Ticker

6/recent/ticker-posts

ঋতুপর্ণ ঘোষ

amarboi.comরোববার জুন ০৯, ২০১৩। ঋতুপর্ণ সংখ্যা।
ঋতুপর্ণ ঘোষ (৩১ অগস্ট, ১৯৬৩ - ৩০ মে, ২০১৩) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক। অর্থনীতির ছাত্র ঋতুপর্ণ ঘোষের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট হিসেবে। ১৯৯২ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম ছবি হীরের আংটি। দ্বিতীয় ছবি উনিশে এপ্রিল মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। এই ছবির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পান।
ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের অনুরাগী। দুই দশকের কর্মজীবনে তিনি বারোটি জাতীয় পুরস্কারের পাশাপাশি কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ৩০ মে কলকাতায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।
১৯৬৩ সালের ৩১ অগস্ট কলকাতায় ঋতুপর্ণ ঘোষের জন্ম। তাঁর বাবা-মা উভয়েই চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাবা সুনীল ঘোষ ছিলেন তথ্যচিত্র-নির্মাতা ও চিত্রকর। ঋতুপর্ণ ঘোষ সাউথ পয়েন্ট হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ডিগ্রি অর্জন করেন।
ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন ভারতের এলজিবিটি সম্প্রদায়ের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। জীবনের শেষ বছরগুলিতে তিনি রূপান্তরকামী জীবনযাত্রা নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন। তিনি নিজের সমকামী সত্ত্বাটিকে খোলাখুলিভাবে স্বীকার করে নেন, যা ভারতের চলচ্চিত্র জগতের খুব কম মানুষ করেছেন।
চলচ্চিত্র জগতে আসার আগে ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন কলকাতার একজন "অ্যাডভারটাইসমেন্ট কপিরাইটার"। ১৯৮০-র দশকে বাংলা বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় বেশ কিছু জনপ্রিয় এক লাইনের শ্লোগান লিখে দিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় কলকাতায় ইংরেজি ও হিন্দি বিজ্ঞাপনগুলি বাংলায় অনুবাদ করে চালানো হত। ঋতুপর্ণ বাংলায় স্বতন্ত্র বিজ্ঞাপনী শ্লোগানের ধারা সৃষ্টি করেন। তাঁর সৃষ্ট বিজ্ঞাপনগুলির মধ্যে শারদ সম্মান ও বোরোলিনের বিজ্ঞাপনদুটি বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। কোনো কোনো সমালোচকের মতে, (বিজ্ঞাপনী চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে) দর্শকদের কাছে আবেদন পৌঁছে দেওয়ার এক বিশেষ দক্ষতা তিনি অর্জন করেছিলেন, যা তাঁর ছবি বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে জনপ্রিয় করে তোলে।
ঋতুপর্ণ ঘোষের কর্মজীবন শুরু হয় বিজ্ঞাপনী দুনিয়ায়। তাঁর পরিচালনায় প্রথম ছবি হিরের আংটি ১৯৯২ সালে মুক্তি পায়। এটি ছিল ছোটোদের ছবি। ছবিটি তৈরি হয়েছিল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাস অবলম্বনে। এতে অভিনয় করেছিলেন বসন্ত চৌধুরী, মুনমুন সেন প্রমুখেরা।
১৯৯৪ সালে তাঁর দ্বিতীয় ছবি উনিশে এপ্রিল মুক্তি পায়। এই ছবিতে এক মা ও তাঁর মেয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের কাহিনি দেখানো হয়েছে। ছবিটি সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবেও সফল হয়। ১৯৯৫ সালে এই ছবি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পায়।[৪] এরপর দহন মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালে। ১৯৯৮ সালে এই ছবি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায় এবং এই ছবির দুই অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও ইন্দ্রাণী হালদার একসঙ্গে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পান। দহন ছবির বিষয়বস্তু কলকাতার রাস্তায় এক মহিলার ধর্ষিত হওয়ার কাহিনি। অপর একটি মেয়ে সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। সে এগিয়ে আসে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু সমাজ ও ধর্ষিতার পরিবার পরিজনের ঔদাসিন্যে সে হতাশ হয়।
