Ticker

6/recent/ticker-posts

অন্দরবেলা - বিশ্বজিৎ রায়

Andorbela - Biswajit Ray in pdfঅন্দরবেলা - বিশ্বজিৎ রায়
‘মিটসেফ’ কথাটা শুনলে কোনও স্মৃতি উস্কে ওঠে? একটা রান্নাঘরের কোনার কথা মনে পড়ে, যেখানে থাকত জালের দরজাওয়ালা এই আলমারি, যার ভিতরে বেড়ালের হাত এড়িয়ে ওবেলার জন্য রাখা মাছ-তরকারি নিরাপদে থাকত কয়েকটা ঘণ্টা?
যদি ‘মিটসেফ’ শব্দটা, কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও, আপনার স্মৃতির ঘরে দু’একটা আঁচড় কাটতে পারে, বিশ্বজিৎ রায়ের ‘অন্দরবেলা’ বইটি আপনার জন্য। আশির দশক জুড়ে অতি মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে যে শিশুটি ক্রমে কিশোরবেলার দিকে এগিয়ে গিয়েছে, এই বই তার গল্প। তার মতো আরও অনেকের গল্প, যাদের ছোটবেলায় মিটসেফ ছিল, মায়ের হাতের নোয়ায় সেফটি পিন ছিল, বাড়িতে সস্তাতম ক্যামেরা কেনা হয়েছিল কয়েক মাস টাকা জমানোর পর। বিশ্বজিৎ বলেছেন, তিনি আসলে সাদা পাতা লিখতে চান। সেই পাতায় তাঁর পাঠক নিজেদের গল্প লিখে নেবেন নিজেদের মতো করে। এই যেমন আমি লিখছি আমার গল্প, তাঁর বই পড়তে পড়তেই।
বাঙালির কাছে অতীতচারণ মানেই এখনও সত্তরের দশক। তার তুলনায় আশির দশক নেহাত সাদামাঠা, বিশেষত্বহীন। আসলে যাদের শৈশব কেটেছে আশির দশক জুড়ে, একমাত্র তারাই বুঝবে, এই দশকের মহিমা কোথায়। এই দশকটাই যোগসূত্র পুরনো ভারতের আর নতুন ইন্ডিয়ার। তার এক পারে নেহরু-গাঁধী যুগের সমাজতন্ত্রের সাদা-কালো ছবি, অন্য দিকে বিশ্বায়িত নব্বইয়ের দশক অথবা একবিংশ শতাব্দীর বর্ণচ্ছটা। ফলে, আশির দশকের সন্তানরা তাদের জীবন জুড়ে বয়ে চলে এক অমোঘ দোটানা। ভারত আর ইন্ডিয়ার পারস্পরিক, বিপরীতমুখি টান। আমাদের প্রজন্ম কালো টেলিফোনের ফোকরে আঙুল ঢুকিয়ে ডায়াল করেছিল, আবার আমাদের প্রজন্মের হাত ধরেই ছড়িয়ে পড়ল মোবাইল ফোন। আমাদের ছোটবেলায় টেলিভিশনের ছাদে লাগানো কাঠি অ্যান্টেনায় কাক বসে পড়ায় টিভির ছবি কেঁপে যাওয়া ছিল, বুস্টার লাগিয়ে বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটক দেখা ছিল। আবার, আমরাই প্রথম প্রজন্ম, স্যাটেলাইট টেলিভিশন যাদের ঘিরে ফেলল সম্পূর্ণত। আশির দশকের সন্তানরা আসলে দ্বৈত সত্ত্বায় বাঁচে আজীবন। সম্ভবত বাঁচবেও। ক্রমে উচ্চ থেকে উচ্চতর মধ্যবিত্ত হয়ে ওঠার পরেও যাদের পাঁজরের মধ্যে সযত্নে লালিত হয় ভীরু মধ্যবিত্ত বড় হয়ে ওঠা। এখনও যারা পাতে ভাত পড়ে থাকলে শুনে ফেলে মায়ের ফেলে আসা কথা, ‘ভাত নষ্ট করলে ভাতের কষ্ট হয়।’
বিশ্বজিৎ আমাদের জন্য লিখেছেন। তাঁর লেখায় একটা ফেলে আসা বাথরুমের গল্প আছে। যে বাথরুমে একটা চৌবাচ্চা ছিল। মা এক রোববার অন্তর সেই চৌবাচ্চার নল খুলে দিয়ে সমস্ত জল বের করে তার তলাটা ঘষতেন। ফের ন্যাকড়া পাকিয়ে গোঁজা হত সেই চৌবাচ্চার ফুটোয়। কিন্তু অবধারিত ভাবেই নল বন্ধ হত না পুরোপুরি। তিরতির করে একটা ধারা বয়েই চলত, যত ক্ষণ না পরের দিন মঙ্গলাদি কাজ করতে এসে ঠিক করে বন্ধ করত সেই প্রস্থানপথ। বিশ্বজিতের লেখায় বাবার প্রাক্-বিবাহ বয়সের সাদাকালো ছবির কথা আছে। কোনার্কের মন্দিরের মিথুনমূর্তির গায়ে গা তুলে বিজয়ীভঙ্গিতে দাঁড়ানো সেই ছবি, নিতান্ত একটা অ্যালবামের অভাবে, পরস্পরের গায়ে সেঁটে গিয়েছে এমন ভাবে যে না ছিঁড়ে তাদের আর আলাদা করার উপায় নেই। এই বইয়ে বাড়িতে প্রথম সাদা-কালো টেলিভিশন আসার গল্প আছে, বড়লোক আত্মীয়ের বাড়িতে খানিক অপাংক্তেয় অতিথি হয়ে থাকার গল্প আছে। এই বইয়ের পাতায় পাতায় মধ্যবিত্তের আশির দশক রয়েছে।
আপত্তি বলতে একটাই। বিশ্বজিৎ পুরো বইটাতেই রোমান্টিক। খুব স্বাভাবিক, কারণ এই রোমান্টিকতা না থাকলে খামোখা এই বইটি তিনি লিখতেনই বা কেন? কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় একটু দূরত্ব বজায় রাখলে ভাল হত, মনে হয়। অবশ্য পাঠক বিচার করবেন, যেখানে এত ভিতরের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে বিষয়ের সঙ্গে লেখকের দূরত্ব আদৌ কাঙ্ক্ষিত কি না।
Download
Andorbela - Biswajit Ray in pdf