সভ্যতার সংকট ও রবীন্দ্রনাথ - মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা সমুদ্রের মতো। তার যেখান-সেখান থেকে কয়েক পেয়ালা জল তুলে নেওয়াটা শক্ত কোনো কাজ নয়। কিন্তু যখন নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্য যথাযথ সংগত কোনো রবীন্দ্র-উদ্ধৃতি সংগ্রহ করার প্রশ্ন আসে, তখন ব্যাপারটি আর অত সোজা থাকে না। এই কঠিন কাজটি করেছেন বিশিষ্ট গবেষক ও শ্রদ্ধেয় বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর 'সভ্যতার সংকট ও রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থে। রবিঠাকুরের প্রভাবক উদ্ধৃতি, সংগত প্রসঙ্গে জাতিক ও আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন এবং নিজের বিশ্লেষণের আলোকে নিবন্ধগুলোর সাধু গ্রন্থনা করেছেন জনাব রহমান। এই রবীন্দ্রতথ্য ও মূল্যায়ন-মন্তব্যের মূল্যবান সমাবেশীকরণ আমাদের গবেষণা সাহিত্যকে তো বটেই, যুগপৎভাবে পুরো বাংলা সাহিত্যকেই বিশেষ সমৃদ্ধি দিতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে হয়। প্রবন্ধগুলোর শিরোনামের দিকে লক্ষ করলেই এই কঠিন কাজের বিষয়টিকে সহজেই অনুমান করা যাবে। বইটি পাঠের সুবিধার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করার সহযোগিতাসূচক চার পৃষ্ঠাব্যাপী যে নির্ঘণ্ট জুড়ে দেওয়া হয়েছে, তার গুরুত্বও কম নয়। বিশেষ করে গবেষক পাঠক বা প্রতিষ্ঠানের জন্য আকরগ্রন্থ হয়ে উঠতে এই নির্ঘণ্ট পৃষ্ঠার মূল্য ঢের। ১১২ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে মোট ১১টি প্রবন্ধ ভুক্তি পেয়েছে। এগুলো হলো : চিত্ত ও বিত্তের আদান-প্রদানে বুদ্ধি-বিচার, রবীন্দ্রসংগীতে গায়কের স্বাধীনতা, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, অসংকোচে মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে, জাইআনিজম, প্যালেস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে কিছু কথা, আকাশ-ভরা তারার মাঝে রবির তারা কই?, রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র/ছিন্নপত্রাবলী, রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববিহার, নোবেল বিজয়ীদের চোখে রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্র ও 'সভ্যতার সংকট'। রচনাগুলোর বিশেষত্ব হলো, এসব বিষয়ে লেখকের মূল্যায়ন এবং অন্য দেশি-বিদেশি গবেষকদের অনুচিন্তাসহ রবিঠাকুরের বিষয়সংশ্লিষ্ট উক্তি বা মতামতের শক্ত সমন্বয় ঘটাতে এক ধরনের মুন্শিয়ানা।
এ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কমবেশি ২১০টি উদ্ধৃতিকে ব্যবহার করা হয়েছে। যা ঠাকুরের বলা, লেখা, সাক্ষাৎ থেকে নেওয়া। এর বাইরে আরো অন্ততপক্ষে ২২টি উদ্ধৃতি রয়েছে, যা ঠাকুরকে বা তাঁর বিষয়ে বা তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে অন্য কেউ করেছেন। এই 'অন্য কেউয়ের' মধ্যে রয়েছেন দেবব্রত বিশ্বাস, শ্রী দিলীপ কুমার রায়, কার্ল মার্কস্, বার্নার্ড শ, এলি উইজেল, ব্যালফুর, জুইশ স্ট্যান্ডার্ড, এনইবি এজরা, ডব্লিউ বি ইয়েটস, ফ্রান্সিস কর্নফোর্ড, পল ন্যাস, হিমনিজ, বার্ট্রান্ড রাসেল, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, আইনস্টাইন, দিমিত্রি মারিয়ানফ প্রমুখ। লক্ষণীয়, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্বপরিচিত, কেউ আবার তা তো ননই, বরং স্বল্প পরিচিত বা অপরিচিত প্রায়। কিন্তু বইটি পড়ে এই স্বল্প বা অপরিচিতদের সম্পর্কে জানা গেলে রোমাঞ্চিত না হয়ে পারা যায় না। তাঁদের আন্তর্জাতিক পরোক্ষ প্রভাব, পারিবারিক ও দাপ্তরিক পরিচিতি বেশ আকর্ষণীয়। কেউ কবি, কেউ সম্পাদক, কেউ ঠাকুরভক্ত, কেউবা ডারউইনের নাতি। এই আলোচনাটুকু গ্রন্থ প্রসঙ্গে হলেও বেশ একটা অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। ঠিক এই বক্তব্যকে তুলে ধরার পেছনে আমার যে যুক্তিটি, তা হলো বিচারপতি হাবিবুর রহমানের রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে ব্যাপক খুঁটিনাটি এবং আনকমন লেখাপড়া ও জানাজানির বিষয়টি অনুধাবন করা। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে সাধারণ অভিজ্ঞরা তো বটেই, যাঁরা তাঁর বিষয়ে ব্যাপক জানেন, তাঁদের জন্যও এই বইয়ে কিছু না কিছু নতুন আলোর সন্ধান যে মিলবে, নিশ্চিতভাবে সেই কথাটি বলার জন্যই 'আপাত অপ্রয়োজনীয়' মনে হওয়া সত্ত্বেও এ আলোচনাটুকুকে পরিহার করা গেল না। এ বইটি পাঠককে এমনিতেই টানবে, তদুপরি আলোচ্য তথ্যগুলো তাদের আরেকটু আকৃষ্ট করতে যদি সমর্থ হয়, সে-ই মাত্র প্রত্যাশা।
১১টি রচনার শেষ যে লেখাটি, তারই শিরোনামে বইটির নামকরণের মধ্যেও একটি বিশেষ পাণ্ডিত্য আছে, তা বইটি পড়লে অনুধাবন করা যায়। বইটির বিষয়ব্যাপ্তি যে সারা মানবজাতি-গোষ্ঠীর আনন্দ-বেদনাকে স্পর্শ করার যোগ্য বা স্পর্শ করতে চায়, সেই নিরিখে অন্য কোনো প্রবন্ধের নামে এ নামকরণ করলে সেই বড়ত্ব ব্যাহত হতো। পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে আলোচ্য 'সভ্যতার সংকট ও রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থটি ধার, ভার, জ্ঞান, পাণ্ডিত্য- এ চতুর্মুখী বিভায় সমুজ্জ্বল, তাই তার বহুল প্রচার একান্ত কাম্য হওয়া উচিত।