Ticker

6/recent/ticker-posts

কালাপানির হাতছানি বিলেতে বাঙ্গালির ইতিহাস - গোলাম মুরশিদ

কালাপানির হাতছানি বিলেতে বাঙ্গালির ইতিহাস - গোলাম মুরশিদ

কালাপানির হাতছানি বিলেতে বাঙ্গালির ইতিহাস
গোলাম মুরশিদ

ভূমিকা
বাঙালিরা ঘরকুনোে - এ অপবাদ একদিন এমন বহুল-প্রচলিত ছিলাে যে, কবি বাংলা-মায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাদের লক্ষ্মীছাড়া করে ঘর থেকে বের করে দিতে। বের করে দিতে, যাতে তারা বহির্বিশ্বে গিয়ে অকর্মণ্য নাম ঘােচাতে পারেন। বহু প্রার্থনা ব্যর্থ হয়েছে কবির - বিশেষ করে বাঙালিরা এক হােক – এই করুণ মিনতি। কিন্তু বঙ্গমাতা তার সন্তানদের ঘর-ছাড়া করেছেন ঠিকই। এখন শতকরা প্রায় পাঁচজন বাঙালি বাস করেন মূল বাংলাভাষী অঞ্চল অর্থাৎ বাংলাদেশ, পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামের বাইরে। উত্তর আর দক্ষিণ মেরু বাদ দিলে পৃথিবীর অন্য সব জায়গাতেই বােধ হয় বাঙালিরা বাস করেন। অনেকের মতে, এখন আশি লাখ বাঙালি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন বঙ্গের বাইরে - পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, মধ্যপ্রাচ্যে, পূর্ব এবং দক্ষিণ ইউরােপে, পশ্চিম ইউরােপে, উত্তর ও দক্ষিণ অ্যামেরিকায়, অস্ট্রেলিয়ায়, এমন কি, গহন অরণ্যের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড আফ্রিকায়।
বহির্বিশ্বে বাঙালিদের এই যাত্রা শুরু হয়েছিলাে বিলেতের পথ ধরে। কাজটা আদৌ সহজ ছিলাে না। কারণ, ভয় ছিলাে কালাপানির। সে কেবল কুলহীন অতলান্ত নীল সাগরের ভীতি নয়। কালাপানি পার হওয়া ছিলাে ধর্ম-বিনাশী কাজ। যে-দেশে মানুষ কুমড়াে খাবে কি খাবে না, তাও ঠিক করে পাঁজি দেখে, সে দেশের মানুষ এতাে বড়াে নিষেধ অমান্য করে কিভাবে অজানা কুলের উদ্দেশে কালাপানিতে ভাসলেন এবং তারপর কিভাবে বিশ্বের দরবারে পৌছে গেলেন - সেই কাহিনী একদিকে যেমন রােমাঞ্চকর, অন্যদিকে তেমনি দারুণ কৌতূহলের।
এখন বিলেতের সবচেয়ে বড়াে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলাের মধ্যে একটি হলাে বাঙালিদের। ইংরেজরা বঙ্গদেশ জয় করেছিলেন। দু’শ বছর ধরে শাসন করেছিলেন, শােষণ করেছিলেন। তারপর ইংরেজরা যখন ফিরে গেলেন, বাঙালিরা - যেন তাদের তাড়া করে - তাদের পেছনে পেছনে বিলেতে গেলেন। তারা বিলেত শাসন করতে পারলেন না, শােষণও নয়। কিন্তু তারাও ইংরেজদের আংশিকভাবে জয় করলেন। বিলেতি সমাজের অবিচ্ছিন্ন অংশ হলেন তারা, তাদের খাদ্যাভ্যাসে ফেললেন অবিচ্ছেদ্য প্রভাব। ভেতাে বাঙালিদের সংস্পর্শে এসে ইংরেজরাও ভেতাে হলেন।
গৃহভৃত্য হিশেবে বাঙালিরা বিলেতে আসতে আরম্ভ করেন সতেরাে শতক থেকে। আর দেশভ্রমণের উদ্দেশে আসেন আঠারাে শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে। এই পথিকৃৎদের মধ্যে ছিলেন ইতেশাম উদ্দীন, ঘনশ্যাম দাস, আবু তালিব, রামমােহন, আনন্দচন্দ্র মজুমদার, দ্বারকানাথ - অনেকেই। সেই কাহিনী থেকে শুরু করে আজকের বিলেতি বাঙালিদের জীবনযাত্রার চিত্র পর্যন্ত - সংক্ষেপে সবই আলােচনা করার প্রয়াস পেয়েছি এই গ্রন্থে। এ বিষয়ে গবেষণার যে-সুযোগ এবং উপকরণ আছে, তার একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র আমি নেড়েচেড়ে দেখেছি। কারণ, আমি পণ্ডিতজনদের জন্যে নয়, লিখেছি সাধারণ পাঠকের কৌতূহল মেটানাের জন্যে। আরও গবেষণা পণ্ডিতরা করবেন। এই বইয়ের একটা অংশ খসড়া আকারে প্রথম আলাের ঈদ সংখ্যায় প্রকাশ করেছিলেন সাজ্জাদ শরীফ। তাকে আমার কৃতজ্ঞতা। কাজ করার সময়ে যাঁদের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছি, তাঁদেরও জানাই আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আর কৃতজ্ঞতা জানাই রােজিনা বিশ্রাম, মাইকেল ফিশার এবং অন্য যাদের গ্রন্থ থেকে বেশ কয়েকটা দুর্লভ ছবি নিয়েছি, তাদের। ডাণ্ডিশহরের বাঙালি পরিবারগুলাের তথ্য সংগ্রহ করে দিয়েছেন ইয়াসমীন করিম। তাকে ধন্যবাদ। এবারেও লেখার সময়ে এলিজা ধৈর্য তাে দেখিয়েছেনই, তার ওপর সহযােগিতাও করেছেন পুরােপুরি।
গােলাম মুরশিদ
লন্ডন, জানুয়ারি ২০০৮