Ticker

6/recent/ticker-posts

হুমায়ূন আহমেদ জনম জনমের বন্ধু - মুনীর আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ জনম জনমের বন্ধু - মুনীর আহমেদকালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন। অনুজপ্রতিম বন্ধু। এখন খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। একুশে বইমেলায় মিলনের উপস্থিতিতে তার প্রকাশকের স্টল থেকে কোনো দিন বই কিনতে পারিনি। নিজের সদ্য লেখা বইগুলো এমন এক ভঙ্গিমায় হাতে তুলে দেয় যে মূল্য পরিশোধের কোনো সুযোগ রাখে না। মাঝেমধ্যে বইমেলায় গেলে বুদ্ধি করে মিলনের অনুপস্থিতিতে তার লেখা কয়েকটা বই চটজলদি কিনে সরে আসি। দুদিন আগে সন্ধ্যায় পত্রিকার পক্ষ থেকে টেলিফোনে অনুরোধ এলো, হুমায়ূন আহমেদের বন্ধু হিসেবে তার মৃত্যুদিবস উপলক্ষে পত্রিকার জন্য একটি লেখা দিতে হবে। একটু ইতস্তত ভাব করতেই টেলিফোনের ওপাশ থেকে বলল, হাতে সময় নেই। পরদিনই লেখা নিতে আসবে।
হুমায়ূনের মৃত্যু বিষয়ে আমি এমনিতেই স্পর্শকাতর। আমার ধারণা, প্রতিটি মানুষই একই সময়ে দুটো জগতে বাস করে। একটি বাইরের জগৎ, আরেকটি মনোজগৎ। আমার মনোজগতের ব্যক্তিদের মধ্যে হুমায়ূন একজন। সে তার মৃত্যুকে ডিঙিয়ে আমার মনোজগতে বেঁচে আছে। হুমায়ূন নেই- এটা আমার মনে আসে না। তার নিজের লেখালেখিতেই বেঁচে আছে। অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে হুমায়ূনের লেখা যেকোনো বইয়ের কয়েক পাতা প্রায় প্রতিদিনই পড়া হয়, এটা চিরাচরিত অভ্যাস। বাসার অন্যদেরও একই অবস্থা। হুমায়ূনের লেখা প্রায় সব বইয়ের সংগ্রহ বাসায় আছে। আগে যে বইগুলো তেমন পড়া হয়নি, বিগত এক বছরে সেগুলোও পড়া হয়ে গেছে। তার লেখা অনেক বই এমন যে বইয়ের যেকোনো জায়গা থেকে পড়া শুরু করা যায়। আমার মতে, এর কারণ হলো, তার সাবলীল ধরনের লেখার প্রতিটি চরিত্রকে মহান গুরুত্ব দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়। হুমায়ূনের নাটকের চরিত্রের বেলায়ও একই কথা খাটে। তার সাড়াজাগানো নাটক 'এইসব দিনরাত্রি', 'বহুব্রীহি', 'অয়োময়', 'কোথাও কেউ নেই' এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। উপন্যাসের ক্ষেত্রেও একই উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, বাদশাহ হুমায়ুনকেন্দ্রিক 'বাদশাহ নামদার' উপন্যাসে বৈয়াম খাঁসহ আরো কয়েকটি চরিত্র গুরুত্ব পেয়েছে। অনেক সময় মনে হয়েছে, সেনাপতি বৈয়াম খাঁ রাজ্যহারা বাদশাহকেও ছাড়িয়ে গেছে। এক লেখকের ভাষায়- মৃত্যুর পর একজন লেখক বই হয়ে যায়। হুমায়ূনের মৃত্যুর পর বিভিন্ন শোকসভায় বিজ্ঞজনরা বলেছেন, 'যত দিন বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা থাকবে, তত দিন হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকবে।' হুমায়ূন-অনুজ আহসান হাবীব বলেছিল, হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুদিবস পালিত হবে না, শুধু জন্মদিবস পালিত হবে। বইয়ের দোকানে অথবা পাঠাগারে গেলে দেখা যায়, হুমায়ূনের লেখা সারি সারি বই। গত একুশে বইমেলায়ও দেখা গেছে, হুমায়ূন আহমেদের বই প্রকাশকদের স্টলের সামনে ভক্ত ও ক্রেতাদের ভিড়।
