হুমায়ূন আহমেদ ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে লেখালেখি, নাট্যনির্দেশনা ও চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যাপৃত ছিলেন। এর মধ্যে প্রায় ৩২ বছর ধরে শাকুর মজিদ তাঁর সঙ্গে মিশেছেন। একটা পর্যায়ে মজিদ ছিলেন মূলত হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিজীবনের অন্তরঙ্গ অনুরাগী আর কৌতূহলী পর্যবেক্ষক। তাঁর একান্ত নিজস্ব অনুভূতিগুলোই এই বইতে প্রকাশ পেয়েছে। বড় মাপের কোনো মানুষের কথা বলতে গিয়ে তাঁদের কাছের মানুষেরা প্রায়শই অতিশয়োক্তি করে তাঁদের রচনাকে ভারাক্রান্ত করেন, সাধারণ পর্যায় থেকে তুলে তাঁকে মহামানবের স্তরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। শাকুর মজিদ এ ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এ বই কেবল স্মৃতিকথাই নয়, এর মধ্যে একজন সাধারণ লেখকের অসাধারণ হয়ে ওঠা এবং তাঁর বিবর্তনের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।
সূচিপত্র
*শঙ্খনীল মুগ্ধতা
*প্রথম দর্শনের মুগ্ধতা
*ছিয়াশির বইমেলায়
*রবীন্দ্র-রচনার মুগ্ধ পাঠক
*প্রধান অতিথির মুগ্ধতা
*অঙ্গনা ও হুমায়ূনের জহুরি চোখ
*বহুব্রীহি ও ‘তুই রাজাকার’
*বাংলাবাজার পত্রিকা ও বিস্মৃত হুমায়ূন
*আগুনের পরশমণি : এক চলচ্চিত্রকারের আবির্ভাব
*টইটুম্বর ও হুমায়ূন-জননী
*ভাটির পুরুষ ও কিছু মুগ্ধতার গল্প
*২৪ ক্যারেটম্যান ও বৈরাতি যখন এক কাতারে
*প্রিয় মরণগীতি
এক দেশান্তরী যুবকের মুগ্ধতা
*অন্তরঙ্গ পর্বের সূচনা
*তাঁর সঙ্গে সুন্দরবনে
*অকৃতী অধমের হাতে পাঁচটি নীলপদ্ম
*তাঁর শেষ ছবি
আড্ডাবাজ হুমায়ূন
*যে আড্ডায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন
*তাঁর কয়েকটি জন্মদিন
*দক্ষিন হাওয়ার দুঃখী আড্ডা
*আপনি ভালো আছেন তো!
শাকুর মজিদ ছবি তোলেন, তথ্যচিত্র-প্রামাণ্যচিত্র বানান, নাটক লেখেন; লেখার হাতটিও তাঁর ভালো। নিজের স্কুলজীবন অথবা কাছে-দূরের দেশ বেড়ানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর লেখা বইগুলো পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে সেই অল্প বয়সেই আত্মার একটি মিল খুঁজে পেয়েছেন শাকুর—হুমায়ূনের ভেতরে যে একটি ভবঘুরে মানুষ ছিল, তাকে তিনি চিনতে পেরেছেন। এই ভবঘুরে মানুষটি হুমায়ুন আহমেদের সৃষ্টিশীল সত্তাটিকে যে হাত ধরে নানা জায়গায় নিয়ে যেত, মানুষের মনের অলিগলি থেকে নিয়ে বিশ্বসংসারের আনন্দ-বেদনার অলিন্দে-উঠানে, সে বিষয়টি শাকুর বুঝতে পেরেছিলেন। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হুমায়ূন আহমেদকে তিনি দেখেছেন, জেনেছেন, তাঁর সৃষ্টিশীলতার উৎসগুলো চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নানা টানাপোড়েনের সাক্ষী হয়েছেন, তাঁর মেজাজটি পড়তে চেষ্টা করেছেন এবং তাঁর ভেতরের ভবঘুরে মানুষটির সঙ্গে সখ্য গড়তে চেয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদও, যাকে বলে আশকারা দিয়েছেন শাকুরকে; তাঁর কাজের প্রতি এক ধরনের