Ticker

6/recent/ticker-posts

হুমায়ূন-জীবনী - মুহম্মদ নূরুল হুদা

হুমায়ূন-জীবনী - মুহম্মদ নূরুল হুদাচৌষট্টি বছরের যে জীবন যাপন করেছে আমার বন্ধু হুমায়ূন, তা যেমন বিচিত্র, তেমনি রসঘন ও নাটকীয়। তার এই জীবনটাকে আরো বহু বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায় অবশ্যই। কেননা ভীষণভাবে মুডি হুমায়ূন কখন কী করে বসবে, তা বোধ করি তার নিজেরও জানা ছিল না। ন্যূনতম গৃহীপনা বা পরিকল্পনা ছাড়া কেবল স্বতঃস্ফূর্ততা দিয়ে কোনো সৃষ্টিকর্মই হয় না, কিংবা হলেও তা পাতে দেওয়া যায় না; তাই এক ধরনের আন্তঃসম্পর্কীয় স্বব্যবস্থাপনা উপ্ত ছিল তার সৃষ্টিসত্তার মধ্যেও। তবে তা যে তার জীবনকে গুছিয়ে রাখার জন্য পর্যাপ্ত ছিল না, তা আমরা বেশ বুঝতে পারছি তার তিরোধানের পর। নিজের যা কিছু অর্জন, বৈষয়িক বা সৃষ্টিশীল, তার কোনোটাকেই সুরক্ষিত করে যেতে পারেনি হুমায়ূন। এর একটি কারণ হয়তো এই যে এত তাড়াতাড়ি যে সে চলে যাবে, তা তারও ধারণার বাইরে ছিল। কিংবা এ নিয়ে তার কোনো চিন্তাও ছিল না হয়তো। সে যা-ই হোক, যতই দিন যেতে থাকবে, ততই এই রক্ষারজ্জু আলগা হতে থাকবে, যদি এক্ষুনি তার স্বজনরা এ নিয়ে কোনো সুচিন্তিত পদক্ষেপ না নেন। আর এর জন্য প্রয়োজন হবে তাঁদের ভেতরকার মতভেদটুকুও হুমায়ূনের স্বার্থেই দূর করে অভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া।
অবশ্য তারই পাশাপাশি কম গুরুত্বপূর্ণ নয় তার একটি প্রামাণ্য জীবনী রচনা ও প্রকাশ। এ কাজটি বাংলাদেশের যেকোনো লেখক করতে পারেন, যিনি হুমায়ূনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশের জন্য যে প্রকাশকের কোনো অভাব হবে না, তা বিনা দ্বিধায় বলা যায়। বিগত বইমেলার (২০১৩) অভিজ্ঞতা থেকে এই মন্তব্য করা যেতে পারে। হুমায়ূনবিষয়ক বই ছাপানোর জন্য তার প্রকাশকসহ সব পর্যায়ের প্রকাশকেরই আগ্রহ দেখেছি। অনেক প্রকাশক আমাকেই লিখে দিতে বলেছেন তার সম্পর্কে একটি গ্রন্থ। গত মেলার শেষ দিকে আমি আমার ষাট দশকের বন্ধু ও প্রকাশক আলমগীর রহমানকে আমার হুমায়ূনবিষয়ক রচনাগুলো একত্র করে 'এক যে ছিল হুমায়ূন' নামে একটি পাণ্ডুলিপি প্রদান করি। আলমগীর তার স্বনামধন্য 'প্রতীক প্রকাশনী' থেকে অত্যন্ত রুচিশীলভাবে সেটি প্রকাশও করে। কাজেই প্রকাশনা নিয়ে না ভাবলেও চলবে। যেকোনো পরিশ্রমী ও গবেষণামনস্ক লেখক যদি এ কাজে হাত দেন, তাহলে আমাদের সাহিত্যের একটি প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন হবে।
