গত সোমবার যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের রায় হওয়া পর পুরো দেশে আশাভঙ্গের একটি দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেছে। তরুণ প্রজন্মের প্রতিক্রিয়া ছিল সবচেয়ে তীব্র। প্রথমে ক্রোধ তারপর ক্ষোভ আর দুঃখ এবং সর্বশেষে হতাশা। আমার সাথে পরিচয় আছে এরকম অনেকের সাথে ফোনে কথা বলে তাদের শান্তনা দিতে হয়েছে, উৎসাহ দিতে হয়েছে।
বিচারের রায় নিয়ে হতাশার কারণ কী? গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে তার প্রত্যেকটি প্রমাণিত হয়েছে। সম্মানিত বিচারকেরা পরিষ্কার করে বলেছেন সর্বোচ্চ শাস্তিই তার প্রাপ্য ছিল, শুধু বয়সের কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে নব্বই বছরের জেল দেয়া হয়েছে। একানব্বই বছরের একজন যুদ্ধাপরাধীর পরবর্তী নব্বই বছর জেলে থাকা মৃত্যুদণ্ড থেকে কোনো অংশে কম নয়, তাহলে কেন আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম এতো হতাশ? কেন তাদের মনে হচ্ছে তারা ন্যায় বিচার পায়নি?
কারণ খুব সহজ। বাংলাদেশের ইতিহাসের যা কিছু অশুভ তার প্রতীক হচ্ছে গোলাম আযম। স্বাধীনতা যুদ্ধে এই দেশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছে যে মানুষটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী তৈরি করে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে এই দেশের মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবার পরিকল্পনা আর প্ররোচনা করেছে যে ব্যক্তি তার নাম গোলাম আযম।
মুক্তিযুদ্ধের শেষে পরাজয় আসন্ন জেনে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়া, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই নূতন দেশটির বিরুদ্ধে প্রচারণা করা, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে দেশের পট পরিবর্তন হওয়ার পর দেশে পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে ফিরে আসা, কূট কৌশলে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে আবার জামায়েতে ইসলামীর নেতৃত্ব দেয়া এর কোনটিই তো এ দেশের মানুষের অজানা নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাঁচটি গণহত্যার একটিতে নেতৃত্ব দিয়েও তার জন্যে বুকের ভেতর কোনো দূঃখ নেই, অনুতাপ নেই। বরং সদম্ভে ‘একাত্তরে কোন ভুল করিনি’ বলে নূতন একটি প্রজন্মকে বাংলাদেশের আদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড়া করানো, মুক্তিযুদ্ধকে ঘৃণা করে, সাম্প্রদায়িকতাকে গ্রহণ করে ষড়যন্ত্র করতে শেখানো এর সবকিছুর মূলে গোলাম আযম।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সকল অশুভ শক্তির প্রতীক হচ্ছে গোলাম আযম, এই দেশের শিশুরা যখন একটি রাজাকারের ছবি আঁকার চেষ্টা করে, তারা যে মানুষটির চেহারা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে সেই মানুষটি হচ্ছে গোলাম আযম। তাই এই দেশের মানুষের আশা ছিল দেশের বিরুদ্ধে থাকা সবচেয়ে বড় যুদ্ধাপরাধীর শাস্তিটিও হবে সর্বোচ্চ শাস্তি। সেটি হয়নি। এই তরুণ প্রজন্মের মন খারাপ কারণ তারা ইতিহাসের খাতায় লিখিয়ে হতে পারল না, এই দেশে সবচেয়ে বড় যুদ্ধাপরাধীকে সবচেয়ে বড় শাস্তিটি পেতে হয়েছে। তাদের মন খারাপ তো হতেই পারে।
আমার পক্ষে সম্ভব হলে আমি দেশেরে সব তরুণের কাছে গিয়ে বলতাম- তোমরা মন খারাপ করো না। হতাশ হয়ো না। আমরা যারা একাত্তরের ভেতর দিয়ে এসেছি তারা জানি, তখন কী ভয়ঙ্কর একটা পরিবেশ ছিল কিন্তু তারপরেও এই দেশের মানুষ হতাশ হয়নি। তারা হতাশ হয়নি বলেই আমারা আমাদের দেশ পেয়েছি –একাত্তরের এই শিক্ষাটা সবাইকে নিতে হবে। রাগ হতে পারে, দুঃখ কিংবা ক্ষোভ হতে পারে কিন্তু হতাশ হওয়া যাবে না। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, সেক্টর কমান্ডার ফোরামের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যেটাকে নূতন করে উজ্জীবিত করেছেন সেটি শুরু হয়েছে শুধু তরুণ প্রজন্মের কারণে। তারা তীব্রভাবে এটা চেয়েছিল বলে চল্লিশ বছর পরে হলেও আমরা গ্লানিমুক্ত হতে চলেছি।
তরুণ প্রজন্ম যদি তীব্রভাবে চায় তাহলে এই দেশে জামায়াত শিবিরের রাজনীতিও নিষিদ্ধ হবে, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প চিরদিনের জন্যে মুছে যাবে। তারা যদি চায় তাহলে হেজাফতে ইসলামের মতো সংগঠনগুলোয় তীব্র নারী বিদ্বেষ থাকার পরও এই দেশের নারী পুরুষ পাশাপাশি দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে। শুধু তাদের এটা চাইতে হবে।
আমি জানি তাদের ভেতর আরো একটা দুর্ভাবনা কাজ করছে। সেটি হচ্ছে, সরকার পরিবর্তন হলে কী যুদ্ধাপরাধীরা শাস্তি না পেয়েই বের হয়ে আসবে? বিষয়টি এতো সহজ নয়, সবচেয়ে বড় কথা এই সরকারের তিন চতুর্থাংশ মেজরিটি নিয়ে তারা তো সংবিধানে একটা সংশোধনী করে যেতেই পারে, ভবিষ্যতে কোনোভাবেই যেন যুদ্ধাপরাধীরা মুক্ত হতে না পারে। হয়তো এখন আমাদের সেটাও দাবি করতে হবে।
যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়াটি আমি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করেছি। এই দেশের বিরুদ্ধে তার অবস্থানটি গোপন কিছু নয়, সেটি নিয়ে কোনো অনুতাপ নেই, দোষ স্বীকার করা নেই, দুঃখ নেই, ক্ষমা ভিক্ষা নেই তাহলে কেন মাথা উঁচু করে পাকিস্তানের জন্যে আনুগত্যের কথা স্বীকার করে সত্যটি প্রকাশ করে দেয়া হয় না। কেন মিথ্যাচার করে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ট্রাইবুনালের সামনে মাথা নিচু করে শাস্তি গ্রহণ করতে হয়।
আমার তখন রাজশাহীর রোহনপুরের সেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধার কথা মনে পড়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসারের লেখা বইয়ে উল্লেখ আছে, একাত্তরের জুন মাসে সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর যখন তার বুকে অস্ত্র ধরে তাকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছে, সে তখন গোলাম আযমের মতো মিথ্যাচার করে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেনি। নিচু হয়ে মাতৃভূমির মাটিকে শেষবার চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল- আমি মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত, আমার রক্ত আমার প্রিয় দেশটাকে স্বাধীন করবে।
এতো রক্তে পাওয়া এই দেশ, এই দেশকে যুদ্ধাপরাধের গ্লানি থেকে মুক্তি করতেই হবে। একাত্তরে তরুণেরা করেছিল, এখন আবার তরুণদেরই করতে হবে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১৬ জুলাই ২০১৩
1 Comments