নারায়ণ দেবনাথ।
কমবেশি ষাট বছর ধরে এঁকেছেন বাংলা-কাঁপানো হাঁদাভোঁদা, বাঁটুল, নন্টে আর ফন্টে...।
এখনও এঁকে চলেছেন। বরং বলা ভাল, চলতে হচ্ছে। হিসেব করে যদি দেখি, এই হাঁদাভোঁদা-র ৪৯, বাঁটুলের ৪৭, নন্টেফন্টে-র ৪২। যে সময়ে তিনি কাজ করেছেন, করে চলেছেন সেই সময়টার প্রায় পুরোটাই রাজত্ব করেছে এবং করছে ভুবনমোহন সব কমিকস। এবং, ভাষার দূরত্বে দুনিয়া কাঁপানোর প্রশ্ন না উঠলেও বাংলাভাষী বিশ্বে নারায়ণ দেবনাথ অদ্বিতীয়।
কিন্তু কমিকসের মহাবিশ্বে সমগ্র নারায়ণ যদি হয় বিপুল এক পৃথিবী, কতটুকু খবর রাখি তার? সাময়িকপত্রের পাতায় দীপ্তি ছড়িয়ে হারিয়ে যায় তারা, বই হয়ে যখন বেরোয় তখনও তার কোনও ইতিহাস কোথাও ধরা থাকে না। তাই প্রথম টিনটিন কিংবা প্রথম অ্যাসটেরিক্সের নাম যত সহজে এসে যাবে ঠোঁটের ডগায় ততটাই অপ্রস্তুত হতে হবে প্রথম বাঁটুলের কথা জিজ্ঞাসা করলে। তাই, নারায়ণ দেবনাথের কমিকস সমগ্র-এর তিন খণ্ড যখন হাতে এল তখন মনে হল এ যেন বাঙালির অর্ধশতকের শৈশবের নতুন এক উদ্যাপন। উদ্যাপন বইয়ের এক ইতিহাসেরও। বাংলায় এত তথ্যপূর্ণ, এত সুবিন্যস্ত কমিকসের সমগ্র সাম্প্রতিক অতীতে আর দেখা যায়নি।
বাঁটুল দি গ্রেট, হাঁদাভোঁদা, নন্টে আর ফন্টে, ডানপিটে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু, শুঁটকি আর মুটকি, বাহাদুর বেড়াল, পটলচাঁদ দ্য ম্যাজিশিয়ান, পেটুক মাস্টার বটুকলাল-এর মতো ‘জনপ্রিয় মজার কমিক্স’ (এই নামই দেওয়া হয়েছে বিভাগটির, কেন বোঝা গেল না) তো বটেই, এ সমগ্র ধরে রাখতে চেয়েছে নারায়ণের সমস্ত কাজ। অর্থাৎ, ‘অ-জনপ্রিয়’গুলিও বাদ পড়েনি। তারই ফলে এই সমগ্রে প্রায় কোন স্মৃতির অতল থেকে উঠে এসেছে ‘রহস্যময় অভিযাত্রী’, ‘ইতিহাসে দ্বৈরথ’ কিংবা কৌশিকের অভিযান ‘সর্পরাজের দ্বীপে’ও। ‘অ্যাডভেঞ্চার কমিকস’ বিভাগে আছে ড্রাগনের থাবা, অজানা দ্বীপের বিভীষিকা, ইন্দ্রজিৎ রায়ের কাহিনি ব্ল্যাক ডায়মন্ড। আছে বিজ্ঞাপনের কমিকস, ছবির ধাঁধা, নানা রকমের কমিক স্ট্রিপ, কার্টুন স্ট্রিপ। এমনকী, ‘কমিকস সমগ্র’ বললেও, ধরে রাখা হয়েছে নারায়ণবাবুর করা বিভিন্ন প্রচ্ছদ ও অলংকরণও।
পত্রিকা থেকেই মূলত তুলে আনা হচ্ছে কমিকসগুলি, তার মূল চেহারা বজায় রেখে। অর্থাৎ সাদা-কালোয় প্রকাশিত কমিকস সাদা-কালোতেই প্রকাশিত হয়েছে, দু-রঙের কমিকস দু-রঙেই। প্রসঙ্গত, বাঁটুলের কমিকস চিরকাল নারায়ণবাবু দু-রঙে এঁকেছেন। এক বারই সম্পূর্ণ রঙিন বাঁটুল কমিকস আঁকেন দেব সাহিত্য কুটীরের পূজাবার্ষিকী ‘পূরবী’তে (১৩৭৯ বঙ্গাব্দ)।