হেলাফেলায় যেনতেনভাবে এ জীবনী লেখা যাবে না। গত মেলায় জীবনীজাতীয় দু-একটি গ্রন্থ অতি তড়িঘড়ি করে বেরিয়েছে বটে। তবে পরিপূর্ণ জীবনী সময়, শ্রম, মেধা, গবেষণা ও নির্লিপ্ততা ছাড়া সম্ভব হবে না। কেননা প্রাপ্ত তথ্যের বাইরেও হুমায়ূনের ব্যক্তিগত ও সৃষ্টিশীল জীবন বেশ বঙ্কিম ও জটিল। আসলে হুমায়ূনের বহু বাঁকময় জীবনের অন্তর্লোকে প্রবেশ না করে তার জীবন ধরা যাবে না রেখায় বা লেখায়। বাংলা একাডেমীও তাদের বিভাগীয় ছকভিত্তিক একটি জীবনী প্রকাশ করতে পারে রুটিনমাফিক, কিন্তু তা যে তার পূর্ণাঙ্গ জীবনী হবে না, তা আগেভাগেই বলে দেওয়া যায়। তবু বাংলা একাডেমী তার একাডেমিক প্রয়োজনে নির্দিষ্ট ছকে তার তথ্য-উপাত্তময় জীবনীটি প্রকাশ করলে কোনো ক্ষতি নেই। বরং সেটি বাজারে প্রচলিত অগোছালো কাজগুলোর চেয়ে ভালো বৈ মন্দ হবে না। তবে আমি বলছি এক সৃষ্টিশীল জীবনীর কথা, যা সৃষ্টিযন্ত্রকাতর বহুমাত্রিক স্রষ্টা হুমায়ূনের জীবনের এক রহস্যরঙিন দর্পণ হিসেবে কাজ করবে।
কাজটি এক হিসেবে হুমায়ূনের নিজেরই করা উচিত ছিল। অর্থাৎ লিখে যাওয়া উচিত ছিল তার বহির্জীবন ও অন্তর্জীবনের গল্প। কিন্তু সময় বা ইচ্ছার অভাবহেতু হয়তো এ কাজটি সে করে যেতে পারেনি। আত্মজীবনীমূলক যেসব বই সে লিখে গেছে, সেগুলোকে তার জীবনের কিছু কৌতুক ও চমকপ্রদ ঘটনার সমাহার বলা যায়; তার ধারাবাহিক জীবন বা সৃষ্টিজীবনের আলেখ্য বলা যায় না। আমি তার 'বলপয়েন্ট' বা 'রঙপেন্সিল' জাতীয় বইগুলোর কথা মনে রেখেই এই মন্তব্যটি করছি।
ঠিক এই মুহূর্তে আমার টেবিলে আছে তার 'রঙপেন্সিল' শীর্ষক গ্রন্থটি। ৯৫ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে হুমায়ূন ২৪টি ছোটবড় খণ্ডচিত্র এঁকেছে, যার প্রতিটি তার জীবনের কিছু রসঘন ঘটনার দ্রুতলেখ নকশা মাত্র। এগুলোর মধ্যে এক ধরনের অন্তঃসম্পর্ক আছে, কিন্তু যাপিত জীবনের বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গের ধারাবাহিক আলেখ্যায়ন নেই। হয়তো এটি তার উদ্দেশ্যও ছিল না। পাঠক-পাঠিকার চিত্তকে ভারী বিষয় দিয়ে ভারাক্রান্ত করা তার উদ্দেশ্য ছিল না হয়তো বা। কিন্তু গল্প, উপন্যাস বা রসরচনা আর একজন লেখকের জীবনচিত্র এক কথা নয়। আবার কোনো গুরুতপূর্ণ লেখক আত্মজীবনী লিখলেও নতুন করে অন্য কেউ যথাসম্ভব নির্লিপ্তভাবে তার জীবনী লিখবেন, এটিই কাম্য। তা না হলে রবীন্দ্রনাথের 'জীবনস্মৃতি'র পর আমরা বহু খণ্ডে রচিত 'রবিজীবনী' পেতাম না। এখন যিনি হুমায়ূনজীবনী লিখবেন, তিনি একটি বিশেষ সুযোগ ও সুবিধা পাবেন। তিনি তার রত্নগর্ভা জননীসহ প্রায় সব জীবিত সহচর ও পারিবারিক সদস্যদের সান্নিধ্য পাবেন। তাঁদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সুযোগ আছে। কাজেই ঘটনার অবিকৃত দলিলীকরণে তাঁর তেমন বেগ পেতে হবে না।
