনার যতবার ইচ্ছা বাথরুমে যাবেন। কোনো সমস্যা নেই। দীর্ঘ ভূমিকা দিলাম, এখন মূল গল্পে আসি। আমি পরীক্ষা নিতে গেছি পটুয়াখালীতে। ল্যাবরেটরির পাশের টিচার্স রুমে খাট পেতে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গরমকাল। বেশিরভাগ সময় ইলেকট্রিসিটি নেই। ফ্যান চলে না। প্রথম রাতে একফোঁটা ঘুম হলো না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করি। রাত তিনটায় মশারির ভেতর থেকে বের হলাম। সঙ্গে সঙ্গে শত শত মশা আমাকে ছেঁকে ধরল। আবার মশারির ভেতর ঢুকলাম। গরমে টিকতে না পেরে আবার বের হলাম। মশাদেরকে বললাম, তোমরা যারা এখানে আছ তারাই আমার রক্ত খাও, বাইরে থেকে কাউকে ডেকে এনো না।
ঘরটাকে আমার মনে হলো হাজতখানা। এই হাজতে সাতটা রাত পার করতে হবে ভেবে খুবই দমে গেলাম। এর হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় কীভাবে? হঠাৎ করে মনে হলো- একটা নদী কল্পনা করলে কেমন হয়? নদীর পাড়ে একটা গাছের নিচে আমি বসে আছি। উথাল পাথাল হাওয়া নদীর উপর দিয়ে উড়ে আসছে। এমন হাওয়া যে আমার সামান্য শীত শীত ভাব হচ্ছে। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মশক বাহিনীকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নদী কল্পনা শুরু করলাম। নদীর একটা সুন্দর নামও দিলাম- ময়ূরাক্ষী। যারা আমার লেখা পড়ছেন তারা হয়তো পুরোপুরি বিশ্বাস করবেন না যে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার গরম লাগা কমে গেল। নদীর প্রবল হাওয়ায় মশারা উড়ে গেল। আমার খানিকটা শীত শীতও করতে লাগল। তৈরি হলো হিমু, যে যেকোনো অবস্থায় কল্পনার নদী ময়ূরাক্ষীর কাছে চলে যেতে পারে।
হিমুকে নিয়ে লেখা আমার প্রথম উপন্যাসটির নাম ময়ূরাক্ষী। ময়ূরাক্ষীর হিমু আমি নিজে।
প্রথম লেখা হিমুবিষয়ক বইয়ে ময়ূরাক্ষী নদী কীভাবে চলে এলো, একটু দেখা যাক।
‘ছোটবেলার কথা। ক্লাস সিক্সে পড়ি। জিওগ্রাফি পড়ান মফিজ স্যার। তিনি ক্লাসে ঢুকলে চেয়ার-টেবিলগুলি পর্যন্ত ভয়ে কাঁপে। স্যার মানুষটা ছোটখাটো, কিন্তু হাতের থাবাটা বিশাল। আমাদের ধারণা ছাত্রদের গালে চড় বসাবার জন্য আল্লাহতালা স্পেশালভাবে স্যারের এই হাত তৈরি করে দিয়েছেন। স্যারের চড়েরও নানান নাম ছিল- রাম চড়, শ্যাম চড়, যদু চড়, মধু চড়। এর মধ্যে সবচে’ কঠিন চড় হচ্ছে রাম চড়, সবচে’ নরমটা হচ্ছে মধু চড়।
স্যার সেদিন পড়াচ্ছেন- বাংলাদেশের নদ-নদী। ক্লাসে ঢুকেই আমার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, এই একটা নদীর নাম বল তো। চট করে বল।
মফিজ স্যার কোনো প্রশ্ন করলে কিছুক্ষণের জন্য আমার মাথাটা পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যায়। কান ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। মনে হয় মাথার খুলির ভেতর জমে থাকা কিছু বাতাস কানের পরদা ফাটিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।
কী ব্যাপার চুপ করে আছিস কেন? নাম বল।
আমি ক্ষীণস্বরে বললাম, আড়িয়াল খাঁ।
