দলিল - শওকত আলী
কথাশিল্পী শওকত আলীর (জঃ ১৯৩৬) “দলিল” আবহমানকালের ইতিহাস, সমাজ রাজনীতি অর্থনীতি সংস্কৃতি পুরাতত্ত্ব উপনিবেশিক সামন্তবাদ এবং আবহমান কালের দলিল হয়ে জীবনধারায় গতিশীল। ভাংচুর ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে জীবনের তাবৎ সঞ্চয় এই প্রক্রিয়াতেই অগ্রসর হয়। এখানে ক্ষয়ে যাওয়া সমাজ রাষ্ট্রের কাঠামোকেও বোঝানো হয়েছে, বোঝানো হয়েছে মানুষের সঙ্গে মানুষের বৈপরীতের অনুভবের ধরণকে, সে ধরণে কতোখানি ব্যবধান তার রূপান্তর প্রত্যক্ষ করি গভীরভাবে। বাংলা সাহিত্যে “দলিল” অনিবার্য একটা অধ্যায়। জওহর আলী প্রধান থেকে শুরু করে মুর্শেদ তারপর রায়হান এবং রঞ্জু, এই চার প্রজন্মের চিন্তা চেতনা ইতিহাস স্বপ্ন আকাঙ্খা মেধা-মননের বিকাশ বেড়ে ওঠা আশা দ্বন্দ্ব সংঘাত হারানো প্রাপ্তি প্রেম বিরহ সর্বপরি যাবতীয় খুটিনাটি বিষয়াদির মিলবন্ধন ঘটিয়ে একটা আত্মাজিজ্ঞাসার রূপায়ণ করেছেন “ওয়ারিশ”এ। যা গভীর বিশ্বস্ততার সঙ্গে উপন্যাসের প্রতি পরতে-পরতে চিত্রায়ণ করে অন্য এক মাত্রায় যোগ দিয়েছেন।
উপন্যাসের প্রথমে লক্ষ্য করা যায়, চতুর্থ প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে তৃতীয় প্রজন্মের শিকড়ের সন্ধান।‘ তিরিশ বছর আগের উকিল পাড়া এই জায়গাটা’ স্মৃতিমন্থন মানে শৈশব-বাল্য কৈশোর জীবনের নানান ছবি দৃশ্যপটে আসে সেলুলাইটের ফিতের মতো। আর ‘ওয়ারিশ’ আবহমান কালের দলিল, বাংলা ভাগের ফলে যে দুর্দশা যে অতুলনীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে, তা অনুধাবণ করার হিসেব নিকেশ করলে বোঝা যায় সে ক্ষতি পূরণ হবার নয়। শওকত আলীর বিরচিত এই উপন্যাসটি আবহমান বাংলার উপাখ্যান রীতির এক উপন্যাস, বিশাল কলরবে আলোচ্য উপন্যাসে এক পরিবারের কাহিনী অংকিত হয়েছে, সেখানে আরো পরিবার আসলেও প্রধান বাড়ির বলয়ে ঘুরপাক খেয়েছে উপন্যাসের গতি, মানুষের মধ্যে আরেক মানুষ বাস করে এবং সে কোনো-কোনো সময় হতে পারে অন্যরকম মানুষ, তারই জ্বলন্ত চিত্র আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। নষ্ট রাজনীতির পাঁকে পরে সংসারের প্রতি উদাসিন অর্থাৎ পাগলাটে এক মুর্শেদ সাতচলি¬শে দেশভাগের পর মোহনগঞ্জে থাকতে না পাবার কারণ সাম্প্রাদায়িক উত্তেজনা হিংসা দ্বেশ এবং সর্বপরি হানাহানি, যা অনেকটা পরে অনুধাবণ করতে পারে। মুর্শেদের কংগ্রেস দলের মানসিকতার ফলস্বরপ সে কেনো কংগ্রেস থেকে মনোনয়ন পেলো না, এবং নির্বচনে তাকে প্রার্থী না করার পশ্চাতে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ বেশ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই একটা পরিবারকে সমুলে উৎখাত হয়ে চলে আসতে হয়, বাস্তব ও কঠিন ঘটনার সূচনা ঠিক এখান থেকেই, প্রথম প্রজন্ম যদি ধরে নেওয়া যায় জওহর আলী প্রধানকে তবে তিনিই তো গুছিয়েছেন এই বিশাল সংসারসীমান্ত, অর্থাৎ তার সাম্রাজ্যের তিনিই একমাত্র অধিকর্তা। “দলিল’এ সেই ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায় কিঞ্চিৎ। যদিও ‘দলিল’ এর কাহিনী-ঘটনা এবং পটভূমি নির্মিত হয়েছে আজকের বাংলাদেশে, সুবিশাল একটা উপন্যাস, এর পরিব্যপ্ত চতুর্দিক, বিষয়-আঙ্গিক-চরিত্রসৃষ্টি বা ভাষার ব্যবহারে যথেষ্ট সাবলীল, নিঃসন্দেহে একটা ক্ল্যাসিক উপন্যাসের মর্য়াদা রাখে। আমরা দেখি, জমির দালাল বাহারউল¬াহ মুনশির গল্প রায়হান আলী শুনতে থাকে নাকি বাধ্য হয়,তবে তার মন দূরে চিন্তার সাগরে মষুরপঙ্খি চড়ে কোথায় হারায়। স্মৃতি বড় বেশি কাঁদায়, ঘোষবাড়ীর বেহাল ধ্বংসাবশেষ খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখে আর মনে-মনে মেলায়, এ’রকম পোড়ো বাড়ি সে কিষানগঞ্জের ইব্রাহিমপুরে দেখেছে, মোহনগঞ্জের কমলাপুরেও ছিলো এমন বাড়ি, চৌধুরীরা পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পর একই দশা হয়েছিলো তাদের বাড়ির। ফেলে আসা জীবনের প্রতি এক ধরণের মোহ রায়হান আলীর মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। হয়তো একটাই সঠিক মানুষ কখনোই তার স্মৃতিকে ভুলতে পারে না। বীথির বাবা করিকাতার ভবানীপুরের বাড়ির কথা বলতে-বলতে শেষ নিশ্বাস ফেলেছিলেন, এ’কথা কি রায়হান আলী জীবনে কখনো ভুলতে পারবে! বুকের মধ্যে দগদগে ঘাঁয়ের মতো সেই ছবিগুলো আটকে আছে, হয়তো এই স্বাভাবিক একজন মানুষের পক্ষে। কয়েক পা হাঁটতেই রাস্তার ধারের একটা কদম গাছ দেখতে পায় রায়হান, কদম ফুলের মিষ্টি গন্ধ ঘ্রাণ এসে নাকে লাগলে সে দাঁড়িয়ে পড়ে তৎক্ষণাৎ, কেমন মনে হয়, ছেলেবেলাকার মোহনগঞ্জে সে যেন এসে পড়েছেÑÑস্মৃতি তাকে বারংবার টেনে নিয়ে যায় শেকড়ে, নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত রায়হান। শওকত আলী এভাবেই দেশভাগের পূর্বের চিত্র স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন আমাদের, দেশ যে মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় অবলম্বন,তার মাটি-পানি-আকাশ এবং বাল্যবেলার খেলার সঙ্গিসাথীদের কথা কি কখনো ভোলা যায়, এ তো সেই নাগরদোলার ঘূর্ণির মতোই অনেকটা, ফিরে-ফিরে সে ওই একই জায়গায় প্রত্যবর্তন, বৈচিত্র্য বলে তো নতুন কিছু নেই।
shawkat-ali-p02-300px অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘গড় শ্রীখন্ড’ উপন্যাস মানবপ্রবাহের জীবনসংগ্রামের মহাকাব্যিক শিল্পরূপ। সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গা-দেশ ভাগের ফলে দুই বাংলার সীমান্তবতী এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের বিপর্যস্ত ও ঘূণে ধরা জীবনচর্চার পটভূমিতে রচিত উপন্যাস। এর পাত্র-পাত্রি সমাজের বিভিন্ন স্তরের, গ্রামাঞ্চলের নানান শ্রেণীর চরিত্রের সমাবেশে ও একটি অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিবেশ, সমাজচেতনার বিশ্বস্ত ভঙ্গীকে ও জীবন চিত্রণের দক্ষতায়, লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায়, বিশেষ কাকুতি মিশ্রিত এই উপন্যাস। পাশাপাশি কমলকুমার মজুমদার বাস্তবতার নতুন মাত্রা ও স্ব উচ্চারিত গদ্যরীতির ব্যবহার তার ‘অন্তর্জলী যাত্রা” উপন্যাস, দেশভাগের নানান রাজনৈতিক-সামাজিক সমস্যা নিয়ে তার এই লেখা, এখানেও দেশবিভাগের মর্মবেদনা প্রজ্জলিত। প্রফুল¬ রায়ের ‘কেয়া পাতার নৌকা’(১ম-২য় খন্ড) অতীন বন্দ্যেপাধ্যায়ের ‘নীল কন্ঠ পাখির খোঁজে’ রমাপদ চৌধুরীর ‘বনপলাশীর পদাবলী’ মহাশ্বেতা দেবীর ‘আঁধার মানিক’ উপন্যাসে যেমন দেশবিভাগের হাহাকার ফুটে উঠেছে, তেমনি আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘ভাঙানৌকা’ বা ‘ইছামতির এপার-ওপার’ উপন্যাসে দেশবিভাগের পটভূমিকা যেভাবে তুলে ধরেছেন, এবং বুকের ভেতরের কষ্টকে নিংড়ে-নিংড়ে পাঠককে জানিয়েছেন, উদ্বাস্তু হয়ে আসা মানুষের জীবন এবং তার যন্ত্রণা কতো গভীর তাও অংকিত করেছেন, তেমনি মাহমুদুল হক ‘ কালো বরফ’ উপন্যাসে উদ্বাস্তু মানুষের মনস্তাতিক জটিলতার ছবি অংকিত করেছেন সফলতার সঙ্গে, একজন মানুষ কখনোই বাল্যস্মৃতি ভুলতে পারে না। যতোই সে জীবনের কাছে ফাকি দিয়ে চলুক না কেনো, প্রকৃতপক্ষে সে শৈশবকে আঁকড়ে থাকতে চায়, জীবনের নানান বাঁকে পিছু ফেলা দিনগুলো ছুটে আসে। উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য ছিলো, ‘ সেই বোধহয় প্রথম তার ছিঁড়ে গেলো সবকিছুর, সে তার আর কখনো জোড়া লাগলো না, আর কখনো জোড়া লাগবে না’। সাতচলি¬শের দেশভাগ নিয়ে হাসান আজিজুল হক এর ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসটিও বিশেষভাবে উলে¬খযোগ্য, মা-মাটি জন্মভূমির যে টান, যে ভালোবাসা তার রুপ বেশ স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যে আবেদন বা আকুতি রেখাপাত করে তা সত্যিই পাঠকের মনকে বিগলিত করে। দেশবিভাগ তো শুধু দেশবিভাজন নয়, আপন অস্তিত্বের বিভাজন, শেকড় ছেদন, নিজেকে কেটে টুকরো করা। এ’ যেন নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ।
মানুষের জীবন বড় বেশি বিচিত্র এবং কঠিন, সব থেকে মোদ্দা কথা হলো, কেউই একক অস্তিত্ব দিয়ে গড়া নয়, তার নির্মান তার শৈল্পিক কাঠামোর মধ্যে আছে অন্যরকম অনুভূতি, সেই অনুভূতি জাগ্রত হয় সময়ের কঠিন বাষ্পে। আমাদের পরিবেশ-পরিচিতির মধ্যে আছে কতো সরল-সহজ কেতাদুরস্ত মুখ আবার আছে কঠিন ও জটিল মানুষের হাতছানি। তাদের রক্তলোলুপ চোখে শুধুই নেশার আগুন, দাউ-দাউ করে অহনিশি জ্বলে অনল, সেই অনলে ছাড়খার হয় সমাজ-সংসার এবং মানুষের প্রেম। কখনো হয়তো মনে হয় মানুষ বড় বেশি স্বার্থপর, আবার কখনো মনে হয় যা বললাম তা কি সঠিক? অনেক চেনা মানুষও অনেক বিপদ এবং দুঃখের সময় বড় অচেনা হয়ে যায়। এখানেই হয়তো মানবজাতির রহস্যময়তা। যা সবাইকে ভাবিত করে। এদিকে লোক বাড়ছে কি বেড়েই চলছে, কারো তো সেদিকে এতোটুকু খেয়াল নেই, যেন সবাই মুখ বুজে বসে আছে,মুখে বলছে তাতে কার বা কি আসে যায়, শরিক বাড়ছেই বাড়ছে,জমি ভাগ হচ্ছে, খন্ড-খন্ড জমি তৈরী হচ্ছে, কারো সেদিকে নজর নেই, বসতবাড়িও ছোট হচ্ছে, ছোট- ছোট খুপড়ি ঘওে মানুষ ঠাসাঠাসি কওে থাকছে কি থাকতে হচ্ছে, কোথায় যাবে, যাওয়ার জায়গাও কমে যাচ্ছে কারণ মানুষ তো নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সময়কে হারিয়ে ফেলেছে, আপন-পর কে তাও তো ভুলতে বসেছে, কেউ কারো কথা ভাবছে না, সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, সমগ্র দেশ এখন কিলবিল করছে মানুষে, মানুষ যেন জন্মে যাচ্ছে শুধু মানুষ জন্ম দেওয়ার জন্য, কি চমৎকার সব কান্ড ঘটছে, কেউ এতোটুকু চিন্তা করছে না। একটু জমি এখন বড় বেশি প্রয়োজন, সে জমির মালিকানা পেতেই তো মানুষ ছুটছে, ভবিষ্যত প্রজন্মকে মাথা গোঁজার জন্য এতোটুকু আশ্রয় এখন বড় আবশ্যক, আমরা সেই গুরুত্ব উপলব্ধি করি ‘দলিল’ উপন্যাসে।
শওকত আলীর কথাসাহিত্য ভাষা ও রচনারীতি চমৎকার বৈশিষ্টমন্ডিত ও তাৎপর্যমুখর, কথাসাহিত্যে ভাষার মর্যাদা গুরুত্বপূর্ণ। সমালোচক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন,“ ভাষারীতি উপন্যাসের সমগ্ররীতি বা বিষয়বস্তু থেকে পৃথক কোনো ব্যাপার নয় এবং এটা একটা প্রাথমিক সত্য কথা যে, ব্যক্তি ও সমাজচেতনার সমগ্র মহিমাকে লেখক তার ভাষারীতির আধারে ধরে রাখে”া একেবারে মাটির কাছাকাছি অবস্থিত গণমানুষের জীবনচরিতকে তার হারিয়ে যাওয়া আনন্দ-বেদনা-বঞ্চনা-পীড়ন-ক্ষোভ ও দ্রোহের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে শওকত আলী তার উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন, অতীতের গর্ভে বিলীয়মান জীবনের উপস্থাপনকে যথাযোগ্য করবার জন্য শওকত তার উপন্যাসে ভাষারীতিতে এনেছেন বৈচিত্র্য। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে শওকত আলী জীবনবাদী ধারার অন্যতম পুরোধা, ষাটের দশকে অত্যন্ত সচেতন সাহিত্যিক ‘পিঙ্গল আকাশ’ দিয়ে তার যাত্রা শুরু ১৯৬৪’তে, সৎ বাপের সংসারে একটি মেয়ের বেড়ে ওঠা এবং তার পারিবারিক ও সামাজিক ভূমিকা নিয়েই এই উপন্যাসটি, অথচ ১৯৮৪’এ এসে একেবারে অন্যরকম ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ লিখে বাংলা সাহিত্যকে নাড়িয়ে দিলেন এবং জানিয়ে দিলেন উপন্যাসে শওকত আলী দিকপাল। সংস্কৃতবহুল ও সমাসবদ্ধ অপ্রচলিত শব্দে শাসিত হয়েছে তার উপন্যাসের ভাষা। একটি সুনির্দিষ্ট কাল পরিপ্রেক্ষিতকে স্পষ্ঠতর বাস্তবানুগ ও জীবননিষ্ট করে তোলার ক্ষেত্রে এই প্রয়াস যথেষ্ট ফলবতী