রবীন্দ্রনাথ-সংগৃহীত লালনের গানের পান্ডুলিপি
লোকায়ত বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতিতে লালন একটি অবিস্মরণীয় ধ্রুপদী নাম। ‘মানুষ সত্য’- এই মতের প্রতিপোষক লালন তাঁর গানের ভেতর দিয়ে যে মরমি ভুবন নির্মাণ করেছিলেন তা সমকালকে যেমন উত্তরকালকেও তেমনি বিস্মিত-মুগ্ধ-অভিভূত-প্রাণিত করেছিল। গানই ছিল তাঁর আনন্দ-উপলব্ধি -গানই ছিল তাঁর জীবনবেদ। লালনই বাউলগানের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ পদকর্তা এবং সেইসঙ্গে বাউলসাধনার প্রাজ্ঞ ভাষ্যকারও।
লালন শতবর্ষেরও বেশি আয়ু পেয়েছিলেন। তিনি এই দীর্ঘজীবনে কত গান রচনা করেছিলেন, তার হদিশ মেলা ভার। তাঁর প্রামাণ্য গানের সংখ্যা প্রায় সাতশোর কাছাকাছি। মুখে মুখে রচিত বলে এবং যথাসময়ে লিপিবদ্ধ না হওয়ার কারণে অনেক গানই হারিয়ে গেছে। অবশ্য তাঁর জীবিতকালেই এইসব গানের সংগ্রহ ও প্রকাশ আরম্ভ হয়। কাঙাল হরিনাথ মজুমদার ছিলেন এই কাজের প্রথম উদ্যোগী। পরে রবীন্দ্রনাথ এ-বিষয়ে পালন করেছিলেন প্রেরণাসঞ্চারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। হরিনাথ ও রবীন্দ্রনাথের মাঝের সময়ে আরো অনেকে লালনের গান সংগ্রহ ও প্রকাশ করেছেন। উত্তরকালে লালনের গান সংগ্রহে মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, বসন্তকুমার পাল, মতিলাল দাশ, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এঁরা নিবেদিত ছিলেন। কিন্তু এর পরে লালনচর্চা ও পদ-সংগ্রহে এক ধরনের নৈরাজ্য দেখা দেয়। অজ্ঞতা কিংবা বিশেষ উদ্দেশ্য-সাধনের কারণে লালনের খ্যতি, বিকৃত, জাল, নকল গান প্রচারিত ও প্রকাশিত হতে থাকে।
লালনের প্রামাণ্য গানের একমাত্র না হলেও প্রধান উৎস তাঁর শিষ্যদের লিপিকৃত পুরনো গানের খাতা। রবীন্দ্রনাথ এমন দু’খানা খাতা সংগ্রহ করেছিলেন লালনের ছেঁউড়িয়ার আখড়া থেকে- যা এখন বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত। লালনগবেষক ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরী রবীন্দ্রনাথ-সংগৃহীত লালনের সেই গানের খাতার চিত্র-প্রতিলিপি সংগ্রহ করে তা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। মূলত তাঁর প্রয়াসেই লালনের গানের পান্ডুলিপি-সংস্করণ প্রকাশিত হলো, লালন ফাউন্ডেশনের সহায়তায় পাঠক সমাবেশ থেকে। লালন কিংবা কোন বাউল-পদকর্তার গানের এই ধরনের পান্ডুলিপি-সংস্করণ প্রকাশ এই প্রথম। নিঃসন্দেহে লালনচর্চার ইতিহাসে এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সংগ্রহ-সম্পাদনা-ভূমিকা : আবুল আহসান চৌধুরী
বাংলার লোকসংস্কৃতি-চর্চা ও লোক ঐতিহ্য-অম্বেষণের ক্লান্তিহীন এক শিল্প-শ্রমিকের নাম ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরী। তাঁর জম্ম ‘লালনের দেশ’ কুষ্টিয়ার মজমপুরে, ১৩ জানুয়ারি ১৯৫৩। ফজলুল বারি চৌধুরী (১৯০৪-১৯৭৪) ও সালেহা খাতুন (১৯১৩-১৯৮৯) তাঁর জনক জননী। পিতা ছিলেন সাহিত্যিক-সমাজসেবী-অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট। প্রফেসর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (অনার্স) ও এমএ ডিগ্রি এবং পিএইচডি উপাধি অর্জন করেন। প্রায় তিরিশ বছর অধ্যাপনা- পেশায় যুক্ত। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও বাংলা বিভাগের সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে ঐ বিভাগের সিনিয়র প্রফেসর।
ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরী মূলত প্রাবন্ধিক ও গবেষক। সমাজমনস্ক ও ঐতিহ্যসন্ধানী। তাঁর চর্চা ও গবেষণার বিষয় ফোকলোর, ঊনিশ শতকের সমাজ ও সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব, সাময়িকপত্র, আধুনিক সাহিত্য ও আঞ্চলিক ইতিহাস। অনুসন্ধিৎসু এই গবেষক সাহিত্যের নানা দুষ্প্রাপ্য ও বিলুপ্তপ্রায় উপকরণ সংগ্রহ-উদ্ধার করে ব্যবহার করেছেন। তাঁর লালন সাঁই, কাঙাল হরিনাথ ও মীর মশাররফ হোসেন-বিষয়ক গবেষণা-কাজ দেশে-বিদেশে সমাদৃত হয়েছে।
লালনচর্চার তাঁর খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার কথা বিশেষ উল্লেখ্য। লালন ও অনুষঙ্গী বিষয়ে এ-পর্যন্ত তাঁর আটটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০০-এ অর্জন করেছেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লালনমেলা সমিতির লালন পুরস্কার। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৬৫। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ডক্টর চৌধুরীর প্রথম বই স্বদেশ আমার বাঙলা (১৯৭১, কলকাতা)। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : কুষ্টিয়ার বাউলসাধক (১৯৭৪), কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৯৮৮), জগদীশ গুপ্ত (১৯৮৮), লালন শাহ (১৯৯০), মনের মানুষের সন্ধানে (১৯৯৫), পাগলা কানাই (১৯৯৫), মীর মশাররফ হোসেন : সাহিত্যকর্ম ও সমাজচিন্তা (১৯৯৬), লোকসংস্কৃতি-বিবেচনা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (১৯৯৭), আব্বাসউদ্দিন (২০০২), অন্তরঙ্গ অন্নদাশঙ্কর (২০০৪), আলাপচারী আহমদ শরীফ (২০০৭)। সম্পাদিত গ্রন্থ : লালন স্মারকগ্রন্থ (১৯৭৪), ভাষা-আন্দোলনের দলিল (১৯৮৮), ভাষা-আন্দোলনের দলিল (১৯৮৮), কাজী মোতাহার হোসেন রচনাবলী (১৯৯২), মহিন শাহের পদাবলী (১৯৯৩), প্রসঙ্গ হাসন রাজা (১৯৯৮), রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত পত্রাবলি (২০০০), লালনসমগ্র (২০০৮)। ডক্টর চৌধুরী ফোকলোর-বিষেয়ক গবেষণা-পত্রিকা লোকসাহিত্য পত্রিকা-রও (১৯৭৫-১৯৮৪) সম্পাদক ছিলেন।
Download
Manuscript of Songs of Lalon Collected by Rabindranath Tagore Compiled and Edited by Dr. Abul Ahsan Choudhury [195 Pages, 14 MB, Amarboi.com]