পাকিস্থানের জন্ম মৃত্যু দর্শন - যতীন সরকার
‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’কে বলা যেতে পারে লেখকের স্মৃতিকথা। স্মৃতির আধারেই বিধৃত হয়েছে ইতিহাস। এ ইতিহাস কোনো বইয়ে পাওয়া যাবে না। মানুষের মনোলোকের ইতিহাস উঠে এসেছে এখানে।
এ বইয়ের ‘দর্শন’ শব্দটি ‘দেখা’ ও ‘ফিলসফি’-দুটো অর্থই ধারণ করেছে। পাকিস্তানের জন্ম ও মৃত্যুকে লেখক যেভাবে দেখেছেন তার বর্ণনা যেমন আছে এ বইয়ে, তেমনই আছে পাকিস্তান মানক রাষ্ট্রটির জন্ম ও মৃত্যর পেছনে সক্রিয় ছিল যে দর্শন তারও অনুপুঙ্ক্ষ বিশ্লেষণ। পাকিস্তানের জন্মের দর্শনটি ছিল একান্তই অপদর্শন। অপদর্শন ছিল বলেই পাকিস্তানের মৃত্যু ছিল অপরিহার্য। বাংলাদেশের জন্মের যে দর্শন, সেই দর্শনের মধ্যেই নিহিত ছিল পাকিস্তানের মৃত্যুর দর্শন। পাকিস্তানের এই জন্মমৃত্যুর দর্শন সম্পর্কে এ-রকম মনোগ্রাহী বিশ্লেষণ আর কোথাও পাওয়া যাবে না। লেখকের জীবন কেটেছে গ্রামে ও মফস্বল শহরে। আমাদের ইতিহাস বইগুলোতে গ্রামের চিন্তা-চেতনার পরিচয় কিংবা মফস্বল শহরের মানুষের অবদান সম্পর্কে কিচুই লেখা হয় না। ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ এক্ষেত্রেও একটি ব্যতিক্রমী পুস্তক। সাধারণ পাঠক যেমন, তেমনই ইতিহাস লেখকগণও এ বইয়ে অনেক ভাবনার খোরাক পাবেন।
বইটির উদ্ধৃতাংশ
পাকিস্তানের জন্মের আগে : হিন্দুদের কংগ্রেস-ভাবনা।
মহাত্মা গান্ধী কি জয়' নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু কি জয়' মওলানা আবুল কালাম আজাদ কি জয় জওহরলাল নেহেরু কি জয়'—এসব স্লোগান দিয়ে আমরা শান্ত পল্লীর পথ মুখরিত করে তুলতাম পাকিস্তানের জন্মের আগের বছর, ১৯৪৬ এর সাধারণ নির্বাচনের সময়। 'নির্বাচন'- এই ভারি বাংলা শব্দটা তখনো চালু হয়নি; শিক্ষিত লোকেরা বলতো ইলেকশান' আর বেশির ভাগ মানুষের কাছে এর নাম ভোটাভুটি'। এই ভোটাভুটিতে হিন্দু-মুসলমানের এক সঙ্গে যোগ দেয়ার কোন ব্যবস্থা ছিল না। বিধান ছিল : হিন্দুরা দেবে হিন্দু প্রার্থীকে ভোট, মুসলমানরা মুসলমানকে। এই স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতিতে হিন্দুদেরও ভোট ছিল দু'ভাগে বিভক্ত—বর্ণ হিন্দু আর তফসিলি হিন্দু। ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বৈদ্য ও নবশাখ সম্প্রদায়ের মানুষ, এবং এ-রকম আর যারা নিজেদের ‘ভদ্রলোক' মনে করতো, তারাই হলো বর্ণ হিন্দু। আর তফসিলী হিন্দু হলো তারা, যাদের ছোঁয়া লাগলে বর্ণ হিন্দুদের জাত যায়। ধোপা, মালী, নমশূদ্র, পাটনী, জেলে মুচি, ডোম, বাগদী—এ রকম সব শূদ্র আর অন্ত্যজ-নামে-পরিচিত মানুষরা, যারা সমাজে সব দিক দিয়েই পিছিয়ে-পড়ার দলে, তারাই বিশেষ তফসিলভুক্ত (অর্থাৎ তালিকাভুক্ত) হয়ে 'তফসিলি হিন্দু' নাম পায়। তবে বাংলা বা ফারসি ‘তফসিলি’র চেয়ে ইংরেজি ‘সিডিউলড কাস্ট' (Scheduled Caste) কথাটাই বেশি চালু ছিল। কান্ট হিন্দু আর সিডিউলড কান্ট হিন্দু নির্বাচনে এই দুই গােষ্ঠীর মানুষের আলাদা আলাদা প্রতিনিধি পাঠাবার ব্যবস্থা ছিল সে- সময়কার নির্বাচন-পদ্ধতিতে। তফসিলি ফেডারেশন' নামে একটি সংগঠনও ছিল সিডিউলড কাস্ট হিন্দুদের। কিন্তু বর্ণ হিন্দুই হােক আর তফসিলি হিন্দুই হােক, হিন্দুদের রাজনীতিতে তখন কংগ্রেস দলেরই জয়জয়কার। অন্তত আমাদের এলাকায় তো তাই দেখেছি।
রামপুর বাজারে এসে কংগ্রেস নেতারা বক্তৃতা করেছেন। মাঝারি স্তরের মহকুমা পর্যায়ের নেতা। সে-নেতাদের কারাে নাম আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে, তাদের মাথায় থাকতো “গান্ধী টুপি'। এই টুপিটা আমার খুবই কৌতূহলের বস্তু হয়ে উঠেছিল। মুসলমান মৌলবী সাহেবরা টুপি পরেন দেখেছি, তবে তাঁদের টুপির আকৃতি গােল। গান্ধী টুপির লম্বাকৃতিটাই মৌলবীদের টুপি থেকে তাকে পৃথক করেছে। শুধু মৌলবীদের থেকেই বা বলি কেন, গান্ধী টুপি তো সকল মুসলমানের থেকেই হিন্দুদের পার্থক্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ছেচল্লিশ সনের আগে তো গ্রামে কোনো টুপিওয়ালা হিন্দু দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এবার হিন্দুর মাথায় টুপি উঠলো, তবে সে টুপিতেও হিন্দুত্বের চিহ্ন স্পষ্ট করে আঁকা।
কংগ্রেস নেতারা অবশ্য হিন্দুত্বের কথা বলতেন না। মুসলমান-বিরােধী কোনো কথাও তাদের মুখে শুনিনি। মহাত্মাজী নেতাজী পণ্ডিতজী সকলেই যে হিন্দু-মুসলমান সকলের নেতা, মুসলমান যাকে আল্লাহ্ আর হিন্দু ভগবান বলে যাকে তার চোখে সকলেই যে সমান, হিন্দু আর মুসলমান যে একই মায়ের পেটের দুই ভাইয়ের মতো, সাত-সমুদ্র তেরাে নদীর ওপার থেকে আসা ইংরেজরা যে এদেশের হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান সকলের সমান দুশমন—এসব কথাই কংগ্রেস নেতারা সভায় জোর দিয়ে বলতেন। কংগ্রেসের চোখে যে হিন্দু-মুসলমানে কোন ভেদ নেই, সে-কথাটা বােঝাবার জন্যই তারা বারবার মওলানা আবুল কালাম আজাদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেন। মওলানা আবুল কালাম আজাদ এতো বড়াে একজন মুসলিম শাস্ত্রবিদ পণ্ডিত, তিনি হলেন কংগ্রেসের সভাপতি—মূল নেতা। এরকম একজন শ্রদ্ধেয় মুসলমান যে- দলের নেতা, সে-দল কি কেবল হিন্দুদের দল হতে পারে?