স্যার এগিয়ে এসে প্রচণ্ড চড় বসিয়ে দিলেন। খুব সম্ভব রাম চড়। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, এত সুন্দর সুন্দর নাম থাকতে তোর মনে এলো আড়িয়াল খাঁ? সব সময় ফাজলামি? কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাক।
আমি কানে ধরে সারাটা ক্লাস দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘণ্টা পড়ার মিনিট পাঁচেক আগে পড়ানো শেষ করে স্যার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাছে আয়।
আরেকটি চড় খাবার জন্য আমি ভয়ে ভয়ে স্যারের কাছে এগিয়ে গেলাম। তিনি বিষণœ গলায় বললেন, এখনো কানে ধরে আছিস কেন? হাত নামা।
আমি হাত নামালাম। স্যার ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, তোকে শাস্তি দেয়াটা অন্যায় হয়েছে, খুবই অন্যায়।
তোকে নদীর নাম বলতে বলেছি, তুই বলেছিস। আয় আরো কাছে আয়, তোকে আদর করে দেই।
স্যার এমন ভঙ্গিতে মাথায় এবং পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন যে আমার চোখে পানি এসে গেল। স্যার বিব্রত গলায় বললেন, আমি তোর কাছে থেকে সুন্দর একটা নদীর নাম শুনতে চেয়েছিলাম, আর তুই বললি আড়িয়াল খাঁ। আমার মেজাজটা গেল খারাপ হয়ে। আচ্ছা এখন সুন্দর একটা নদীর নাম বল।
আমি শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে বললাম ময়ূরাক্ষী।
ময়ূরাক্ষী? এই নাম তো শুনিনি। কোথাকার নদী?
জানি না স্যার।
এই নামে আসলেই কি কোনো নদী আছে?
জানি না স্যার।
স্যার হালকা গলায় বললেন, ‘আচ্ছা থাক। না থাকলে নেই। এটা হচ্ছে তোর নদী। যা জায়গায় গিয়ে বোস। এমনিতেই তোকে শাস্তি দিয়ে আমার মনটা খারাপ হয়েছে। তুই তো দেখি কেঁদে কেঁদে আমার মন খারাপটা বাড়াচ্ছিস। আর কাঁদিস না।’
নয় নম্বর বিপদ সংকেত
পাঠকরা ভুলেও ভাববেন না ‘ময়ূরাক্ষী’ বের হবার পর পরই যুবকশ্রেণীর বিরাট অংশ হলুদ পাঞ্জাবি পরে রাস্তায় নেমে গেল। আমিও মনের আনন্দে একের পর এক হিমু বাজারে ছাড়তে লাগলাম। পাশ বইয়ের খাতায় টাকা জমা হতে লাগল। শুরুতে হিমুকে আমি মোটেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করিনি। তখন আমার প্রিয় চরিত্র মিসির আলি। আমি লিখছি মিসির আলি। এই ভদ্রলোকের লজিকে এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতায় আমি মুগ্ধ।
এর মধ্যে আমার অর্থনৈতিক অবস্থার সামান্য উন্নতি হয়েছে। বন্ধুবান্ধব, ব্যাংক এবং প্রকাশকদের কাছ থেকে ধার করে এলিফেন্ট রোডে একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছি। পনেরশ’ স্কয়ার ফিটের ছোট্ট ফ্ল্যাট। তাতে কী, দুটা বেডরুম আছে। একটা বারান্দা আছে। বারান্দায় বসলে সুন্দর কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পাই না। জুতার দোকান দেখতে পাই। ছয়তলা থেকে জুতার দোকান দেখা খারাপ কিছু না। বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে আমি জুতার দোকান দেখি এবং পরের লেখাটা কী হবে ভাবি।