সস্নেহ সমর্থন দিয়ে গেছেন। আর যতই হুমায়ূনকে দেখেছেন শাকুর, ততই মুগ্ধ হয়েছেন। এই মুগ্ধতার প্রকাশ যে ছিল এক মুগ্ধকর। তবে মুগ্ধতাটা মোহাবিষ্টতার প্রদর্শনী হয়ে দাঁড়ায়নি, আবেগের বিহ্বলতার বিশেষণমণ্ডিত বর্ণনা হয়ে দাঁড়ায়নি, যে বিপদটি এ ধরনের আখ্যানকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে। শাকুর বরং উল্টো পথে হেঁটেছেন—মুগ্ধতা কেন, অথবা নয় কেন, কখন ও কোথা থেকে এর উৎপত্তি—এসব প্রশ্নের আদিঅন্ত খুঁজেছেন। সেই শঙ্খনীল কারাগার পড়ার অভিজ্ঞতায় যে হুমায়ূনকে তিনি চিনেছিলেন, তাঁকে যেন বাজিয়ে নিতে চেষ্টা করেছেন এর পরের ৩২ বছর এবং এটি করতে গিয়ে একজন লেখকের, নাট্যকারের, গান রচয়িতার, চিত্রনির্মাতা ও পরিচালকের, চিত্রকরের তিন দশকের পথ পরিক্রমা, তাঁর হুমায়ূন আহমেদ হয়ে ওঠার একটি সংবেদী ধারা বিবরণী দিয়েছেন।
শাকুরের বর্ণনায় যে হুমায়ূনকে আমরা পাই, তিনি এক আশ্চর্য প্রতিভার নাম। একবার তাঁকে নিয়ে একটা বিতর্ক শুরু হয়েছিল, যার বিষয়বস্তু ছিল, তিনি জনপ্রিয় লেখক বটে, কিন্তু মহৎ লেখক নন ইত্যাদি। আমার কাছে এই বিতর্ক অর্থহীন মনে হয়েছে। আমি দেখেছি, অসংখ্য তরুণ-তরুণী তাঁর বই পড়ে চোখে একটা নামহীন কষ্ট, অথবা ঘোর অথবা স্বপ্ন নিয়ে ঘুমোতে গেছে, তাঁর চরিত্রদের সঙ্গে হেসেছে-কেঁদেছে, তাদের সঙ্গে রাতের বৃষ্টিতে ভিজেছে, ভরা জ্যোৎস্নায় পথে নেমে গেছে। তাঁদের বোধ অনুভূতিগুলোকে নিজের অধিকারে এনে হুমায়ূন তাদের তাঁর গল্পের সহযাত্রী করে নিয়েছেন। এই অর্জনটা সামান্য নয় এবং এটিকে মহৎ সাহিত্যের সংজ্ঞায় ফেলে বিচার করার কোনো প্রয়োজন নেই। শাকুর সেই তরুণদেরই একজন। তিনি লিখেছেন তাঁর কষ্ট-স্বপ্ন-ঘোরের কথা, জ্যোৎস্না-বৃষ্টিতে ভেজার কথা। তবে পার্থক্য এই, তিনি বর্ণনাটা করে গেছেন নির্মেদ গদ্যে, কোনো অতিশয়োক্তির আশ্রয় না নিয়ে। তিনি মুগ্ধ হয়েছেন, কিন্তু মুগ্ধতার একটা ইতিহাসও লিখে গেছেন।
যে ছিল এক মুগ্ধকর—এর নির্মাণটি একটি মোজাইক-চিত্রের মতো। ৩০-৩২ বছরের অনেক ঘটনা-অভিজ্ঞতা থেকে ২৩টি বেছে নিয়ে তিনি মোজাইক-চিত্রটি সাজিয়েছেন। কিন্তু তলে তলে সেগুলোর একটা যোগ আছে। এবং এই যোগটা সম্ভব হয়েছে প্রতিটি বর্ণনার কেন্দ্রে হুমায়ূন থাকার জন্য। এসব বর্ণনা তাঁর সঙ্গে শাকুরের কাটানো বিশেষ কোনো মুহূর্তের, দিনের, সময়ের, ঘটনার, আড্ডায়, ভ্রমণে, অনুষ্ঠানে অথবা বইয়ের মাধ্যমে তাঁর সন্নিকট হওয়ার। হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাকুর। তারও বিবরণ আছে।
নীরদচন্দ্র চৌধুরী জানাচ্ছেন, ভালো বাঙালি বলতে যাদের বোঝায়, তারা আসলে আত্মভোলা। এ রকম এক আত্মভোলা মানুষের ছবি তুলেছেন শাকুর। ক্যামেরার ভাষায় বলতে গেলে, অনেকগুলো শটে, অনেকগুলো অ্যাঙ্গেলে, লেন্সের অদল-বদল করে, ফিল্টার লাগিয়ে অথবা না-লাগিয়ে তোলা ছবির একটি অ্যালবাম যেন সাজিয়েছেন শাকুর। এসব ছবিতে হুমায়ূন কখনো স্পষ্টভাবে, কখনো আলো-আঁধারিতে হাজির হয়েছেন। আলোকচিত্রী শাকুরকেও এই বইতে চেনা যাবে।
Download