৪৫ বছরের দেখা হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে লেখার শুরু ও শেষ কোথায়, তা নির্ণয় করা কঠিন। গত বছরের একুশে বইমেলায় অন্য প্রকাশ কর্তৃক প্রকাশিত 'হুমায়ূন আহমেদ ও যত কথা' বইতে কিছু টুকরো টুকরো ঘটনা ও স্মৃতিকথা সীমিত শব্দে ও বাক্যে তুলে ধরেছিলাম। যাঁরা বইটিতে চোখ বুলিয়েছেন, তাঁরা প্রশ্ন রেখেছেন, এত এত ঘটনার সমাহার, কিন্তু লেখার অবয়ব এমন সংক্ষিপ্ত কেন? আমি তো কথাশিল্পী নই যে প্রতিটি ঘটনাকে পল্লবে-পুষ্পে মঞ্জরিত করে ফুটিয়ে তুলব! খোলা চোখে যা দেখেছি, যাতে নিজে সম্পৃক্ত থেকেছি তা লেখনীতে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র। দিন কয়েক আগে পল্লবীতে গিয়েছিলাম, খালাম্মা আয়েশা ফয়েজ বললেন, 'বাবা, হুমায়ূনের মৃত্যুরও এক বছর হয়ে গেল। সময়টা যে কিভাবে কাটাচ্ছি, সময় অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে। কাটতে চায় না। আমার কাছে মনে হয়, এক যুগেরও বেশি সময়।' হাতে হুমায়ূনের একটি খোলা বই। দুচোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো বাক্য উচ্চারণ থেকে অনেক চেষ্টায় বিরত থাকলাম।
একটু পরে জিজ্ঞেস করলেন, 'তুমি হুমায়ূনের কবর দেখতে কবে গেছ?' বললাম, হুমায়ূনকে কবরে দাফনের পর এক দিনও যাইনি। আমার যেতে ইচ্ছে করে না। একদিন হয়তো যাব।
যেদিন হুমায়ূনকে নুহাশপল্লীতে কবর দেওয়া হয়, সেদিনের পড়ন্ত বিকেলে লিচুবাগানের অদূরে ঔষধি বাগানের ধারে একটি গাছে ঠেস দিয়ে একাকী বসে আছি। রমজানের শেষ বেলা। কর্দমাক্ত ঘাসে ঢাকা ফাঁকা জায়গায় দু-একজন ইতস্তত এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছে। লিচুবাগানে উঁচু করা অনাবৃত কবরের মাটির নিচে হুমায়ূন শায়িত। কবরে কোনো ঘের নেই। ঘন গাছের ছায়ায় সূর্য ডোবার আগেই অন্ধকার নেমে এসেছে। অসহায়ের মতো কবরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটা বিরাট শূন্যতার মাঝে হৃদয়টা হাহাকার করে উঠল। একসময় কবরের পাশ দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে, হাত দিয়ে কবরের মাটি ছুঁয়ে, নুহাশপল্লীর বাইরের সীমানায় চলে এলাম। আনমনেই কয়েকবার পেছনে তাকাতে হলো। মানুষের জীবনে একটি বয়স ও সময় আসে, যখন সে আনমনে বারবার ফিরে যায় তার শৈশবে, স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনে। এর পরে মাঝখানের দীর্ঘ কর্মময় জীবনের সময়টা কিভাবে যে পার হয়ে যায়, তার হিসাব রাখা কঠিন। আমি এখন সেই প্রৌঢ়দের দলে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আহা, হুমায়ূন যদি বেঁচে থাকত!
