রবীন্দ্রনাথের নতুন বউঠানের শেষ চিঠি
কাদম্বরীদেবীর সুইসাইড-নোট
বিহারীলালের সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কোনও ‘গহন’ সম্পর্ক’? নাকি তৎকালীন কলকাতার বিখ্যাত এক নটীর সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গোপন প্রণয়? না, বিয়ের পর আদরের রবির জীবনে নতুন অধ্যায়- ঠিক কোন ঘটনা দায়ী, কবির বিয়ের সাড়ে চার মাসের মাথায় নতুন বউঠান কাদম্বরীদেবীর আত্মহত্যার জন্য? সঠিক উত্তরটি হয়ত বা জানতেন রবিঠাকুর স্বয়ং। বউঠানের আত্মহত্যার পরে হয়ত তাই লিখেছিলেন, ‘আমি জানি, আত্মহত্যার কারণ জিজ্ঞেস করলে কী সে কহিত, কী তাকে দহিত!’
যে ঠাকুরবাড়ি, পুত্রবধূর আত্মহত্যার পর মরদেহ মর্গে পাঠায় না, স্ক্যান্ডেল এড়ানোর উদ্দেশ্যে ৫১ টাকা ১২ আনা খরচ করে জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই করোনার কোর্ট বসিয়ে রিপোর্ট গোপন করে এবং খবরের কাগজের মুখ বন্ধ রাখার জন্য ঘুষ দেয়, সেই বাড়ির এক বহুচর্চিত পরকীয়া সম্পর্কের মন-বিশ্লেষণের সৌরভ নিয়ে রঞ্জনের এই নব্য উপন্যাস। স্বয়ং মহর্ষির উদ্যোগে করোনার রিপোর্ট লোপ করা বা, কেন ‘সুইসাইড নোট’ গায়েব করা হল ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের এমনতরো বিতর্কিত প্রসঙ্গের সদুত্তর মেলে না রঞ্জনের ১২০ পাতার উপন্যাসে। মেলে, এক মধ্য তেইশের নারীর প্রেম ও দহনের বারমাস্যা। কাহিনির বাঁকে কাদম্বরী রবিকে তাই বলেছে, ‘তুমি জানো কোথায় আমার কষ্ট, আমার দহন’! বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে এখানেই রঞ্জনের কাহিনির উড়ান।
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের কাদম্বরীর আত্মহনন প্রসঙ্গ নিয়ে লেখালিখি শুরু হয়েছিল বহুকাল আগে। সে প্রায়, ১৯০০ সালে। সোফিয়া পত্রিকায় ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় তাঁর ‘দ্য ওয়ার্ল্ড পোয়েট অফ বেঙ্গল’ প্রবন্ধে কবির সঙ্গে বউঠানের সম্পর্কের ইঙ্গিত দিয়ে লিখেছিলেন, রবীন্দ্র-কবিতায় যে ‘স্পিরিট’ তার উৎসে আছে 'an excruciating pain of an unrequited love’। তবে, বিস্তৃত ভাবে প্রথম ‘শনিবারের চিঠি’-তে ধারাবাহিক ভাবে লেখেন জগদীশ ভট্টাচার্য। কাদম্বরীদেবীকে নিয়ে যাঁরা জগদীশ ভট্টাচার্যের ‘কবিমানসী’ বা, মল্লিকা সেনগুপ্তের ‘কবির বউঠান’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'প্রথম আলো' অথবা রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাত মুখোপাধ্যায়, রবিজীবনী’-র অথর প্রশান্তকুমার পাল, রবীন্দ্র গবেষক জ্যোতির্ময় ঘোষ, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য পড়েছেন, তাঁরা ভিরমি খাবেন না। কেন না, রঞ্জন সন-তারিখ মিলিয়ে জীবনকেন্দ্রিক এ উপন্যাসে ঠাকুরবাড়ির রোজনামচা হয়ত লেখেন নি। কিন্তু, এ উপন্যাস নিছক প্রাপ্ত-মনস্কদের গল্প নয়, বলা যায় খানিকটা গসিপ। গসিপের যেমন একটা ছুতো থাকে, কখনও ভিত্তি - এ কাহিনি ঠিক তেমন। বাকিটা রঞ্জনের সহজিয়া গদ্য ভাষার লালিত্যে পরকীয়া-প্রেম। যে প্রেম নিকষিত হেম-ই, কাম গন্ধ নেই তাতে! ভালো লাগে সেই পরকীয়া প্রেমের শোভন ও সহজপাঠ।