সময় যতই গড়িয়ে যাবে, ততই সব কিছু ধূসর, স্মৃতিময় ও অস্পষ্ট হয়ে আসবে। ফলে প্রার্থিত জীবনীটাও খানিকটা বিতর্কিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। কতকটা এ পরিণতি ঘটেছে নজরুলের ব্যাপারে। যার ফলে এই শতাধিক বছর পরও নজরুলের কোনো সর্বগ্রাহ্য জীবনী আমরা পাচ্ছি না। যা পাচ্ছি, তার অধিকাংশই অপূর্ণাঙ্গ, কিংবা কিছু কিছু বিতর্কিত তথ্যে কণ্টকিত। তথ্যবিকৃতি রোধ করার ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ না করা একটি বড় শর্ত। কাজেই যিনিই কাজটি করতে যাবেন, তাঁকে অনতিবিলম্বে এ কাজে হাত দিতে হবে। আমাদের কোনো বড় প্রকাশক গবেষণার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন তরুণ কথাসাহিত্যিককে এ কাজে উৎসাহিত করতে পারেন। প্রস্তাবিত জীবনীকারের গবেষণা ও গল্প বলার কৌশল আয়ত্তে থাকলে কাজটি তাৎপর্যময় হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়।
একটি কথা স্মরণ করা যেতে পারে যে হুমায়ূন একজন ব্যক্তি হলেও জীবনে বিচিত্র চরিত্রের স্রষ্টা বা অভিনেতা। তার সৃষ্ট চরিত্র হিমু বা মিসির আলী তো আসলে হুমায়ূন নিজেই। তার গল্প-উপন্যাস থেকে এসব ব্যতিক্রমী চরিত্রকে চিহ্নিত করতে হলে তার প্রতিটি রচনা অনুপুঙ্খ পাঠ করা অত্যাবশ্যক। আর ব্যক্তিজীবনে হুমায়ূন কোনো কোনো মুহূর্তে অনুরূপ জীবন অতিবাহিত করেছেন, তাও খুঁজে দেখা জরুরি।
তবে সবচেয়ে জটিল অধ্যায় বোধ করি তার জীবনের শেষার্ধ, যখন থেকে সে নতুন সংসার আর নুহাশপল্লীতে প্রবেশ করল। যেমন বহুবর্ণিল, তেমনি যন্ত্রণাদগ্ধ এ অধ্যায়। একদিকে নতুন সম্পর্কের শিহরণ, অন্যদিকে ছিন্নপ্রায় সম্পর্কের দংশন তাকে নীলকণ্ঠ করে তুলেছে। এ অধ্যায়টি যথার্থই একজন ট্র্যাজিক হিরোর দহনকাল। ক্লাইমেক্স আর অ্যান্টিক্লাইমেক্সও এই শেষার্ধেই সন্নিবেশিত। অন্তর্দৃষ্টিময় মমতায় এই অধ্যায়টি রচিত ও বিন্যস্ত হতে হবে নিঃসন্দেহে। এ অধ্যায়ে কাজে লাগবে তার রচিত জীবন-উপাত্তমূলক গ্রন্থাবলি। তারই একটি এই 'রঙপেন্সিল'।
এই গ্রন্থের খণ্ডচিত্রের মধ্যে বেশ কয়েকটি আছে মহৎ ব্যক্তিদের নানা ধরনের উদ্ভট আচরণ নিয়ে। তার তালিকায় আছে আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, দানিকেন, ড. ইউনূস বা ইন্দুবালা। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে একাধিক লেখা আছে তার সার্ধ জন্মশতবর্ষের কারণে। তবে আমার বেশ লেগেছে দানিকেনের কাহিনীটি। তার বন্ধু ও আমাদের সময়ের এক মেধাবী ছাত্র আনিস সাবেত তাকে এরিখ ভন দানিকেন রচিত 'দেবতা কি গ্রহান্তরের মানুষ' শীর্ষক সুবিখ্যাত বইটি পাঠিয়েছিল উপহার হিসেবে। হুমায়ূন তখন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত। বইটি পড়ে হুমায়ূন সব পাঠকের মতোই চমৎকৃত হয়েছিল। কিন্তু দানিকেনের মূল প্রস্তাবনার সঙ্গে একমত হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