১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া অসুখ ছবিতে এক অভিনেত্রী ও তাঁর আয়ের উপর অনিচ্ছুকভাবে নির্ভরশীল বাবার সম্পর্ক দেখানো হয়। এটি শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। বাড়িওয়ালি মুক্তি পায় ২০০০ সালে। এই ছবিতে এক নিঃসঙ্গ বিধবা (কিরণ খের) নিজের বাড়িটি এক ফিল্ম প্রোডাকশনকে ভাড়া দেন। তাঁর অবদমিত কামনাবাসনাগুলি ছবির সুদর্শন পরিচালককে নিয়ে কল্পনার ডানা মেলে। এই ছবির জন্য কিরণ খের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পান।
২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত উৎসব শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। এই ছবির বিষয়বস্তু এক একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন। এই পরিবারের সদস্যরা তাদের পারিবারিক বাড়ি থেকে বেশি দূরে না থাকলেও বছরে শুধু একবার দুর্গাপূজার সময় একত্রিত হয়। ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি তিতলি-র গল্প এক অভিনেত্রীর মেয়েকে কেন্দ্র করে। মেয়েটির প্রিয় ফিল্মস্টারের সঙ্গে এক সময় তার মায়ের প্রণয় সম্পর্ক ছিল।
২০০৩ সালে আগাথা ক্রিস্টির দ্য মিরর ক্র্যাকড ফ্রম সাইড টু সাইড অবলম্বনে ঋতুপর্ণ তৈরি করেন একটি "হুডানইট" রহস্য ছবি শুভ মহরত। এই ছবিতে বিশিষ্ট অভিনেত্রী রাখী গুলজার ও শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে অভিনয় করেন নন্দিতা দাস। এই বছরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ঋতুপর্ণ তৈরি করেন চোখের বালি। এই ছবিতেই তিনি প্রথম বলিউড অভিনেত্রী ঐশ্বর্যা রাইকে নিয়ে কাজ করেন।
২০০৪ সালে ঋতুপর্ণের প্রথম হিন্দি ছবি রেনকোট মুক্তি পায়। এই ছবিটি ও. হেনরির ছোটোগল্প "দ্য গিফট অফ দ্য ম্যাজাই" (১৯০৬) অবলম্বনে নির্মিত। এই ছবিতেও ঐশ্বর্যা রাই অভিনয় করেছিলেন। এই ছবির শ্যুটিং শেষ হয়েছিল ১৭ দিনে। ছবিটি শ্রেষ্ঠ হিন্দি ছবি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।
২০০৫ সালে তাঁর বাংলা ছবি অন্তরমহল মুক্তি পায়। এটি ব্রিটিশ আমলের এক জমিদার পরিবারের গল্প। জ্যাকি শ্রফ জমিদার চরিত্রট করেন; আর তাঁর দুই স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেন সোহা আলি খান ও রূপা গাঙ্গুলি।
২০০৭ সালে দ্য লাস্ট লিয়ার মুক্তি পায়। এটি একটি প্রাক্তন শেক্সপিয়ারিয়ান থিয়েটার অভিনেতার জীবনের গল্প। অমিতাভ বচ্চন কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। এছাড়া প্রীতি জিন্টা ও অর্জুন রামপালও এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।
২০০৮ সালে মুক্তি পায় খেলা। এটি মানব সম্পর্কের গল্প। এটি মণীষা কৈরালার প্রথম বাংলা ছবি। এই বছরই মুক্তি পায় তাঁর সব চরিত্র কাল্পনিক। প্রসেনজিৎ ও বিপাশা বসু অভিনীত এই ছবিটি শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।
২০০৯ সালে যিশু সেনগুপ্ত, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, দীপংকর দে ও মমতা শঙ্কর অভিনীত ছবি আবহমান মুক্তি পায়। এটি শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।
মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর পরবর্তী ছবি সত্যান্বেষী-র শ্যুটিং শেষ করেছিলেন। এই ছবিটি গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর কাহিনি অবলম্বনে তৈরি হচ্ছিল।
ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রথম অভিনয় করেন ওড়িয়া ছবি কথা দেইথিল্লি মা কু-তে। হিমাংশু পারিজা পরিচালিত এই ছবিটি মুক্তি পায় ২০০৩ সালে। ২০১১ সালে তিনি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের আরেকটি প্রেমের গল্প এবং সঞ্জয় নাগের মেমরিজ ইন মার্চ ছবিতে অভিনয় করেন। আরেকটি প্রেমের গল্প ছবির বিষয় ছিল সমকামিতা।
ঋতুপর্ণের শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি চিত্রাঙ্গদা। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদার কাঠামো অবলম্বনে নির্মিত। এটি ৬০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বিশেষ জুরি পুরস্কার পায়।
ঋতুপর্ণ দুটি সেলিব্রিটি চ্যাট শো সঞ্চালনা করেন। এগুলি হল ইটিভি বাংলার এবং ঋতুপর্ণ এবং স্টার জলসার ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানি। ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানির একটি পর্বে তিনি মীরের সাক্ষাৎকার নেন। এটি কিছু বিতর্ক সৃষ্টি করে।
ঋতুপর্ণ বাংলা ফিল্ম ম্যাগাজিন আনন্দলোক সম্পাদনা করেন ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত।