ধনপতির সিংহলযাত্রা রামকুমার মুখোপাধ্যায়
Dhanapatir Sinhaljatra - Ramkumar Mukhopadhyay
বারো বছরের কারাবাস শেষ। পুত্র ও পুত্রবধূকে নিয়ে দেশে ফিরছেন ধনপতি। তখনই চণ্ডীর আশীর্বাদে নদীর অতল থেকে ভেসে উঠল সদাগরের সাত ডিঙা। মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে তা-ও বারো বছরের সময়সীমা ছিল। কিন্তু আধুনিক বাংলায় কোনও সাহিত্য পুরস্কারের অনুষ্ঠানে কত দিন বাদে ভেসে উঠল ‘মঙ্গলকাব্য’, ‘কমলেকামিনী’ বা ‘পলাকড়ি’ শব্দগুলি? ‘ধনপতির সিংহলযাত্রা’ উপন্যাসের জন্য ১৪১৯ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হলেন রামকুমার মুখোপাধ্যায়। সেই অনুষ্ঠানেই পৌরোহিত্য করতে এসে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী উপন্যাসটি সম্পর্কে জানালেন, ‘‘ভাষা নিয়ে চমৎকার পরীক্ষা। বাংলায় বাক্যগঠনের রীতিতে অনেক হারিয়ে-যাওয়া শব্দ ব্যবহার করেছেন রামকুমার। যেমন, পলাকড়ি। মানে, পটল। কিন্তু শব্দটি আজ আর আমরা ব্যবহার করি না।’’
ধনপতির সিংহলযাত্রা রামকুমার মুখোপাধ্যায় [১৪১৯ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত]বাঙালি বিস্মৃতিপ্রবণ অথবা আত্মবিস্মৃত জাতি বলিয়া প্রায়শ নিন্দিত হইয়া থাকে। আধুনিক বঙ্গসাহিত্য যতটা বিদেশি ভাষার সাহিত্য-প্রভাবিত সেই তুলনায় প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যের দিকে তাহার নজর নাই এমন অভিযোগও প্রায়শ শুনা যায়। কিন্তু অতি সাম্প্রতিক বাংলা উপন্যাসের ধারাটি বিচার করিলে দেখা যাইবে এমনতর অভিযোগ সর্বাংশে সত্য নহে। সমসাময়িক উপন্যাস এক্ষণে অনেক ক্ষেত্রেই আখ্যানবস্তুর জন্য প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যের দ্বারস্থ হইতেছে। দ্বারস্থ কথাটির মধ্যে একটি শরণ লইবার ভাব আছে, কিন্তু আপাতত সেই লইয়া তর্ক তুলিয়া রাখা যাউক।
দুইটি উপন্যাসের সূত্রে সম্প্রতি দেখিতেছি প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যের একপ্রকার যেন নবজন্ম ঘটিতেছে। একুশ শতকীয় কথাসাহিত্যে চর্যাগীতির কবি কাহ্ন-র পুথিপত্রে বিবর্ণ হইয়া পড়া জীবনকে রক্তমাংস-সহ নবজীবিত করিয়াছেন শিবাশিস মুখোপাধ্যায়, তাঁহার কাহ্ন (সপ্তর্ষি) উপন্যাসে। এ বঙ্গে এমনতর কাজ এই প্রথম। আবার চণ্ডীমঙ্গলের ধনপতি-উপাখ্যান লইয়া রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস ধনপতির সিংহলযাত্রা (মিত্র ও ঘোষ) সেই সময়ের কাহিনির বিনির্মাণ করিয়াছে আধুনিকতার প্রেক্ষাপটে। বর্তমান সময় জমজমাট আখ্যানের জন্ম দিতে পারিতেছে না বলিয়াই এই উজান-যাত্রা কি না সে তর্ক এ স্থলে অবান্তর। বাংলা উপন্যাস প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যের শিকড় পুনর্বার উন্মোচন করিতেছে ইহা আশার কথা, আনন্দেরও।