হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ইদানীং আমার সময় বেশ ভালোই কাটে।
না না, আমার সুস্থতা নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি সহজ কথাই বলছি। তাঁর চলে যাওয়ার বছর পুরো হতে চলেছে, সে আপনি যেমন জানেন, আমিও জানি। তার পরও, একটু অন্য রকমভাবে হলেও তাঁকে কাছে পাওয়া সম্ভব। আমি সে কথাই বলছি।
প্রথম তো তাঁর রচনার সিঁড়ি ধরে পৌঁছে যেতে পারি তাঁর কাছে। যা আমি করে আসছি গত একটি বছর ধরেই। তা ছাড়া মস্তিষ্কের জাদুকরী খেলা স্বপ্নের দড়ি বেয়ে তিনিও চলে আসতে পারেন একান্ত কাছে। যেমনটা মাঝেমধ্যেই ঘটছে। চোখের আলোয় নাগাল না পাওয়া প্রিয়জনকে মনের গভীরে ফিরে পাওয়া আমার কাছে অন্তত এক পরম তৃপ্তি।
স্বপ্ন দিয়েই শুরু করি। স্বপ্ন ভেঙে গেলে প্রায়ই সান্নিধ্যের সুখস্মৃতি ছাড়া কিছুই মনে থাকে না। তবে সব সময় নয়। যেমন দিন কয়েক আগে দেখা একটা স্বপ্ন এখনো মন জুড়ে আছে। দেখলাম এই ঢাকা শহরেরই কোনো এক প্রান্তে বিশাল এবং ঘিঞ্জি এক বস্তি এলাকা। যাকে দুভাগে বিভক্ত করে মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে নদীর মতো বড় একটা খাল। খালের এক জায়গায় দুপারেই বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। তেমনি একটা জায়গায় কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে হুমায়ূন দাঁড়িয়ে আছেন। খালের ওপর তৈরি হচ্ছে বিশাল মঞ্চ। হুমায়ূন পারে দাঁড়িয়ে তার তদারকি করছেন।
অনেকটা অবাক হয়েই জানতে চাইলাম, পানির ওপর তৈরি এই মঞ্চ দিয়ে কী হবে। হুমায়ূন হালকাভাবে জবাব দিলেন, এই মঞ্চে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে বসে তিনি একটা নাচ-গানের অনুষ্ঠান উপস্থাপন করবেন। খালের দুপারের মানুষ তা উপভোগ করবে। ফাঁকা জায়গায় বসবেন কিছু আমন্ত্রিত মেহমান।
হুমায়ূন কি আমাকেও এই মঞ্চে ডাকবেন? এমন একটা প্রশ্ন জাগল আমার মনে। তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করার কিংবা নিজের থেকে তিনি কিছু বলার আগেই ঘুম ভেঙে গেল। টুটে গেল সুন্দর একটা স্বপ্ন। গোটা দৃশ্যের খুঁটিনাটি এখনো চোখের সামনে ভাসছে।
এমন অদ্ভুত একটা স্বপ্নের অর্থ কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি এ নিয়ে ভাবতে থাকি। ভাবতে ভাবতেই একসময় উৎফুল্ল হয়ে উঠি। মনে হলো, এ তো হুমায়ূন নিজেই এসে তাঁর যাবতীয় সৃষ্টির লক্ষ্য আর তাৎপর্য স্পষ্ট করে ধরিয়ে দিয়ে গেলেন।
