আমি মৃণালিনী নই - হরিশংকর জলদাস
ভবতারিণী থেকে মৃণালিনী হওয়া রবীন্দ্রনাথের সহধর্মিণীর অন্তরঙ্গ বয়ানে বিয়ের দিন থেকে নিজের মৃত্যুর আগ পর্যন্তকালের ঘটনার পর ঘটনা প্রায় অনুপুঙ্খ বিবরণসমেত তুলে ধরেছেন কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস, তাঁর আমি মৃণালিণী নই উপন্যাসের ভেতর দিয়ে। বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে এ উপন্যাসের পরতে পরতে জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ির একটা কালপর্বের ঘটনা যে রকম অন্তরঙ্গ ভাষ্যে তুলে ধরেছেন তিনি, মনে হয়নি উপন্যাস পড়ছি। তাঁর মুখোমুখি বসে শুনছি যেন মৃণালিনীর একান্ত আপন কথা। জানা হয়ে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সবলতা-দুর্বলতা। মৃণালিনী নিজের সাক্ষাৎ পর্যবেক্ষণের কথা যেমন জানাচ্ছেন, তেমনি বউ হয়ে আসার পর নানাজনের মুখে ঠাকুরবাড়ির বহু আগের যেসব ঘটনা শুনেছেন, তারও বিবরণ দিচ্ছেন অকপটে। যতই এ উপন্যাসের পাঠ এগোয়, আমরা আরও বেশি একাত্ম হয়ে উঠতে থাকি মৃণালিনী চরিত্রের সঙ্গে।
আলোর নিচে আঁধার থাকার মতো জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও অন্ধকার ছিল। অবরোধপ্রথা ছিল। এ বাড়ির অন্দরমহলে অবরুদ্ধ নারীকুলের দশা মৃণালিনীর বয়ানে লেখক যেভাবে তুলে এনেছেন, পাশাপাশি পুরুষদের ভূমিকার কথাও, তা এক গভীর পাঠের বিষয় হয়ে উঠেছে। তবে তা ইতিহাস হয়ে ওঠেনি, হয়ে উঠেছে কথাসাহিত্যের ঘরোয়া ভাষ্য। যেমন মৃণালিনী জানাচ্ছেন, ‘ঠাকুরবাড়ির কড়া নিয়ম—কোনো পরপুরুষের সঙ্গে বাড়ির মেয়ের সাক্ষাৎ চলবে না। ...অন্তঃপুরে অবরোধপ্রথা পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান। একই প্রাঙ্গণের এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়িতে যেতে হলে ঘেরাটোপমোড়া পালকির সঙ্গে প্রহরী ছোটে, অনেক অনুনয়ের পর গঙ্গাস্নানের অনুমতি পেলে বেহারারা পালকিসুদ্ধ মেয়েদের জলে ডুবিয়ে আনে।’
এ উপন্যাসের একটা বড় জায়গাজুড়ে আছে কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের চালচিত্র, তার টানাপোড়েন, কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু, মৃত্যুকে ঘিরে রহস্যময়তা। আছে ভবতারিণী থেকে মৃণালিনীতে পরিণত হওয়া খোদ স্বামী রবিঠাকুরের কাছ থেকে তাঁর বঞ্চনার অকপট স্বীকারোক্তি। মৃণালিনী জানাচ্ছেন, ‘আমার অসুস্থতা সত্ত্বেও রবিবাবুর ব্যস্ততা কমে না।’ তাঁর অসুস্থতার পর যে ঘরে তাঁকে রাখা হয়, সে ঘরে ‘কোনো বৈদ্যুতিক পাখা নেই। তালপাতার পাখার বাতাসে কতটুকুই বা গায়ের যন্ত্রণা কাটে।’
উপন্যাসের শেষ হচ্ছে মৃণালিনীর মৃত্যুর ভেতর দিয়ে। মৃত্যুর আগে তাঁর সেই অকপট স্বীকারোক্তি, ‘আমার প্রাণের দেবতা রবিবাবু। আমার সন্তানের জনক হিসেবে, দেশের খ্যাতিমান সাহিত্যিক হিসেবে আমি তাকে শ্রদ্ধা করে এসেছি আজীবন। সে আমার স্বামী, কিন্তু প্রেমিক নয়। ...তার মন পড়ে ছিল অন্য নারীতে।’ অন্তিম অনুযোগ করছেন এই বলে, ‘সারাটা জীবন রবিবাবুর মনোতুষ্টিতে কাটল আমার। আমার ভালো লাগার দিকে দৃকপাত করেনি কখনো সে। এই মুহূর্তে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে, আমি মৃণালিনী নই, আমি ভবতারিণী। রবিবাবুর স্ত্রী ছাড়াও আমার নিজস্ব একটা সত্তা ছিল, সেই সত্তার প্রতি রবিবাবু কোনো দিন সুবিচার করেনি।’ নারী যে শুধু নারী নন, ব্যক্তিসত্তাও, এই অনুযোগের ভেতর দিয়ে তা প্রকাশিত।
পুরো উপন্যাসে এসব কথাই লেখেন মৃণালিনী তথা ভবতারিণী, রবিঠাকুরের স্ত্রী ডায়েরির আকারে। হরিশংকর জলদাসের লেখনী-নৈপুণ্যে সেই ডায়েরি হয়ে উঠেছে এক নারীর দলিত ব্যক্তিসত্তার হাহাকার দীর্ণতার দিনলিপি।
আমি মৃণালিনী নই
হরিশংকর জলদাস
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
১৬৮ পৃষ্ঠা