মনে মনে ইচ্ছে জাগল, দানিকেনকে পেলে এ নিয়ে কথা বলা যেত। আর সে সুযোগও এসে গেল হঠাৎ করে। হুমায়ূন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি শেষে ডক্টরেট করার জন্য চলে গেল আমেরিকার নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে দানিকেন সাহেব এলেন তাঁর বক্তব্য নিয়ে। বেশ বড়সড় আসর বসল। হলঘর লোকে লোকারণ্য। দানিকেন সাহেব পাওয়ার পয়েন্ট ও স্লাইড প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে আকর্ষণীয় বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে সম্মোহিত করলেন। তারপর বিজয়ীর ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুড়লেন, কারো কোনো দ্বিমত আছে কি না জানতে। সবাই চুপ। হুমায়ূন সেই সুযোগটা কাজে লাগাল। বলল, 'আপনার হাইপোথিসিসে মানুষের উদ্ভাবনীশক্তি, কর্মক্ষমতাকে ছোট করা হয়েছে।' হুমায়ূন আরো জানাল যে ভিনগ্রহের মানুষ নয়, মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেছে। তার নিজের আবিষ্কার দিয়ে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছে। এখানে দেবতারূপী ভিনগ্রহের মানুষের কোনো ভূমিকা নেই। যে মানুষ 'ঈশ্বর-কণা' আবিষ্কার করতে পারে, কালে কালে সে সবই করতে পারে। পরে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে আমেরিকার কয়েকজন বিজ্ঞানীও দানিকেনের বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ করলেন। জয় হলো হুমায়ূনেরও। তার জীবনীতে এ ধরনের ঘটনা যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে তার শেষজীবনের ব্যক্তিচিত্রও।
ষাটের পর হুমায়ূনের জীবনে এক ধরনের সঙ্গোপন নিঃসঙ্গতার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। এ নিয়ে তার অকপট স্বীকারোক্তি, 'ধানমণ্ডির ১৮শ স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে কাটছে আমার দিবস-রজনী। আমি কোথাও যাই না বলে মাঝে মাঝে আমার ফ্ল্যাটে জম্পেশ আড্ডা হয়। যে রাতে আড্ডা থাকে না, আমি শাওনকে নিয়ে ছবি দেখি। জোছনা আমার অতি প্রিয় বিষয়। প্রতি পূর্ণিমাতেই নুহাশপল্লীতে যাই জোছনা দেখতে, সঙ্গে পুত্র নিষাদ, নিনিত ও তাদের মমতাময়ী মা। প্রবল জোছনা আমার মধ্যে এক ধরনের হাহাকার তৈরি করে। সেই হাহাকারের উৎস অনুসন্ধান করে জীবন পার করে দিলাম।' অতঃপর আর কী বলার থাকতে পারে আমাদের! এই নিঃসঙ্গতা, এই আড্ডা, জোছনা আর হাহাকারের উৎস সন্ধান করতে হবে হুমায়ূনের সৃষ্টিশীল জীবনীকারকেও। তাহলেই ভেদ করা যাবে হুমায়ূন নামক কূটাভাসের রহস্য। আর সে গ্রন্থ হবে আমাদের কালেরও এক প্রামাণ্য পরকলা।

Post a Comment

0 Comments