সুনীল কি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর যাত্রার দিন এগিয়ে আসার কথা? প্রিয় কবির নতুন কাব্যের কাছে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে, মনে হল এই কথাটি প্রথম। কেন না, এ কাব্যের প্রতিটি কবিতার চরণ ছুঁয়ে ছুঁয়ে মৃত্যুর অনিবার্য উপস্থিতি। এবং কাব্যের নাম যখন, ‘নিজের কাছেই একটু একটু অপরিচিত’!
একচল্লিশটি কবিতা নিয়ে এবার বইমেলায় আনন্দ প্রকাশনার সিগনেট প্রেসের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে সুনীলের এই নতুন কাব্যগ্রন্থটি। সঙ্গে শেক্সপিয়ারের জনপ্রিয় ট্র্যাজেডি ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ এর কবিকৃত অনুবাদ। আশির দশকে গীতা মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘রূপসা’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘রোমিও জুলিয়েট’। ৮২-র মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রকাশিত হলেও কবির ব্যস্ততার কারণে বন্ধ হয়ে যায় অনুবাদের কাজ। এবার সেই অসম্পূর্ণ অনুবাদ দু’ মলাটে এল, এ কাব্যে।
প্রথম কবিতা, ‘স্বাতী, তোমার সঙ্গে’। শুরু করছেন এভাবে, ‘প্রথম চিঠিতে দেখা, তারপর ছন্নছাড়া কত ঘোরাঘুরি/ প্রথম আলাপের দু’ বছর সাতাশ দিন পর/ একসঙ্গে বাড়ি ফেরা/ অনেকেই ভুরু কুঁচকেছিল, আর অনেকে কী জানি...’। এ তো যেতে যেতে ফিরে তাকানোর ভঙ্গি। যেন, নিভৃতে স্মৃতির কাছে রেকাব পেতেছেন কবি। ‘দেশ’ পুজোবার্ষিকীতে প্রকাশিত এই কবিতা ,‘এক সন্তান’ বা, ‘এখন যে কোনও মৃত্যুই’ কবিতা যেন সুনীলের বিধুর ফ্যামিলি অ্যালবাম। কবি সুবোধ সরকার ‘পাঠক তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখছেন, ‘যে অ্যালবাম খুলে বসলে নতুন একজন সুনীলকে দেখা যাবে- বউ আর ছেলের জন্য এত মমতা, মানুষের জন্য এত মন ভাল করা উদ্বেগ, শান্তিনিকেতনে উঠোনের কোনায় দাঁড়ানো গাছটির জন্য যেন একটা ম্যানিফেস্টো লিখে রেখে গেলেন’। জায়ার জন্য ‘সময় সমগ্র’-তে ‘সনির্বন্ধ শেষ মিনতি’ জানিয়ে গেলেন, ‘তুমি স্বাতীকে সহসা ছুঁয়ো না’!
একই কবিতার কোলন, কমা, সেমিকোলনে থামতে থামতে বদলে যায় কবিতার পরিচিত অর্থ-বোধ। চেনা ভাষ্যের অন্তরাল সরিয়ে খুলে যায় একে একে কবিতার অন্তরমহলে নিহিত সত্যের হাজার দুয়ার! এ কাব্যে সুনীলের ‘কবিতার গল্প কিংবা গল্পের কবিতা’ শীর্ষক কবিতাটি ঠিক তেমন।
হয়তো কথাসাহিত্যে সফলতার হাত ধরে এ কবিতায় স্মৃতিকাতর কবি কথক বলেই, গল্পের তরে পাঠক-হৃদয়ে এসে লাগে ভাললাগার ঝিলমিল রঙ! সুনীলের এই প্রবণতা তাঁর ‘বন্দী জেগে আছো’ কাব্যের কাল থেকে। এই কবিতার মতো, হৃদয়বান পাঠক খেয়াল করবেন ‘কেউ কথা রাখেনি’, ‘নীরার অসুখ’, ‘বাড়ি ফেরা’ বা, ‘না পাঠানো চিঠি’ প্রভৃতি কবিতাতেও গল্পের আদল। তাঁর কবিতায় গল্পের আদল প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়- একাকিত্বে কিংবা জনতায়’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে তাই অধ্যাপক কুন্তল রুদ্র লিখছেন, ‘তাঁর কবিতায় একটি