হুমায়ূন আহমেদ আর ইমদাদুল হক মিলন- এ দুটি নাম খুব পাশাপাশি ব্যবহৃত হতো বাঙালি পাঠকদের কাছে। কারণ দুজনই অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক। তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিন্তু অত্যন্ত মধুর। কখনো অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো, কখনো বা বড় ভাই-ছোট ভাইয়ের মতো, আবার কখনো বা পিতা-পুত্রের মতো। এ দুজনকে একসঙ্গে নিয়ে বৈঠকি আড্ডায় বসেছি বহুবার, কিন্তু নির্ধারিত সাক্ষাৎকারপর্ব ছাড়া এ দুজনকে কখনোই পরস্পরের সাহিত্য নিয়ে সামনাসামনি আলোচনা করতে দেখিনি, বরং আড্ডাবাজি, হালকা রসিকতা কিংবা পরস্পরের টিপ্পনী কাটতেই দুজন ব্যস্ত থাকতেন।
এ দুজন লেখকই পরস্পরকে একাধিক বই উৎসর্গ করেছেন। হুমায়ূন তাঁর জীবদ্দশায় অন্তত দুটি লেখা লিখেছেন ইমদাদুল হক মিলনকে নিয়ে। অন্য কোনো লেখকের জন্মদিনের লেখা হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ প্রথম যাঁকে নিয়ে লেখেন, তাঁর নাম ইমদাদুল হক মিলন। আর মিলন হুমায়ূনের জীবদ্দশাতেই তাঁর অনেক সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন পত্রিকায়। হুমায়ূনের অসুস্থতার পরপরই তাঁকে নিয়ে ধারাবাহিক স্মৃতিচারণামূলক লেখা শুরু করেছেন। মৃত্যুর পর সেসব লেখা ও অন্যান্য স্মৃতিকথা নিয়ে লিখেছেন গ্রন্থ 'প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ'।
'প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ' গ্রন্থটি যদিও হুমায়ূনকে নিয়ে লেখা ইমদাদুল হক মিলনের স্মৃতিকথা, কিন্তু প্রকারান্তরে এটি দুই লেখকের বেড়ে ওঠা আর বিকশিত হওয়ারই গল্প। প্রিয় হুমায়ূন আহমেদের কথা শোনাতে গিয়ে অকপটে লেখক তাঁর নিজের কথাও শুনিয়েছেন।
ইমদাদুল হক মিলনের এই গ্রন্থটির মধ্যে সবচেয়ে প্রকট হয়ে যে বিষয়টি এসেছে, তা হচ্ছে এ দুই লেখকের লেখালেখির সূচনাপর্বের সংকটময় সময়। দুজনই অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে তাঁদের সংসারজীবন শুরু করেছিলেন। এই দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেই দুজন তাঁদের প্রথম জীবনের লেখালেখি করেন। সে সময় জীবনের কঠিন বাস্তবতাগুলো সামনে দেখে মধ্যবিত্ত পরিবারের খোকা যে ক্রান্তিকালের বর্ণনা দিয়েছিল, তা প্রকাশিত হয়েছিল হুমায়ূনের 'নন্দিত নরকে' আর 'শঙ্খনীল কারাগার'-এ। এ দুটি উপন্যাসের প্রায় কুড়ি বছর পর ভাগ্যান্বেষণে জার্মানি পাড়ি দেওয়া এবং পরবর্তী সময়ে দেশে ফিরে এসে জীবনসংগ্রামে লিপ্ত হওয়া অপর টগবগে তরুণ ইমদাদুল হক মিলন লিখেছিলেন তাঁর প্রথম দিককার মাইলফলক উপন্যাস 'পরাধীনতা'।
হুমায়ূন আহমেদ দীর্ঘ চার দশক ধরে লেখালেখি করেছেন, ইমদাদুল হক মিলনও লিখছেন তিন দশক ধরে। কিন্তু এঁদের দুজনই এই দীর্ঘ জীবনের লেখালেখিতে তাঁদের প্রথম দিকের লেখাগুলোকে অতিক্রম করে গেছেন এমন লেখার সংখ্যা খুব বেশি নয়। এই লেখকদ্বয়ের একটি সাধারণ গুণ আছে- তাঁরা দুজনই অত্যন্ত চমৎকার গদ্য রচনা করতে পারেন এবং এ দুজনই আশির দশক থেকে প্রায় একই সঙ্গে দুই হাতে লেখা শুরু করেন, একসময় তেমন কোনো বাছবিচার ছাড়াই। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জীবন থেকে পাওয়া বোধগুলোর বিচ্ছুরণ ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে তাঁদের লেখায়। এর পরিবর্তে সম্পাদক বা প্রকাশকের ফরমায়েশকে প্রাধান্য দিয়ে নানা রকমের গল্প-উপন্যাস লিখতে থাকেন। তাঁদের দুজনেরই জাদুমাখা গদ্যে মোহিত হতে থাকে নতুন পাঠক। দিনে দিনে তাঁদের লেখার চাহিদা বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয় অর্থ-যোগ। বারো শ টাকার বাড়ি ভাড়ায় থাকা লেখক ইমদাদুল হক মিলন প্রকাশকের কাছ থেকে বস্তা ভর্তি দুই লাখ টাকার বান্ডিল পেয়ে দিশেহারা হয়ে যান। সাড়ে ছয় হাজার টাকা বেতনের হুমায়ূন আহমেদ এক উপন্যাসের জন্য দশ লাখ টাকা অগ্রিম পেয়ে হন বিগলিত। তাঁরা প্রকাশকদের চাহিদামাফিক ক্রমাগত লিখতে থাকেন।
বিগত তিন দশক বাংলাদেশের বাংলা ভাষার প্রকাশনাশিল্পকে জিইয়ে রাখতে এবং কম্পিউটার ও ইন্টারনেট যুগের তরুণ-তরুণীদের বইমুখী করে রাখার জন্য এ দুই লেখকের ভূমিকাকে কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। এ দুই লেখকই জনপ্রিয় লেখক হিসেবে স্বীকৃত। তবে কখনো কখনো এই 'জনপ্রিয়' হওয়ার বিষয়টি কোনো কোনো সাহিত্য সমালোচকের কাছে নেতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হলেও হুমায়ূনের জীবদ্দশায়ই এ দুই লেখকের আলোচনায় তা বারবার উঠে এসেছে, যা ইমদাদুল হক মিলনের 'প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ' গ্রন্থে বিশদভাবে আছে।
হুমায়ূন আহমেদ আসলে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হওয়ার জন্যই চেষ্টা করেছিলেন। এই গ্রন্থে সে কথাই লেখা আছে। পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করার সময় যখন তিনি আমেরিকায় ছিলেন, সেখানে বসেই খবর পান, বাংলাদেশে ইমদাদুল হক মিলন নামের একজন তরুণ লেখক খুব জনপ্রিয়। দেশে এসে ১৯৮৩ সালের বইমেলায় ইমদাদুল হক মিলনের কাছে তাঁর বই মেলে ধরেন অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য। এ কথা ইমদাদুল হক মিলনের লেখায় যেমন এসেছে, হুমায়ূন আহমেদের লেখায়ও আছে। ইমদাদুল হক মিলন হুমায়ূন আহমেদের শৈশব ও কৈশোর থেকে শুরু করে তাঁর জীবনের নানা বাঁকের কথা বলার পাশাপাশি হুমায়ূন আহমেদের প্রায় পূর্ণাঙ্গ একটি চরিত্র উপস্থাপন করেছেন এই লেখায়। যেখানে শুধু লেখক হুমায়ূনই নন, লেখক থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হওয়া মঞ্চ ও টেলিভিশনের নাট্যকার, পরিচালক, চলচ্চিত্র-নির্মাতা, গীতিকার ও চিত্রকর হুমায়ূনের পরিচয় তুলে ধরেছেন।
এর বাইরেও উঠে এসেছে তাঁর পারিবারিক পটভূমি। 'সাহিত্য সুধাকর' পিতার কাছ থেকে কৌশলে শেখা রবীন্দ্রনাথের কবিতা কিংবা খেয়ালি পিতার বেহালা কেনার বিষয়, সিলেটের বাড়িতে থাকার সময় সুর সাগর প্রাণেশ দাশের কাছ থেকে লোকসংগীত শোনার বিষয়টি পরবর্তী সময়ে তাঁর সাহিত্য সাধনা এবং চরিত্র সৃষ্টিতে কী প্রভাব রেখেছিল, সেসব কথাই বলেছেন।
ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলনের কাছ থেকে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস নিয়ে অধিক আলোচনা আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু লক্ষণীয় যে হুমায়ূনের প্রথম জীবনের উপন্যাসগুলোর পর পরবর্তী পরিণত বয়সে লেখাগুলো থেকে কেবল 'জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প' এবং 'লীলাবতী'ই স্থান পেয়েছে বেশি। যদিও তাঁর 'মিসির আলী', 'হিমু কিংবা 'শুভ্র' বিষয়ক উপন্যাসগুলোর প্রসঙ্গ এসেছে; তথাপিও হুমায়ূন আহমেদ রয়ে গেছেন তাঁর নিজস্ব বোধ থেকে সৃষ্টি করা লেখাগুলোর মধ্যে। প্রায় ২০০টির মতো উপন্যাস লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু আলোচনায় ঘুরেফিরে এসেছে প্রথম দিকের কয়টি এবং পরবর্তী সময়ে 'মধ্যাহ্ন', 'মাতাল হাওয়া', 'জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প', 'লীলাবতী'র মতো উপন্যাস। প্রকাশকদের তৃষ্ণা মিটানোর জন্য বিভিন্ন সময় কিছু লেখা নিয়ে অকপটে স্বীকার করেছেন তাঁর দীনতার কথা।
হুমায়ূন আহমেদের ভেতরে সব সময় একজন বাউল বসবাস করতেন। এই বাউলিয়ানার প্রভাব আছে তাঁর ব্যক্তিজীবনে, তাঁর নাটক-সিনেমায়-উপন্যাসেও। 'জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প'-এ মসজিদের ইমাম হয়েও সংগীত সাধনা করা উকীল মুন্সির চরিত্র যেমন চিত্রিত করেছেন, তেমনি তাঁর নাটক-সিনেমায়ও বাংলাদেশের, বিশেষ করে ভাটি অঞ্চলের বাউলদের উপস্থিতি ছিল প্রকট। হাসন রাজা, রাধারমণ, আরকুম শাহ, রশিদ উদ্দিন, উকীল মুন্সি, শাহ আবদুল করীম, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ বাউল ও লোককবির কথা এবং জীবনাচার তাঁকে আবিষ্ট করে রাখত। তিনি অনেক বেশি প্রভাবিত ছিলেন সুনামগঞ্জের বাউল ও লোককবি হাসন রাজা নিয়ে। তাঁর সংগীত যেভাবে তিনি ধারণ করতেন, তাঁর জীবনাচারকেও তিনি নিজের মধ্যে নিতে চাইতেন।
এই অসামান্য প্রতিভাবান মানুষটি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে অনেক সংকটাপন্ন অবস্থানকে অতিক্রম করেছেন। কিন্তু কোনো কিছুই যে তাঁর লেখালেখি থেকে সরিয়ে নিতে পারেননি। এমনকি কঠিন অসুখ শরীরে নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর কথা জেনেও তিনি লিখে গেছেন শেষ পর্যন্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোথায় দাঁড়ালেন হুমায়ূন? এ প্রশ্নের জবাবটুকু এই দুই লেখকের কথোপকথনের মধ্যেই আছে, 'হুমায়ূন ভাই, আমি জানতে চাইছিলাম যে আপনি এত বড় একজন লেখক, বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে আপনার নিজের অবস্থান কোথায়? '
এমন প্রশ্ন ইমদাদুল হক মিলন করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদকে। উত্তরে হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, 'আমার অবস্থান ঠিক হবে আমার মৃত্যুর পর। তোমরা সবাই মিলেই ঠিক করবে। এই সময়ে আমি বর্তমানের একজন জনপ্রিয় লেখক। এর বেশি কিছু না।'
বিগত তিন দশক ধরে বাংলাভাষী পাঠকদের মুগ্ধ করে রেখে গেছেন এই জনপ্রিয় লেখক। কালের পরিক্রমায় তিনি কতটা উত্তীর্ণ হয়ে কালজয়ী লেখক হিসেবে বিবেচিত হবেন, তা মহাকালই বলে দেবে। তবে তাঁর বেশ কিছু লেখা যে কালজয়ী হবে, এ বিষয়ে আমিও আশাবাদী- যেমন আশাবাদী ইমদাদুল হক মিলনও।
0 Comments