প্রদীপ জ্বালানোর আগে যেমন সলতে পাকানোর একটা কাহিনি থাকে। এ উপন্যাস শুরুর আগে লেখক তেমন একটি নাতিদীর্ঘ কাহিনি-সূত্র রেখেছেন। ইটালিক্স বাংলা হরফে তিন পাতার সেই ইতিহাস নির্ভর, একশো সাতাশ বছরের পুরানো, কাহিনি সূত্রে; কাদম্বরীদেবীর আফিম খেয়ে আত্মহনন ও শেষ দু্’ দিনের ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের কথা বারমহলে আনতে গিয়ে; রঞ্জন লিখছেন, ‘ঠিক সুইসাইড ‘নোট’ নয়। এক সুদীর্ঘ চিঠি। চিঠিটার সর্বাঙ্গ ঝলসে গেছে আগুনে। সব চিঠিটা ঠিক পড়াও যায় না। ঝলসানো চিঠিটিকে কে বাঁচিয়েছিলেন আগুন থেকে? রবীন্দ্রনাথ?...’ ব্লার্বেও এই প্রসঙ্গ, ঔপন্যাসিকের ‘প্রাক্-কথন’-এও এক কথার পুনরাবৃত্তি। সংবেদনশীল পাঠক এখানেই টের পান, উপন্যাসের মূল ‘কি-ওয়ার্ড’-টি লেখক পাঠকের হাতে যেন তুলে দিলেন এখানেই। এ উপন্যাস আসলে সেই কল্পিত কথাচারিতার এক দীর্ঘ গোপ্য চিঠিই। নতুন বউঠান লিখছেন ‘প্রাণের রবি’-কে।
পরকীয়া কাহিনির শুরুতেই এক মোক্ষম মোচড়। রবিকে তাঁর বউঠান লিখছেন, ‘আজকাল তোমার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়। সেটাই তো স্বাভাবিক। মাত্র চারমাস বিয়ে হয়েছে তোমার’। এর ঠিক পরের পরিচ্ছদে, ‘আগে তো সূর্য ওঠার আগে তুমি উঠতে। আমার ঘুম ভাঙাতো তোমার সকালবেলার গান। আমরা একসঙ্গে যেতাম নন্দনকাননে। ...তারপর একদিন সেই বাগানে ভোরের প্রথম আলোয় আমাকে চুমু খেয়ে জিগ্যেস করলে- ‘নতুন বউঠান, নামটা তোমার পছন্দ হয়েছে?’ আমার সমস্ত শরীরের তখন কাঁটা দিচ্ছে। আবার ভয়ে বুক করছে দুরদুর। ঠাকুরপো, ‘এমন দুঃসাহস ভালো নয়, কেউ দেখে ফেললে...’!
কাদম্বরী চরিত্রের দুর্বহ যন্ত্রণার দিকটি আঁকতে গিয়ে তাঁকে ঠাকুরবাড়ির মহিলামহল এবং কর্তাব্যাক্তিদের নিয়ত অপমানের খন্ডচিত্র এনেছেন রঞ্জন। এর সঙ্গে, একদিকে নতুনদাদার প্রত্যাখান। অন্যদিকে, বর্ষণমুখর দিনে রবীন্দ্রের বরণমাল্য। প্রেমের আশ্চর্য সারল্যে লেখা এই পর্বের খানিকটা উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ‘বৃষ্টিতে ভিজছ তুমি। ...তোমার আয়ত দুটি চোখে মেঘলা আকাশের মায়া। তুমি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলে, ‘ঠাকুরবাড়িতে একটি উপবাসে আমরা সবাই কষ্ট পেয়েছি। চিরকাল, আদরের উপবাস’। ...তোমার মুখের দিকে মুখ তুলে বললাম, ‘আমাকে একটু আদর করবে ঠাকুরপো? কতদিন – কতদিন কোনও আদর পাইনি আমি। তুমি যেন জলদেবতা। সামান্য নীচু হলে তুমি। আমার মুখখানি তুলে নিলে কত আদরে – চুমু খেলে আমার ঠোঁটে। এক ঝলকের আলতো চুমু। মনে হল, এই প্রথম আদর পেলাম আমি’। যে অলস দ্বিপ্রহরের প্রান্তবেলায় কাদম্বরী জানলার ধারে মালা গাঁথতে গাঁথতে ঘুমিয়ে পড়েছিল, সেদিনকার দৃশ্যকল্পটিও তুখোড়। পড়তে পড়তে আমার কেবলই মনে পড়ছিল ওই গানটির কথা, ‘যখন যাব চলে ওরা ফুটবে তোমার কোলে,/ তোমার মালা গাঁথার আঙুলগুলি মধুর বেদনভরে/ যেন আমায় স্মরণ করে...অলস দ্বিপ্রহরে’।