হযেছে, তবে তার ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে চমৎকার নৈপূণ্যের পরিচয় দিলেও ইতিহাস আশ্রিত জীবনের চেয়ে সমকালের জীবনই যে শওকত আলীর উপন্যাসিক সত্ত্বাকে অধিক আলোড়িত করে, পিঙ্গল আকাশ(১৯৬৩) যাত্রা(১৯৭৬) অপেক্ষা(১৯৮৭) দক্ষিণায়নের দিন(১৯৮৫)প্রদোষে প্রাকৃতজন(১৯৮৪) সম্বল(১৯৮৫) ওয়ারিশ(১৯৮৯) উত্তরের খেপ(১৯৯১) দলিল(২০০২) বসত(২০০৫)প্রভৃতি উপন্যাসে রয়েছে তারই মোক্ষম স্বাক্ষর। তেমনি ছোটগল্পে আছে তার ঢের সাফল্য, “উন্মুল বাসনা”(১৯৬৮)‘ লেলিহান সাধ’(১৯৭৮) ‘শুন হে লখিন্দর’(১৯৮৮) ‘বাবা আপনে যান’(১৯৯৪) এই চারটি গল্পগ্রন্থের আশিভাগ গল্পের পটভূমি গ্রামীণ জীবন অবলম্বী। বাংলাভাষার গল্পসাহিত্যের ধারায় শওকত আলীর অবদান বিশিষ্ট ও ব্যতিক্রমধর্মচিহ্যিত, নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের বহুমাত্রিক অসংগতির চিত্র-অঙ্কনের ষাট দশকী মৌল প্রবণতার পথ ছেড়ে গল্পে তিনি বিচরণ করেছেন গ্রামীণ জীবনতটে, গ্রামের নিরন্ন-নিঃস্ব খেটে খাওয়া মানুষের জীবন যন্ত্রণা-সংগ্রাম ও দহনের পোড়োজমিতে, শওকত আলী শ্রেণীসচেতন শিল্পী, তাই বস্তুবাদী সমাজচিন্তার আলোকে তিনি তুলে ধরেন গ্রামীণ মহাজনশ্রেণীর শোষণের চিত্র, নির্মান করেন সর্বহারা মানুষের সংগ্রাম ও উত্তরণের জয়গাঁথা। শাসন নামক শোষণ যেন একপ্রকার নিপীড়ন, সে কথা বোঝাতেই তার প্রতিবাদী বাঁক। শওকত আলীর কথাসাহিত্যে দুটি ধারার উদ্ধিত, একটি ছোটগল্পের এবং অন্যটি উপন্যাসের, এ’ দুই আঙ্গিকে তিনি রুপায়িত করেছেন দুই জীবনকে, তার ছোটগল্পের ভূবন গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের গ্রামীণজীবন, গ্রামের প্রেম-অপ্রেম-দ্বন্ধ-সংঘাত সামাজিক আচার-অনাচার প্রভৃতি দেখতে পাওয়া যায় গল্পের ভূগোলে, সে গ্রাম যেন তার ভালোবাসার কেন্দ্র, নিজের নির্মিত ভূবন গড়ে ওঠে গল্পের আদলে, আর তার উপন্যাসের জগত গড়ে উঠেছে নগরজীবনের উঠতি কালচার-দুঃখ সংঘাত প্রেম ভালোবাসা আর হাহাকারের চিত্র নিয়ে, সেখানে তার কোনো ভনিতা নেই, নেই কোনো কৃত্রিমতা। শওকত আলীর উপন্যাসে গ্রাম এসেছে নাগরিক জীবনের সংলগ্ন অনুষঙ্গ হিসাবে, আবার যেহেতু নগরের সঙ্গে গ্রামের মানুষের যোগাযোগ হয়ে উঠেছে ওতপ্রোত, সেহেতু গ্রাম জীবনের কথা বলতে-বলতে নগর-জীবনানুষঙ্গও চলে এসেছে তার ছোটগল্পে। হিন্দু-মুসলমানের টানাপোড়েন এবং রাজনৈতিক দোলায় দুলতে থাকে সমগ্র জীবনব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় কাঠামো, সামাজিক নৈতিকতা। কথাশিল্পী শওকত আলী গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে আপাদমস্তক তা বর্ণনা করেছেন। ইতিহাস-ঐতিহ্য সংস্কৃতি-কৃষ্টিকে তুলে ধরে উপস্থাপন করেছেন প্রজ্ঞা ও মেধাসম্পন্য পাঠকের সামনে।
‘দলিল’ উপন্যাসে আমরা দেখি জীবন কতো জটিল, কতো রহস্যঘেরা মানুষের মানবিকতা, কেউ কারো নয়, সবাই নিজের নিজের ধান্ধায় দিশেহারা, প্রেম যেন মরিচিকা, মানব-মানবী তাদের বিচিত্র সম্পর্কের বেড়াজালে আটকে গেলেও কোথায় যেন একটা ক্ষত, কোথায় একটা বিন্দু তাদের প্রতিনিয়ত অপরাধরোধের মধ্যে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে, চারদিকের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলীর আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে ‘দলিল’ উপন্যাসের মানব-মানবীরা, পারিবারিক জীবনের এই সমীকরণ কোথায় যে ঠেলে দিচ্ছে তাও কেউ অনুধাবণ করতে পাচ্ছে না অথবা সবই চোখের সামনে ঘটছে কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করার প্রয়োজন মনে করছে না। জন্ম-মৃত্যু লোভ-হিংসা অর্থ-ভৈবব বিষয়-সম্পত্তি সবই কেমন মানবিকতাকে ছাপিয়ে প্রবহমান জীবনের বাঁকে ছুটছে,মানুষগুলো তারপরও নষ্ট সময়ের ক্ষতের মধ্যে বসে খাজুরে আলাপে নিমগ্ন, জটিল জীবন ও সময় এখানে বারংবার মুখ টিপে হাসছে, বহমান ও চলমান নদীর মতো ছুটছে কোথায় জীবন রেশের ঘোড়া তা যেন রহস্যময়। ‘দলিল’ জীবন ঘনিষ্ঠ এক উপন্যাস, প্রবহমান সময় ও সমাজ অর্ন্তগত জীবনের রুপকল্প। কাঠামোতে চেতনাপ্রবাহ কল্পনা ও স্বপ্নকে আশ্রয় করে কখনো গল্পের মেজাজে, কখনো কিছুটা ব্যক্তিগত প্রবন্ধের আঙ্গিকে, কিছুটা হয়তো বা জীবনধর্মী কবিতার ছেঁড়া-ছেঁড়া অঅকুতি মিশিয়ে এগিয়ে গেছে, তবুও এর অন্তঃপ্রকৃতি, এর সমগ্র অবয়বে এক শ্রেণীর মানুষের যে মানব-মানবী বিপন্নতায় কাতর, যে মানুষের অর্ন্তরিত চেতনায় রয়েছে শোধন আর বঞ্চনার হাহাকার, তাদেরই জীবনলেখ্য। দীর্ঘকাল যাবৎ উপন্যাস লিখছেন শওকত আলী, ব্যক্তিহৃদয়ের নিভৃতি অন্তপুরে দৃষ্টি নিবন্ধ করতে যেমন তিনি পারঙ্গম, তেমনি সমাজ বাস্তবতার নানান আবর্ত সমূহকেও গভীরভাবে পরখ করতে সদাআগ্রহী, একই সঙ্গে তিনি হৃদয় সচেতন সমাজ সচেতন ও ইতিহাস সচেতন উপন্যাসিক।
‘ওয়ারিশ’ এ আমরা লক্ষ্য করি, উপন্যাসটি পশ্চিমবঙ্গের পটভূমিকায় রচিত এবং চার পুরুষের জীবন কাহিনী পরিলক্ষিত। রায়হান আলী ও তার মেডিকেল কলেজ পড়–য়া বড় ছেলে রঞ্জুকে নিয়ে ওয়ারিশসূত্রে পাওয়া জমি-জমার অংশ বুঝে নিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু শেষঅবধি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে, এমন কি পুলিশ লেলিয়ে দেবে বলে হুমকি-ধামকিও দেওয়া হয়। অতপর মান-সম্মান আর প্রাণের ভয়ে রায়হান আলী মোহনগঞ্জ ছেড়ে সেই তো চলে আসলো ছেলেকে নিয়ে বিষয়-সম্পত্তির ভাগ না নিয়েই, সেই সমস্ত জটিল ও কুটিল আত্মীয়-স্বজনদের কুটকৌশলে শেষপর্যন্ত পরাস্থ হয়েছিলো, যদিও তাদের সঙ্গে ছিলো স্বার্থেন্বেসী একটা চক্র, এলাকার ঘোড়েল মানুষ। অথচ সেই রায়হান আলীকেই আমরা দেখি আবার সেই ঘোড়েল মানুষদের চক্রে পড়তে হলো ‘দলিল’এ। উপন্যাসটির বিষয় বৈচিত্রে আর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার আর্বতে ঘুরপাক খায়। সাতচলি¬শের দেশভাগ এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘স্বাধীনতার স্বাদ’ নামে একটা উপন্যাস রচনা করেন,তার বিষয় বস্তুতে বলা হয় স্বাধীনতা যে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার জন্য অর্জিত হচ্ছে না, তা কেবল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থকেই বড় করে দেখেছে, সেই সত্যটি যেমন রাজনৈতিক পটভূমিকে সামনে রেখেই মানিক বিচার-বিশে¬ষণ করেছেন বৃট্রিশ সরকার ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার আগে বিভক্ত ভারতবর্ষেও হিন্দু-মুসলিম যাতে কোনোদিন শান্তি বা স্বত্ত্বি না পায় তার জন্য ধর্মের বিষবৃক্ষ কিভাবে রোপণ করা যাচ্ছে তাও যুক্তি-তর্কের সাহায্যে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যা আমোঘ বাণীর মতো পরবর্তীকালে সত্য বলে প্রতিফলিত হয়েছে বলা অপেক্ষা রাখে না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং উদ্বাস্তু জীবনের বিচিত্র রকমের সমস্যাকে নিয়ে যে সমস্ত কাহিনীরচিত হয়েছে সেগুলোর অন্তনির্হিত সত্য উপলব্ধি করতে হলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতার স্বাদ’ উপন্যাসটি পড়া আবশ্যক বলে মনে করি।
‘দলিল’ উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র রায়হান আলী নিষ্ঠাবান সিনিয়র এবং সর্বগ্রহণযোগ্য একজন সাংবাদিক, তার স্ত্রী বীথি গৃহিনী এবং তাদের তিন ছেলে, রঞ্জু মেডিকেল কলেজ পড়–য়া বড় ছেলে, মেজ ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া এবং ছোট ছেলে টুকু কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র। এই হলো মূলত তার সংসারের চিরপরিচিত মুখ। মার্কবাদ বলছে,‘মানুষের আর-আর অনুভূতির মতো সৌন্দর্যানুভূতিও নির্ভর করছে, সমাজে শ্রমের রুপ ও উৎপাদন পদ্ধতির ধরণের ওপর, ঐতিহাসিক আবিস্কার ও ঘটনাবলীর ফলে শ্রমের রুপ ও উৎপাদন পদ্ধতির বিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে মানুষের সৌন্দর্যানুভূতিরও পরিবর্তন ঘটে’। রায়হান আলী একজন পিতা এবং স্বামী হওয়া স্বর্ত্তেও একজন আর দশটা মানুষের মতোই মানুষ, ঘরের জীবনের মতো তারও বাইরে আরেকটা জীবন আছে, আমরা তাও প্রত্যক্ষ করি এ’ উপন্যাসে। তিন ছেলের ভিন্ন-ভিন্ন রুপের কাহিনীও এসেছে, দেখি ছোটছেলে টুকু কলেজিয়েট স্কুলের মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র, কয়েক ইঁচড়ে পাকা বন্ধু স্কুল ক্লাস বাদ দিয়ে কোন দূর পোড়োবাড়িতে মাদকাসক্তে লিপ্ত হতে, ফলে তাকে উচ্ছেন্নে যেতে দেখা যায়। বর্তমান সময় কি যে খারাপ তার রুপ তুলে ধরেছেন এখানে, মেজো ছেলে মঞ্জু, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সে কিছুটা মার্কবাদে বিশ্বাসী হলেও জনযোদ্ধা বাহিনীর সাথে একটা সম্পর্ক রয়েছে,তার বন্ধুকে মরতে হয় টাকার ভাগের জন্য, ফলে তাকেও টার্গেট করে সে সমস্ত সন্ত্রাসীরা, বাধ্য হয়ে বড় চাচার বাড়ি রংপুর বাবা পাঠিয়ে দেয়,সঙ্গে বড় ছেলে রঞ্জুও যায়, পালিয়ে থাকা হয় না, অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়, অনেক সমস্যা তৈরী হয়, তারপরও আরো দু’বার মঞ্জু মার খায়, তার জীবনেও ভালোবাসা নেমে আসে, সে ভালোবাসার জন্যই তাকে নামতে হয় রাস্তায়, কারণ তার ভালোবাসাকে ধর্ষণ করে সন্ত্রাসীবাহিনী, অমুসলিম সেই মেয়েটিকে শেষপর্যন্ত তার পিতামাতা ভারতে পাঠিয়ে দেয়,সবই অংকিত হয়েছে ‘দলিল’এর শরীরে, বড় ছেলে মেডিকেল পড়–য়া রঞ্জু তেমন কোনো সমস্যার মধ্যে নিজেকে না জড়ালেও সমস্যা যেন তাকেও ছাড়ে না। প্রেম ঘটিত ব্যাপার তার মধ্যেও বেশ দেখতে পাওয়া যায়। শওকত আলী জীবনকে কতোখানি আপন ভাবে ছুঁতে পারেন, তারই স্বার্থক রুপ ‘দলিল’। মৃত্তিকা সংলগ্ন গণমানুষের জীবনচরিতকে তার হারিয়ে যাওয়া আনন্দ-বেদনা-বঞ্চনা-পীড়ন ক্ষোভ ও দ্রোহের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে শওকত আলী তার উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে, এখানে তার কোনো ফাকি নেই, নেই ভন্ডামী শঠতা। অতীতের গর্ভে বিলীয়মান জীবনের উপস্থাপনকে যথাযোগ্য করবার জন্য শওকত তার উপন্যাসের ভাষারীতিতে এনেছেন বৈচিত্র্য, শিল্পগত দিক থেকে স্বাতন্ত্র্য। ‘দলিল’ উপন্যাসের আরম্ভ বেশ নাটকীয়ভাবে, পাঠককে আর্কষণ করবার বিশেষ কৌশল তার জানা, চরিত্রচিত্রণে সেই সঙ্গে সমাজচিত্র অঙ্কণেও তার দক্ষতার পরিচয় মেলে স্পষ্ট, আর ভাবকল্পের কথা যদি ধরতে হয়, নতুন কি ভাবনা কি বেদনা কি প্রবঞ্জনা কি সংগ্রাম কি প্রেম কি তৃষ্ণা, জীবনের কোনো নতুন সম্ভাবনা ও আকুতির কথা বলবেন, সবখানেই যেন নতুন জিজ্ঞাসা আমাদের কাছে।
সাতচলি¬শের দেশভাগের চরম গ¬ানি রায়হান আলীর মনকে কুঁড়ে-কুঁড়ে নিঃশেষ করেছে, পিতার হাত ধরে যে যুবক সেদিন উদ্বাস্তু হয়, তার মন কখনোই আর স্থির থাকেনি। নিজের খোলসে সিঁধিয়ে থেকেছে জীবনভর। ‘দলিল’ উপন্যাসে রায়হান আলীর পারিবারিক জীবনের সাথে পারিপাশ্বিক জীবন যেমন উঠে এসেছে, তেমনি এসেছে রাজনেতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক ঘটনাবলী,এসেছে সেলোলাইটের ফিতের মতো একে-একে কতো ছবি কতো না জীবনের চলচ্চিত্র, জীবনের নানান বাঁকে কতো যে কাঁটা-বাঁধা বিপত্তি তা নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন কলমের আঁচড়ে শওকত আলী। সাতচলি¬শের দেশবিভাগের যে যন্ত্রণা-কষ্ট-ক্ষোভ-হাহাকার এবং স্মৃতিচারণমূলক অভিজ্ঞতা, তার ‘বসত’ উপন্যাসেও দেখতে পায়, ভালোবাসা যে কতোখানি জটিল এবং কঠিন শওকত আলী আমাদের তাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, এখানেই তার সার্থকতা। ‘দলিল’কে আশি/নব্বই দশকের অসুস্থ রাজনৈতিক-টালমাতাল আর্থ-সামাজিক কঠিন অবস্থার সাক্ষি বলা যায়, অস্থির সময় আর শাসনের নামে শোষণের কাল ছিলো,বাংলা সাহিত্যে ‘দলিল’ অসামান্য সৃষ্টি বলেই বিবেচিত, মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন সংগ্রাম এবং নষ্টস্মৃতি আমাদের বারংবার ইতিহাসের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে যায়, বিশেষ করে সাতচলি¬শ পরবর্তী দেশভাগের ফলে আপন আবাস ছেড়ে দেশত্যাগ যে কি ভয়াবহ, সারাটি জীবন কুঁড়ে-কুঁড়ে খেয়েছে সে স্মৃতি একজন মানুষকে, রায়হান আলীর সেই জীবনটাকেই উপন্যাসিক চিরন্তন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, শিল্পবোধের কারণে সমসাময়িক ঘটনাগুলোও উঠে এসেছে বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে। নির্বাচিত একটা সরকারকে উৎখাত করে স্বৈরাচার এরশাদ যে ক্ষমতা দখল করেছিলো, এবং দীর্ঘসময় চেপে বসেছিলো বিশ্ববেহায়ার মতো তার প্রতিছবি বেশ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে ‘দলিল’এ, ‘সে’সময় গনতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক,’ শে¬াগান বুকে পিঠে প¬াকার্ড বহণ করেছে যে নূর হোসেন রাজধানীর রাজপথে মিথিলের অগ্রভাগে শরিক হয়েছিলো এবং খুনি এরশাদের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী নূর হোসেনের বুক ঝাঁঝড়া করে দেয় বন্দুকের বুলেটে,তার চিত্র আমরা দেখতে পায় এ’উপন্যাসে। তারপর ডাক্তারদের মিথিলের ওপর যে পুলিশি আক্রমণ এবং ডঃ মিলনকে হত্যা, রাজনৈতিক ডামাডোলের ভেতর দিয়ে উপন্যাসটি এগিয়ে নিয়ে গেছে চমৎকার মুন্সীয়ানার সঙ্গে। ‘দলিল’ এ আর্কষণীয় চরিত্রের অভাব নেই, জীবন বা জীবিকার প্রশ্নে কতো শত চরিত্র ভিড় করে সামনে-পেছনে,তাদের কতো গাল-গল্প কতো যে জিজ্ঞাসা,ব্যক্তিস্বতন্ত্র্যবোধ,সব চরিত্রই আর্কষণীয়, কেউ কারো চেয়ে এতোটুকু কম নয়,জীবনের প্রয়োজনে সবাই সেরা চরিত্রভিনেতা। শেকসপীরিয়ার বলেছেন, ‘পৃথিবীটা একটা রঙ্গমঞ্চ আর আমরা সব কুশীলব’। জীবনকে দেখবার পাঠ নিতে গিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বসাহিত্যের বরেণ্য সাহিত্যিকদের রচনাসমগ্র খুঁটিয়ে পড়েছিলেন, অবশ্যই বিশেষ করে গোর্কীর সাহিত্য তাকে বেশি আচ্ছন্ন করেছিলো, কারণ গোর্কীর সাহিত্যে তিনি দেখেছিলেন ‘মাটির পৃথিবীতে জীবনের বন্যা’, মাটির পৃথিবীতে জীবনের বন্যা থেকে দিনি তার সাহিত্যের দিক-নির্দেশনা বা দিকদর্শন খুঁজে পেয়েছিলেন।
জমি খরিদ করতে গিয়ে আরেক পরিস্থিতি উদ্ভব হয়, মেরী নামের এক মাঝারী গড়নের মহিলার সঙ্গে পরিচয়,তার প্যারালাইজড পঙ্গু শয্যাগত স্বামীর বায়না করা জমির একটা অংশ রায়হান আলী শেষপর্যন্ত কিনতে বাধ্য হন, তারপর মেরীর সঙ্গে সর্ম্পক গড়ে ওঠে, সে সর্ম্পক অনেক গভীরে রুপ পায়, ক্রমে-ক্রমে গভীর থেকে গভীরে জড়িয়ে যায় শয্যাশায়ী রোগী স্বামী সাদেকের বয়স্ক স্ত্রীর সঙ্গে যৌনমিলনে, কর্মনিষ্ঠ-সচেতন-মার্কসবাদে বিশ্বাসী একজন মানুষ একজন পিতা নিজেকে এমন হীনকর্মে জড়িয়ে ফেলে নিজেরই অজান্তে, আমরা এখানে অন্য এক জীবনকে খুঁজে পায়, যে জীবন হয়তো খানিকটা অসহায়, হয়তো স্বেচ্ছায় অথবা ভুলের কঠিন গহবরে হারিয়ে যায়, এভাবেই তো মানুষ কোথাও না কোথাও নিজেকে হারিয়ে ফেলে আবার খোঁজে, মেরী নামের মহিলাটিও এমনই একজন লোকের স্ত্রী ছিলো, যে লোকটি সারাজীবন শুধুমাত্র নিজের চাকুরীর উন্নতির জন্য তুরুপের তাসের ন্যায় ব্যবহার করেছে, বহুজনের বিছানায় যেতে বাধ্য হয়েছে অথচ নিজে কখনো ছুঁতো না। শুধুমাত্র যে শারীরিক কারণে মেরীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে এমন নয়, এখানে আমরা দেখি একটা নেশায় পেয়ে বসে একসময় রায়হান আলীকে, তখন সে মরিচিকার মতো ছুটে গেছে, ভালোবাসা যতোখানি না ছিলো, তার চেয়ে অধিক ছিলো সহানুভূতি ছিলো অন্তরঙ্গ হওয়ার বাসনা, সে সঙ্গে নিজের স্বার্থ। কিন্তু মেরী তো চুম্বুকের মতো তাকে আর্কষণ করেছে, অর্থব স্বামীকে ডির্ভোস দিতেও চেয়েছিলো শুধু ভালোবাসার জন্য, একপর্যায়ে তো রায়হান আলীর বাচ্চাও মেরীর গর্ভে আসে, তখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। কিন্তু সেখান থেকে একটা সময় সে পরিক্রাণ পায়, কাকতালীয় ভাবে সাদেক সাহেব একদিন ভালোও হয়ে যায়, তারপর জমি নিয়ে আরেক ধন্ধে পড়ে, জমিজমার বিষয় যে আসলে কতোখানি জটিল এবং বিরম্বনার তা কমবেশি সবাই অবগত হলেও প্রকৃত অবস্থা আরো রহস্যময়, সে রহস্যের তল সহসা পাওয়া যায় না। এখানে তার প্রকৃত আদল ফুটে উঠেছে বলতেই হয়। কিন্তু তারপরও মানুষের বহুরুপি চেহারা ফুটে উঠেছে, বায়না করা এবং কাগজপত্র থাকা স্বর্ত্ত্বেও রায়হান আলী তার নিজের কেনা জমির দখল হারিয়ে ফেলে, লেলিয়ে দেওয়া ওইসমস্ত মানুষরাই সবচেয়ে বড় শত্র“ হিসাবে ধরা দিলেও, তাদের ছদ্মাবরণে কতিপয় চেনা মানুষই শেষপর্যন্ত যবনিকা উন্মোচিত করে ঘটনার সামনাসামনি উদয় হয়। তখন আর বলার কিছু থাকে না,মানুষই যে মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু এবং শত্র“ তার স্বরুপ ডানা মেলে পাঠকের সামনে উপস্থিত হয়।
উপন্যাসটির গভীরে কতো যে রহস্য আছে, জীবনই বুঝি এমনই রহস্যময়ী। শওকত আলীর উপন্যাসের পরতে-পরতে যে এতো জীবনের বিরম্বনা এতো আঁকাবাঁকা কঠিন পিচ্ছিল পথ এতো জটিল মানুষের জীবনের হাতছানি, যা শুধু ভাবায়, তার উপন্যাসের শিল্পগত দিক থেকে স্বাতন্ত্র্য দেখাতে সক্ষম হয়েছেন, উপন্যাসের আরম্ভ হয় নাটকীয় ভাবে, পাঠককে আর্কষণ করার বিশেষ কৌশল তার জানা। জীবনকে পরখ করার ক্ষমতা থেকেই তো জীবনকে নেড়েচেড়ে দেখার সাধ, চরিত্রচিত্রণে সেই সঙ্গে সমাজচিত্র অংকণে তার দক্ষতার পরিচয় মেলে উপন্যাসের কাহিনী বুননে, নারীজাতির ট্র্যাজেডী ফুটিয়ে তোলাতে তার বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। সেই সঙ্গে আরো যা দৃষ্টিগোচর হয়, তা হলো ফ্রয়েড ইজম-মার্ক্র ইজম-রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা-সাংকেতিকতাবাদ-অস্তিত্ববাদ-চেতনাপ্রবাহ পদ্ধতি-স্যুররিয়ালিজম প্রভৃতি মূখ্য। তারপরও বলতেই হয় যে কোনো ধরণের পাঠকের পক্ষে তার লেখা পাঠে এতোটুকু কষ্টসাধ্য নয়,এখানেই শওকত সর্বজনীন, কারণ সবার উপভোগ্য করে সহজ-সরল ভাষায় গল্পের পরিবেশ বর্ণনায় লেখকের কৃতিত্ব বিদ্যমান।
এখানে আমাদের থামতে হয়, বিভিন্ন দ্বন্দ্ব-সংঘাত আর মনস্তাত্তিকতায় ভরপুর মানুষের জীবন, সে জীবনকে কতোটুকু প্রত্যক্ষ করা যায়, রঙের আবরণে আচ্ছদিত থাকে, শওকত আলী পাঠকের সামনে খুলে ধরেছেন তার সম্ভবনা। ভাষায় জটিলতা নেই, আছে গভীরতা-ইতিহাস এবং সেই নষ্ট স্মৃতি বারংবার আমাদের পেছনে টেনে নিয়ে যায়। নয় বছরের এরশাদের স্বৈরশাসনের শ্বাসরুদ্ধকর-অপমানজনক ও অমানবিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার দুরন্ত শপথের কথা সমান্তরাল সত্যে ভাস্কর হয়ে ওঠে। শওকত আলী ষাট দশকে আগমন করেন সাহিত্যাঙ্গনে, তার লেখার ভাব ও পরিণতি বোঝাতে অনেক ইঙ্গিতধর্মী বাক্য ও উপমার আশ্রয় নিয়েছেন, প্রচলিত অনেক শব্দ-বাক্য নিজের মতো করে ব্যবহার করেছেন, যা হয়তো আমাদের প্রতিদিনেরই বাক্যালাপ, তারপর লেখকের শৈল্পিক গুণের কারণে উতরে গেছে এবং তা আরো বেশি উপভোগ্য হয়েছে বলা অপেক্ষা রাখে না। তার অবদান বাংলাদেশের উপন্যাসের সুসমৃদ্ধ করেছে, তার কাহিনী নির্বাচন-চরিত্রচিত্রণ-ভাষাশৈলী সর্বক্ষেত্রেই সীমাহীন কৃতিত্বের স্বাক্ষর ফুটে উঠেছে।
Download and Join our Facebook Group