তাঁর আয়োজন সাধারণ মানুষদের জন্য। বস্তির মানুষের সুযোগ নেই উঁচুমাপের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কাছ ঘেঁষার। তিনি তাঁর আয়োজনই নিয়ে গেলেন তাদের দোরের পাশে। এ কথা মনে আসতেই মনে পড়ল হুমায়ূন নাটক-সিনেমা নিয়ে মত্ত হওয়ার পর একদিন তাঁকে বলেছিলাম, 'নাটক-সিনেমা তো অন্যরাও করতে পারবে। করছেও। তোমার লেখা নিয়েও। নাটক-সিনেমায় অত সময় দিলে তোমার লেখালেখি, যেখানে তোমার বিকল্প কেউ নাই, মার খাবে না কি? আমার অনুযোগে তার স্পষ্ট জবাব ছিল- অস্বীকার করছি না, লেখালেখিই আমার প্রধান কাজ। তবে নাটক-সিনেমা নিয়ে যত মানুষের কাছে পৌঁছতে পারি, লেখালেখিতে তা সম্ভব নয়।' এমন কথা হুমায়ূন বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারেও বলে গেছেন।
হ্যাঁ, তাঁর তাবৎ কর্মের লক্ষ্যই ছিল এ দেশের সাধারণ মানুষ। যখন যেভাবে সম্ভব তাদের কাছে পৌঁছতেই তিনি ছিলেন সচেষ্ট। লক্ষ্যহীন শিল্পের বিলাসে হুমায়ূন বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর লেখালেখিতেও এই বৈশিষ্ট্যের অজস্র নজির ছড়িয়ে আছে। ভাষা আর আঙ্গিক নিয়ে কালোয়াতি করে নিজেকে উচ্চে তুলে ধরার চেষ্টা না করে মনকাড়া গল্পের আকারেই তিনি তাঁর বক্তব্য তুলে ধরতেন। সাধারণ পাঠকরাও যাতে তাঁর সাহিত্যরস আস্বাদনে বঞ্চিত না থাকে, সে জন্য রপ্ত করেছিলেন সহজ ভাষায় নিজেকে উপস্থাপন করার দক্ষতা। তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যের ভাষাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের মুখের বুলির কাছাকাছি।
হুমায়ূন স্বপ্নে এসে যেন এই জানা কথাগুলো সম্পর্কে নতুন করে আমাকে সজাগ করে দিয়ে গেলেন।
হুমায়ূন মানুষকে ভালোবেসেই কলম ধরেছিলেন। তাঁর সৃষ্ট প্রতিটি চরিত্রে, তা সে ফেরেশতা কিংবা দানব যা-ই হোক, জড়িয়ে আছে সে ভালোবাসার পরশ। তাঁর পাঠক-দর্শকপ্রিয়তা প্রমাণ করে, সব শ্রেণীর মানুষও তাঁকে একই আন্তরিকতায় গ্রহণ করেছিল। লক্ষ্যের স্থিরতা তাঁকে এনে দিয়েছে, এ দেশে অন্তত, অভূতপূর্ব সাফল্য। মানুষের ভালোবাসা হুমায়ূন কতটা অর্জন করেছিলেন আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি তাঁর চলে যাওয়ায় গণ-আবেগের বিস্ফোরণে। চলে যাওয়ার দিনটি সামনে আসায় সেসব দৃশ্যই আজ চোখের সামনে বড় হয়ে উঠছে। ফিরে আসি নতুন করে হুমায়ূন পাঠ প্রসঙ্গে। সার্থক সৃষ্টির আবেদন প্রথম বা একক পাঠেই ফুরিয়ে যায় না। নতুন করে পড়ায় নয়া তাৎপর্য ধরা পড়ে। আমার একটা দুর্ভাবনা ছিল নির্ভরযোগ্য হুমায়ূন-জীবনীর অনুপস্থিতি নিয়ে। নিজের মনেই ভাবতাম, কেউ না কেউ তো এ কাজে ব্রতী হবেনই। উপাদান আসবে কোথা থেকে?
সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, একজন স্রষ্টাকে খুঁজতে হবে তার সৃষ্টিতে। হুমায়ূনের কিছু বই পড়ে, বারবার পড়ে এ উক্তির যথার্থতা নতুন করে উপলব্ধি করলাম। হুমায়ূন তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যে নানাভাবে নিজেকে প্রকাশ করে গেছেন। গল্প, উপন্যাস, নাটকে যে কেবল তাঁর মন-মানসের ছবিই আছে তাই নয়। অতিরিক্ত কিছুও আছে।
তাঁর চলে যাওয়ার পর কবরস্থান নির্ধারণ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক এক বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিল। এখনো দেখা যায় সে বিতর্কের কিছু রেশ কোথাও কোথাও রয়ে গেছে। অথচ হুমায়ূন-সাহিত্যের প্রতি নজর ফেরালে এ বিতর্ক উদ্ভবেরই কারণ থাকত না। চিকিৎসার জন্য আমেরিকা থাকা অবস্থায় লিখেছিলেন, 'নিউ ইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ। এরই এক জায়গায় এমন একটা বর্ণনা ছিল, তিনি দেখছেন, নুহাশপল্লীর সবুজ চত্বরে সফেদ মর্মরে বাঁধানো একটা কবর। কবরটা তাঁরই। কবর কোথায় হবে একি তাঁর স্পষ্ট ইশারা নয়?'
কথা সাহিত্যিকেরা নিজেদের রচনায় উপস্থিত থাকেন অনেকটাই পরোক্ষভাবে। হুমায়ূন তাই আছেন। তবে এর বাইরেও একটা কৌশল তিনি প্রয়োগ করে গেছেন। যেখানে নিজেকে হাজির করেছেন সরাসরি লেখক হুমায়ূন আহমেদ পরিচয়ে। যার থেকে আমরা সরাসরি তাঁর বর্ণনায়ই তাঁকে দেখতে পাই। গুটিকয়েক ব্যতিক্রম বাদ দিলে তাঁর সব রচনাই আমি পড়েছি প্রথম প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। কোনো কোনোটা প্রকাশের আগেই। নতুন করে চোখ বোলাতে গিয়ে দেখছি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ও প্রথম পাঠে নজর এড়িয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে অনেকটা গুরুত্বহীন 'শিশির আলির চশমা' বইটির কথাই বলি।
গত শতকের শেষ দু-তিনটি বছর হুমায়ূন-জীবনের এক রহস্যঘেরা বিতর্কিত অধ্যায়। এ নিয়ে আমারও প্রশ্ন ছিল। জবাব পাইনি। হঠাৎ সেদিন শিশির আলির চশমা পড়তে গিয়ে দেখি এ বইটিতে তিনি একটি চরিত্র হিসেবে 'লেখক হুমায়ূন হুমায়ূন আহমেদ'কে উপস্থাপিত করেছেন। যাতে স্পষ্ট করে রেখে গেছেন আমার মতো অনেকের কিছু প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসার জবাব।
ব্যক্তি হুমায়ূনকে জানার জন্যও তাই হুমায়ূন-সাহিত্যের কাছে বারবার ফিরে যেতে হবে। ইদানীং আমি এ পথ ধরেও তাঁর আনন্দময় সান্নিধ্য উপভোগ করছি। আসন্ন মৃত্যু দিবসের উদ্যাপনা মনের ওপর কোন প্রতিক্রিয়া জন্ম দেবে জানি না। তবে এই মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর স্মৃতির সান্নিধ্য আমার কাছে আনন্দের উৎস। স্বপ্নে আর শব্দের আড়ালে যেভাবেই তাঁকে পাই না কেন আমি উৎফুল্ল আর অনুপ্রাণিত বোধ করি।
তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, দুর্ভাবনাও একটা আছে। সে তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে। যে বিপুল সম্ভার তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন, তা আমরা কতটা এবং কিভাবে রক্ষা করতে পারব। তাঁর যাবতীয় অবদান জাতীয় সম্পদ। একে হেলাফেলায় নষ্ট হতে দেওয়া হবে অমার্জনীয় অপরাধ। এই নিবন্ধে এ প্রসঙ্গের জের টানা অপ্রাসঙ্গিক ঠেকবে ঠাওরে উল্লেখেই নিজেকে ক্ষান্ত করলাম।
আবারও বলি, ইদানীং তাঁকে নতুন করে কাছে পাওয়ার কথা যা বললাম, তা যদি আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের সৃষ্টিও হয়, আমার আক্ষেপ নেই। এই সান্নিধ্য তাঁকে হারানোর ফলে সৃষ্ট ক্ষতে নিরাময় আর শান্তির প্রলেপ!
0 Comments