মল্লিকা তাঁর বইতে ধরেছিলেন একটা সময়। যে সময়ে, ‘একইসঙ্গে খেলা করেছে সৃজনশীল এক আশ্চর্য সময় আর নিঃসঙ্গ ভালাবাসার বিষাদ’। অন্যরা, কেবল গবেষকের মন নিয়ে তথ্যনিষ্ঠ নিবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু সুনীলের পর, রঞ্জন তাঁর উপন্যাসে ধরেছেন সতেরো বছর ধরে চলা একটা সম্পর্কের মন বিশ্লেষণের সৌরভ! উপন্যাসের মধ্য পর্বে গিয়ে কাদম্বরী ও রবির পারস্পরিক ভালবাসার স্বীকারোক্তি চিঠি এনেছেন লেখক। কাদম্বরীদেবীর বয়ানে খানিকটা স্বগতোক্তির ঢঙে বলে যাওয়া এই সব চিঠিতে, উপন্যাসের কাহিনি ঘিরে ভিড় করেছে ঠাকুরবাড়ির বিচিত্র চরিত্র ও তাদের দোস্তির দস্তুর। এঁরা সকলেই প্রায় ঐতিহাসিক নরনারী। নেহাত রঞ্জনের 'গসিপ'-এর কুশীলব নয়। মানুষগুলোর সামাজিক পরিচয় দেবার জন্য চিঠির পরতে পরতে বে-আব্রু করে দেন লেখক। বোঝা যায়, এ উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক নয়।
কাহিনির নির্মিতির অভিনব ঠাট ও কথনভঙ্গিমার প্রেম-তন্ময়তা আমাকে বারবার মুগ্ধ করে। তবু, বাংলা উপন্যাসের হাওয়া বদলের পর লেখা একে ঠিক হয়ত ‘উপন্যাস’ বলা যায় না। কেন না, চিঠি একটি ব্যাক্তি-পুরুষের আত্মগত খন্ড-বিচ্ছিন্ন ভাবনা। ঘটনার পারম্পর্য বা ধারাবাহিকতার সংহতি থাকে না সেখানে। যা নেই-ও এ লেখায়। তাই প্রায় পরিচ্ছদ বদলের সঙ্গে সঙ্গেই একটি স্বতন্ত্র এপিসোড হয়ে ওঠে। কাদম্বরীর একই কথার অনুরণন তোলে, ‘মৃত্যু যতই এগিয়ে আসছে, বিদায়ের ঘণ্টা যতই শুনতে পাচ্ছি, ততই যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মন, ভাবনারা সব ছড়িয়ে যাচ্ছে, তাদের ওপর আমার শাসন আলগা হয়ে যাচ্ছে’। কখনও কাদম্বরী বলছেন, ‘ঠাকুরপো, কথায়-কথায় খেই হারিয়ে কোথায় চলে এলাম। তোমাকে তো বলেইছি, মনটা বড্ড এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারছি না’। আর এই এলোমেলো কথার ভিতর দিয়েই কাদম্বরী মুখে তার ছোট্ট জীবনের গল্প বলেছেন।
উপন্যাস শেষ করে, বউঠাকুরানির কথা ভাবতে ভাবতে কষ্ট হয়, করুণা হয় মধ্য তেইশের ওই রমণীর জন্য। কেননা, তিনি নিজেকে তো জানতেনই। আর এও জানতেন কবি নিরুপায়। বুঝেছিলেন, এই প্রণয় শেষ হবে বেদনরাগে। একটু একটু করে উপন্যাসের একেবারে শেষে রঞ্জন তাই যেন পিলু-কালাংড়া আর পরজ-কীর্তনে দুঃখরাগের মীড় বিছিয়ে দিয়েছেন। কবির বউঠান চিরতরে চলে গেলেন নিভৃতে! নিঃশব্দে যেন, ঢেউয়ের মতন ভেসে গেলেন চাঁদের আলোর দেশে! পাঠ ফুরিয়ে দূর নীলিমার দিকে তাকিয়ে থাকি। একরকম মনখারাপ হয়। বুঝি, এ মনখারাপ রঞ্জনের বউঠান চরিত্রের জন্য মনকেমনের মনখারাপ! এখানেই জিতে যান লেখক।
Download