আমার তিন মেয়ে তখন সামান্য বড় হয়েছে। বড় মেয়েটি ক্লাস সিক্সে পড়ে, মেজোটি পড়ে ক্লাস ফোরে। ভোরবেলা স্কুলের পোশাক পরে তারা কিছুক্ষণ ধবল রঙের ডিপফ্রিজের সামনে দাঁড়ায়। কারণ তাদের বাবা রাতে যা লিখেছে তা ডিপফ্রিজের উপর সাজানো থাকে। আমার এই দুই কন্যা বাবার লেখার সর্বশেষ অংশ না পড়ে স্কুলে যাবে না। আমার লেখক জীবনে এর চেয়ে বড় পুরস্কার পেয়েছি বলে মনে পড়ে না।
আমার এই দুই কন্যার কোনো একজন, খুব সম্ভব বড়জন, আমাকে একদিন বলল, বাবা ময়ূরাক্ষীর মতো আরেকটা বই লেখ। হিমুর বই।
হিমুকে নিয়ে কন্যার আগ্রহে লিখে শেষ করলাম ‘দরজার ওপাশে’। বই প্রকাশিত হলো। আমি পড়লাম মহাবিপদে। হাইকোর্টে বিচারকদের সমিতি আছে। সমিতির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো, এই বইটি লিখে আমি মহা অন্যায় করেছি। মহান বিচারকদের সম্মান ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছি। কারণ আমি লিখেছি ‘জজ সাহেবরা ঘুষ খান।’
উপন্যাসে ঘটনাটা এরকম- হিমুর মাতুল বংশ পিশাচশ্রেণীর। তারা হেন দুষ্কর্ম নাই যা করে না। তাদের ধারণা যেকোনো কাজ টাকা দিয়ে করানো সম্ভব। তাদেরই একজন জজ সাহেবকে ঘুষ দিয়ে এই কাজটা করাতে চাচ্ছে। জজ সাহেবরা ঘুষ খান- এটি হিমুর ধান্ধাবাজ মামার কথা। বইতে কীভাবে এসেছে দেখা যাক।
‘মামা গোসল করে জায়নামাজে বসে গেলেন। দীর্ঘ সময় লাগল নামাজ শেষ করতে। তাঁর চেহারা হয়েছে সুফি সাধকের মতো। ধবধবে সাদা লম্বা দাড়ি। মোনাজাত করবার সময় টপটপ করে তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। আমি অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখলাম।
তারপর বল, কী ব্যাপার?
একজন লোক জেলখানায় আছে মামা। ওর সঙ্গে দেখা করা দরকার, দেখা করার কায়দা পাচ্ছি না। দরখাস্ত করেছি, লাভ হয়নি।
খুনের আসামি? তিনশ বারো ধারা?
কোন ধারা তা জানি না, তবে খুনের আসামি।
এটা কোনো ব্যাপারই না। টাকা খাওয়াতে হবে। এই দেশে এমন কোনো জিনিস নাই যা টাকায় হয় না।
টাকা তো মামা আমার নেই।
টাকার চিন্তা তোকে করতে বলছি নাকি? আমরা আছি কী জন্য? মরে তো যাই নাই। টাকা সাথে নিয়ে আসছি। দরকার হলে জমি বেচে দেব। খুনের মামলাটা কী রকম বল শুনি। আসামি ছাড়ায়ে আনতে হবে? তুমি পারবে না মামা। তোমার ক্ষমতার বাইরে।
আগে বল, তারপর বুঝব পারব কী পারব না। টাকা থাকলে এই দেশে খুন কোনো ব্যাপারই না। এক লাখ টাকা থাকলে দুটো খুন করা যায়। প্রতি খুনে খরচ হয় পঞ্চাশ হাজার। পলিটিক্যাল লোক হলে কিছু বেশি লাগে। আমি মোবারক হোসেন সাহেবের ব্যাপারটা বললাম। মামা গালে হাত দিয়ে গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনলেন। সব শুনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, পুলিশের সাজানো মামলা, পেছনে আছে বড় খুঁটি। কিছু করা যাবে না। ট্রাইবুন্যাল করলে কোনো আশা নাই, সিভিল কোর্ট হলে আশা আছে। জজ সাহেবদের টাকা খাওয়াতে হবে। আগে জজ সাহেবরা টাকা খেত না। এখন খায়। অনেক জজ দেখেছি কাতলা মাছের মতো হাঁ করে থাকে। কেইস সিভিল কোর্টে উঠলে আমারে খবর দিয়ে নিয়ে আসবি।’
মামলা মোকদ্দমা বিষয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। সব সময় শুনেছি মামলা লোয়ার কোর্ট থেকে হাইকোর্টে যায়, তারপর সুপ্রিমকোর্ট। আমার বেলায় সরাসরি হাইকোর্ট থেকে তলব।
শুধু আমি একা আসামি তা কিন্তু না। আমাকে নিয়ে বিচারকরা মামলা করেছেন এই বিষয়টি যেসব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তারাও আসামি। তাতে আমার সুবিধা হলো, পত্রিকার সম্পাদকরা বড় বড় ব্যারিস্টার দিলেন। এই মুহূর্তে ড. কামাল হোসেন এবং ভাষাসৈনিক গাজিউল হকের নাম মনে পড়ছে।
পত্রিকার সম্পাদকরা আদালতে উপস্থিত হয়ে ক্ষমা চাইলেন এবং পার পেয়ে গেলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল তাঁর অফিসে আমাকে ডেকে নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বললেন। তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন যে, ক্ষমা প্রার্থনা করলে এবং বিতর্কিত বইটি বাজার থেকে উঠিয়ে নিলে আমার আর কোনো ঝামেলা হবে না।
আমি বললাম, ভুল করলেই ক্ষমা প্রার্থনার প্রশ্ন আসে। আমি ভুল করিনি। উপন্যাসের একটি দুষ্ট চরিত্র কী বলছে তার দায়ভাগ লেখকের না। তারপরেও যদি দায়ভাগ আমার থাকে তাহলে আমি ‘জজ সাহেবরা ঘুষ খান’ এই মন্তব্য থেকে সরে আসব না। সব জজ সাহেবের কথা এখানে বলা হয়নি। জজ সাহেবরা ভিনগ্রহ থেকে আসেননি। মানুষের সাধারণ ত্র“টি তাদের মধ্যেও থাকবে। একজন লেখক হিসেবে আমি তা লিখব। আমাদের সংবিধান মত প্রকাশের অধিকার দিয়েছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল বললেন, আপনি কিন্তু বিপদে পড়বেন।
আমি বললাম, কী আর করা। না হয় একটু বিপদে পড়লাম।
মামলা শুরু হলো। আমি হাইকোর্টে যাই। সঙ্গে আমার তিন কন্যা এবং তাদের মা। তারা ভয়ে অস্থির, এই বুঝি আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
মামলার একপর্যায়ে তিন বিচারক নিয়ে গঠিত বেঞ্চের একজন বললেন, তিনি বিব্রত। মামলায় থাকবেন না। কিছুদিন পর আরেকটি বেঞ্চ তৈরি হলো। সেই বেঞ্চের এক বিচারকও বললেন তিনি বিব্রত।
পনেরো ষোল বছর তো হয়েই গেল, বিচারকরা আমার বিষয়ে বিব্রত রয়েই গেলেন। আমার খুব ইচ্ছা করে মামলাটা শেষ পর্যন্ত দেখতে। মামলায় আমি যদি জিতে যাই তাহলে প্রমাণ হবে জজ সাহেবরা সাধারণ লোভ লালসার ঊর্ধ্বে না। আর যদি হেরে জেলে যাই তাতেও ক্ষতি নেই। অতীতে এই পৃথিবীতে লেখার মাধ্যমে মত প্রকাশের কারণে মৃত্যুদণ্ড দেবার মতো ঘটনাও ঘটেছে। আমি না হয় কিছুদিন জেলে থাকলাম। আমাকে জেলখানার মেঝেতে শুয়ে থাকতে হবে না। একুশে পদক পাওয়ার কারণে ডিভিশন দেয়া হবে। বিছানায় ঘুমাব। ভাগ্য ভালো হলে মাথার উপর ফ্যান ঘুরবে। ফ্যান না ঘুরলেও ক্ষতি নেই- চোখ বন্ধ করে ময়ূরাক্ষী নদীকে জেলের ভেতর নিয়ে আসা কঠিন কোনো কাজ না।
You can follow us on Twitter or join our Facebook fanpage or even follow our Google+ Page to keep yourself updated on all the latest from Bangla Literature. Also try our chrome extension.
2 Comments