চিত্রের বলয় গড়ে ওঠে, কোথাও তার সঙ্গে এসে দাঁড়ায় চরিত্রের আদলে কিছু মানুষের মুখ। ... সুষ্ঠভাবে এই প্রবণতা ধরা পড়ে ‘বন্দী জেগে আছো’ কাব্যগ্রন্থ থেকে’। এ কবিতায় কবিতার ‘কাঠবেকার আমি’-র সঙ্গে নয়না নামের এক মেয়ের গল্পে চিত্রার্পিত। প্রথাগত কোনও ছক নেই, নয়নাকে নিয়ে গল্প বলাতেই যেন কবির আনন্দ। এক মেঘদূত সন্ধ্যায় টিউশন পড়াতে গিয়ে ‘মেধাবিনী’ মৃগনয়না নয়নার একটি স্তন অনধিকার স্পর্শের লোকলজ্জা বইতে বইতে কবিতার শেষে পর্বে এসে দাঁড়িয়েছেন, জীবনের প্রান্তবেলায়। হাসপাতালের কিউবিকলের নির্জনে, প্রৌঢ়া নয়না নিজেই কাতর হয়ে তার অন্য একটি স্তন ছুঁয়ে দেবার জন্য কিশোরীবেলার সেদিনের টিউটরকে বলেছে, ‘ওগো মাস্টারমশাই তুমি আমার এই দিকটা ছুঁয়ে ছিলে/ অন্য দিকটা ছোঁওনি, সে জন্য সে বেচারির অভিমান/ এখনও মাঝে মাঝেই আমাকে তা জানায়/ শোনো, জরুরি কথাটা হচ্ছে, তোমাকে একবার/ এই দিকের বুকটা একবার ছুঁয়ে দিতেই হবে/ নিজের হাত তুলে স্বেচ্ছায়’! কবিতার ‘আমি’ নয়নার ইচ্ছেপূরণ না করেই ফিরিয়ে দেয়। মৃত্যুচেতনার সঙ্গে জড়িয়ে যায় যৌনচেতনা। ‘সে চলে যাবার পর’ তাই কবি লেখেন স্পর্শগম্য থেকে হৃদিগম্য উড়ানের এক অক্ষয় সত্যের কথা। ‘এক মহিলার একটা স্তন ছোঁয়া বাকি আছে সে জন্য/ আমাকে বেঁচে থাকতে হবে’। গদ্যের স্পর্ধা অগণন কবিতার চুড়োয় যেন কাব্যের হিরণ্ময় দ্যুতি!
‘কবিতার সুখদুঃখ’ গদ্যে সুনীল লিখেছিলেন, ‘ব্যক্তিগত অনুভূতি ছাড়া আর কোনো কিছুই আমার সম্বল নেই- সাহিত্যের কাছে আমি অসহায়’। সে অভিজ্ঞতা স্তরে স্তরে তাঁর ‘সংবিৎকে’ ভিতরের দিকে ও বাইরের দিকে বাড়িয়ে তুলেছে, যা তিনি বলেছেন কবিতায়। ‘নারী’ এই চিরন্তন শব্দের অক্ষয় অনুষঙ্গে ‘নীরা’ নয়, এ কাব্যে ‘নারী’ শব্দটি এসেছে কবিতার শীর্ষকে দু’বার। প্রথমটি ‘নারীরা শুধুই নারী’ এবং পরের বার ‘নারী ও শিল্প’ কবিতার শীর্ষকে। প্রথমটি যদি হয় স্মৃতির রানওয়ে থেকে ‘নারী ছাড়া সৃষ্টি অসম্ভব’ কথাটির উড়ান, দ্বিতীয় কবিতায় কবির ঘরে ফেরা।
প্রথমে বিষ্ণু দে, পরে বুদ্ধদেব বসুর কবিতার সুঁড়ি পথে সুনীলের কাব্য-সঙ্গীতের যে বিস্তার শুরু হয়েছিল, এ কাব্য যেন সমে ফেরা। নাতিদীর্ঘ চরণ বিন্যাসে ‘পাখির চোখে দেখা’ সে ফেরার পর্বে যেন এক একটি তান-তোড়-ঝালা! অনবদ্য এই কবিতা সিরিজ। যে এককের কথায় শুরু হয়ে ছিল এ নিবিড় পাঠ-লেখা, কবির সেই বিশেষ প্রবণতা সিরিজ হোক বা, ‘পলাতকের কবিতা’, ‘দ্বিধা’, ‘দেওয়াল’, ‘মুহূর্ত ভাঙার শব্দ’- এর মতো কবিতায়, সর্বত্র দীপিত। সবখানে নিঃসঙ্গ এক মানুষের স্মৃতিকাতরতা এবং মৃত্যুর বিষম শব্দের ঝনঝনি! ‘বৃষ্টিতে অমলেন্দু’ তাই ‘একলা অন্ধকার চেয়ারে’ বসে থাকে! ‘কথা রাখা না রাখার কবিতা’-র শেষে কোনও পূর্ণযতি না দিয়ে সুনীলকে লিখতে হয়, ‘শহরতলির রাত্রি ঘন হল, ডেকে উঠল একটি রাতপাখি/ দেহের আকার নেই, তবু ইতস্তত ঘোরে কয়েকটি জোনাকি...’!
Download
Nijer Kachei Ektu Aporichito - Sunil Gangopadhyay [139 pages, 2 mb, amarboi.com]