সে রকম আরও অনেক অগ্রন্থিত কমিকস ধারাবাহিকতায় ধরে রাখছে এই সমগ্র। কম্পিউটারে রঙ করার যে প্রচলন হচ্ছে ইদানিং, সেই অনুপ্রবেশ সযত্নে এড়িয়ে চলেছেন সম্পাদকদ্বয়। পত্রিকাকেই সংগ্রহের মূল ভিত্তি করার ফলে অগ্রন্থিত, দুষ্প্রাপ্য সেই ‘চিত্রে দুর্গেশনন্দিনী’ও পাওয়া যাচ্ছে সমগ্রের দ্বিতীয় খণ্ডে। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসকে চিত্রকাহিনির রূপ দিয়েছিলেন নারায়ণ দেবনাথ, সে কাজ এখন বিস্মৃতির গর্ভে। একটি যথার্থ পূর্বাপর বোধ হয় এ ভাবেই তিল তিল করে গড়ে ওঠে।
এ সমগ্রে একই চরিত্রের কমিকসগুলি সাজানো হয়েছে কালানুক্রমে। প্রতিটি কমিকসের ইতিহাস, প্রথম প্রকাশের সাল-তারিখ, কেন্দ্রীয় চরিত্রটির চেহারার সচিত্র বিবর্তন সব ধরনের তথ্যানুষঙ্গ এ বইয়ে আছে। কালানুক্রমিকতার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কমিকসগুলি যে সব পত্রিকায় বেরিয়েছিল তার সবকটির ধারাবাহিক সংগ্রহ না থাকলে এ কাজটা করা সম্ভব নয়। এ সমগ্রের এক সম্পাদক শান্তনু ঘোষ নারায়ণ দেবনাথের সমগ্র সৃষ্টির এক নিষ্ঠ সংগ্রাহকও। তাঁর সংগ্রহ থেকেই কাজটি সম্ভব হয়েছে। সম্পাদকীয় সংযোজন হিসেবে আছে তাঁর লেখা কমিকসগুলির পরিচয় এবং নারায়ণের জীবনপঞ্জি। আর এক সম্পাদক দেবাশীষ দেব সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় বাংলা কমিকসের ইতিহাসে নারায়ণ দেবনাথের অবস্থানটি স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর কাছে আরও সবিস্তার, আরও গভীর বিশ্লেষণ প্রত্যাশিত ছিল। পরের সংস্করণে পরিসর বাধা হবে না আশা করি।
এই যে ‘বাংলা কমিকসের ইতিহাসে’ কথাটা বলতে হল তার নেপথ্যে আছে আমাদের এক ব্যর্থতার ইতিহাস। টিনটিন থেকে অ্যাসটেরিক্স ইংরেজি তো বটেই, বিশ্বের নানা ভাষার সঙ্গে অনূদিত হয়েছে বাংলাতেও। বাঁটুল কিংবা হাঁদাভোঁদার মতো চরিত্রকে কিন্তু ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে পারিনি আমরা, পঞ্চাশ বছরেও। অতি সম্প্রতি অবশ্য সে চেষ্টাটা শুরু করেছে ‘বী বুকস’, ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে নন্টে আর ফন্টে।
আমাদের শৈশব আলো করে ছিল যারা, আলো করে আছে একুশ শতকের শৈশবেরও অনেকটা, তাদের নাড়ি-নক্ষত্রও যেন না হারায় ভুল ইতিহাসের অন্ধকারে।
নারায়ণ দেবনাথ কমিকস সমগ্র ০১ - ৫০৯ পাতা, ৭৫ মেগাবাইট।Download
নারায়ণ দেবনাথ কমিকস সমগ্র ০২ - ৪৪২ পাতা, ৩০ মেগাবাইট।
নারায়ণ দেবনাথ কমিকস সমগ্র ০৩ - ৫১২ পাতা, ৪৬ মেগাবাইট।
Narayan Debnath Comics Shamagra in Three Volumes.