বুয়েটের ছাত্রজীবনের এক দুপুরের কথা মনে আছে। দুপুরে ক্লাস শেষ বেরিয়ে এসে দেখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বন্ধুকে নিয়ে হুমায়ূন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। একটু অবাক হলাম, কাছাকাছি আসতেই তিনজনই একসঙ্গে বলে উঠল, দুপুরের খাবার আমাদের ডাইনিং হলে খাবে। হলের মেস ম্যানেজারকে বলে পেয়িংগেস্ট হিসেবে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে ডাইনিং হলে একসঙ্গে বসলাম। খেতে খেতে হুমায়ূন মিটমিট করে হাসছে আর আমাদের লক্ষ্য করে বলছে, পরিকল্পনাটা মন্দ নয়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে আরেক বন্ধু জানাল, আগের রাতে তিনজনে চায়নিজ খেয়েছে; আর তিনজনের কাছে থাকা বাদবাকি টাকা একত্র করে বলাকা হলে রাতের শোতে একটি ইংরেজি সিনেমা দেখেছে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকের সময়। তাদের হলের মেস বন্ধ। রাজনৈতিক আন্দোলন অস্থিরতার কারণে মানি অর্ডারও আসছে না।
তাদের কারো কাছে সকালের নাশতা খাওয়ার পয়সা নেই। দুপুরের খাবার তো দূরের কথা। তিনজন মিলে রাতেই ঠিক করল, পরদিন দুপুর পর্যন্ত একনাগাড়ে ঘুমাবে। তারপর একসঙ্গে বুয়েটে চলে আসবে। সকালের নাশতা ফাঁকি দেওয়ার উত্তম ব্যবস্থা।
একসময় তিতুমীর হলের ডাইনিং হলও বন্ধ হয়ে গেল। তখন নজরুল ইসলাম হল ও ঢাকা মেডিক্যাল হোস্টেলের পেছনে পপুলার রেস্টুরেন্টই ছিল শেষ ভরসা। এখানে আট আনা থেকে ১০ আনার মধ্যে মাংসের একটি পদসহ পেটপুরে খাওয়া যেত। গামলা ভর্তি ডাল ছিল ফ্রি। মাঝেমধ্যে এই স্বল্প পয়সারও আকাল পড়ে যেত।
ভালো খাবারের প্রতি হুমায়ূনের আকর্ষণ ছিল বরাবরের। খেত পরিমিত, তবে আয়োজন থাকতে হবে হরেক রকমের। একা খেতে পছন্দ করত না। পরিবারের সদস্য অথবা বন্ধুবান্ধব নিয়ে খাবার আয়োজনে আনন্দ পেত। লেখালেখির মাধ্যমে টাকা-পয়সার সচ্ছলতা আসার পর নিজেই প্রচুর খাবারদাবারের ব্যবস্থা করত। গল্পগুজবে, গানের আসর বসিয়ে সবাইকে মাতিয়ে রাখত।
হুমায়ূনের বেড়ানোর শখ ছিল, তা দেশেই হোক আর বিদেশেই হোক। তবে একা নয়। একবার লেখক হিসেবে সরকারি আমন্ত্রণে চীনে দীর্ঘ ভ্রমণে গিয়েছিল। পরিবার-পরিজন ছেড়ে এ আনন্দভ্রমণ তার জন্য খুব একটা সুখকর হয়নি।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এক সন্ধ্যায় হুমায়ূন আমাদের ধানমণ্ডির বাসায় রাতের খাবার খেতে বলল। উদ্দেশ্য, রাতের ফ্লাইটে লন্ডন যাচ্ছে লেখক সম্মেলনে সেখানকার বাংলাভাষীদের আমন্ত্রণে। সবাই একসঙ্গে হৈচৈ করে খাবারপর্ব শেষ করল। তিন মেয়ে হুমায়ূনের হাতে লিস্ট ধরিয়ে দিচ্ছে, কী কী আনতে হবে। স্যুটকেস গাড়িতে তোলা হলো। হুমায়ূন অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। হাতে পাসপোর্ট-টিকিট। হঠাৎ করে ঘোষণা করে বসল, লন্ডন যাওয়া বাতিল। বাচ্চাকাচ্চাদের ছেড়ে হুমায়ূন দেশের বাইরে একা যাবে না। ফোনে জানিয়ে দেওয়া হলো। লন্ডনে আয়োজকদের মাথায় বাড়ি!
শহীদুল্লাহ হলে হুমায়ূন হাউস টিউটর। তখনো গাড়ি কেনা হয়নি। শীতের এক বিকেলে আমরা দুই পরিবার ঠাসাঠাসি করে একটি জিপে চড়ে শেরে বাংলানগরে ক্রিসেন্ট লেকের পাড়ে বেড়াতে গেলাম। কৃষ্ণচূড়াগাছে ঢাকা চওড়া রাস্তার এক পাশে শানবাঁধানো ঝকঝকে-তকতকে নতুন ক্রিসেন্ট লেকে নির্মল পানি টলটলায়মান। পানিতে রংবেরঙের ফুটন্ত শাপলা ফুল। লেকের ওপারে সবুজ গাছগাছালি। রাস্তার অন্যদিকে আরেক লেকঘেরা লুই কানের অতুলনীয় স্থাপত্যকলার নিদর্শন জাতীয় সংসদ ভবন। তখন জায়গাটি অতি মনোরম ও নিরিবিলি ছিল। রাতের আলোর ব্যবস্থায় ছিল আধুনিক নতুনত্ব। এক বিদেশিকে বলতে শুনেছি, এশিয়ার আর কোথাও এমন মনোরম দৃশ্য সে দেখেনি।
হুমায়ূন চারদিকে তাকিয়ে মোহিত হয়ে গেল। বলেই ফেলল, ঢাকা শহরের বুকে এমন মনোমুঙ্কর ও দর্শনীয় স্থান থাকতে পারে! আফসোস করল, আরো আগে কেন এলো না! বললাম, গাড়ি ছাড়া এখানে পরিবার-পরিজন নিয়ে আসতে হলে কিছুটা ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়। আমেরিকায়ও অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গায় বেড়িয়েছেন। লেখালেখিতেই আছে।
হুমায়ূন বলল, আমি বুঝতে পারছি না, এটা অন্য রকম সুন্দর।
শহীদুল্লাহ হলে থাকতেই হুমায়ূন গাড়ি কিনল। কিন্তু সংসারের সদস্যসংখ্যা বেড়েছে। গাড়িতে জায়গার সংকুলান হচ্ছে না। ঢাকার বাইরে যেতে অসুবিধা। এরপর কিনল একটি মাইক্রোবাস। এবার মা-বোনদেরও জায়গার সংকুলান হবে। একটি বই লেখা শেষ অথবা একটি নাটক বা নাটকের পর্ব লেখা শেষ, অমনি দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। পরবর্তী সময়েও দেখা গেছে, স্ত্রী-সন্তান অথবা বন্ধুবান্ধব নিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছে। কখনো একা যায়নি। প্রকৃতিপ্রেমিক হুমায়ূনকে বারবার প্রকৃতি কাছে টেনেছে। তাই সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বানিয়েছে সমুদ্রবিলাস আর গাজীপুরে বানিয়েছে তার অতি প্রিয় নুহাশপল্লী। সেই পল্লীর মাটি হুমায়ূনকে চিরদিনের জন্য কোলে তুলে নিয়েছে। নব্বইয়ের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত 'জনমজনম' উপন্যাসটির উৎসর্গ পাতায় হুমায়ুন লিখেছে- আমার স্ত্রী ও আমার নাম 'প্রিয়ভাজনেষু' শব্দ যোগ করে। এখন হুমায়ূন আছে না-ফেরার দেশে। কিন্তু জনম জনমের বন্ধন থেকেই গেল।

Post a Comment

0 Comments