তবে, কংগ্রেসের নেতারা যাই বলুন, আমার কিন্তু সেই ১৯৪৬ সালে—যখন আমার বয়স মাত্র দশ এবং আমি রামপুর ফ্রি বাের্ড প্রাইমারি স্কুলের ক্লাস ফোরের ছাত্র—মনে হয়েছিল যে, কংগ্রেস কেবল হিন্দুদেরই পার্টি। কারণ, কংগ্রেসের সভাগুলোতে কোনো মুসলমানকে দেখেছি বলে মনেই পড়ে না। সভার শেষে নির্বাচনী মিছিলে যারা যোগ দিতো, তারাও সবাই হিন্দু যুবক। রামপুরের কামিনী চক্রবর্তীর ছেলে জীবন, মহেন্দ্র চৌধুরীর ছেলে ফণি ও রণি এবং বুধপাশা, নন্দীগ্রাম ও আশুজিয়া গ্রামের এ-রকম বেশ কিছু হিন্দু যুবক কংগ্রেসের এসব মিছিল সংগঠিত করতো, আর রামপুর ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের ক্লাস থ্রি-ফোরের ছাত্র অনিল, সুশীল, ননীগােপাল, প্রাণেশরা চিৎকার করে স্লোগান ধরতো। এ-ব্যাপারে আমার তো ছিল সীমাহীন উৎসাহ। কিন্তু আমারই অন্তরঙ্গ সহপাঠী হােসেন আলী কোনোদিন কংগ্রেসের সভাতেও যায়নি, মিছিলেও যায়নি। যায়নি গফুর, হামিদ, হাশিমউদ্দিন, চান মিয়া, সুরুজ আলী, রশিদ—এ রকম কেউই। তাহলে কংগ্রেসকে হিন্দুদের পার্টি ছাড়া আর কী বলি?
আসলে কংগ্রেসের কথাই বলি বা অন্য যে কোনো রাজনৈতিক দলের কথাই বলি, গৈ গেরামের মানুষের কাছে এ-সবের কথা তো ইলেকশনকে কেন্দ্র করেই পৌছেছিল। ইলেকশন হচ্ছিল হিন্দু মুসলমানের আলাদা আলাদা। হিন্দুদের থেকে আলাদা হয়ে বাস করে মুসলমানের স্বার্থ রক্ষার কথা বলে মুসলিম লীগ মাঠে নেমেছে। মুসলিম লীগের ক্যান্ডিডেট গেছে মুসলমানের কাছে ভোট চাইতে, কংগ্রেস ক্যান্ডিডেট গেছে হিন্দুর কাছে। আমার মতো দশ বছরের ছেলের ভোট না থাকলেও, আমিতো হিন্দু; আমার বাপ-ঠাকুরদা ভোট দেবেন কংগ্রেসকে, কংগ্রেসের কথা তাদের মুখে মুখে, তাদের সঙ্গে আমিও কংগ্রেসের সভায় যাই। আমার বয়স অল্প বলে আমার উৎসাহ তো তাদের থেকে বেশি হবেই। দৌড় ঝাপ খেলাধুলা করতে গুরুজনরা আমাকে সব সময় নিরুৎসাহিত করলেও সভা-মিছিলের ব্যাপারে করতেন তার উল্টোটা। সেই ছেলেবেলায় সভা আর মিছিল আমার কাছে খেলাধুলার বিকল্প হয়ে দেখা দিয়েছিল, এবং সে-বিকল্প ছিল খেলাধুলার চেয়ে অনেক বেশি উদ্দীপক ও আনন্দদায়ক। বেশ মনে আছে, ছেচল্লিশের ইলেকশনের আগে ও পরে কয়েকটা মাস এক নতুন ধরনের আনন্দে একেবারে টৈ টুম্বুর হয়ে ছিলাম। কংগ্রেসের স্লোগানগুলো তো আমার কাছে গানের চেয়েও বেশি চিত্তরঞ্জক হয়ে উঠেছিল। গান্ধী, নেহেরু, আজাদ, সুভাষের নামে জয় উচ্চারণ করার পাশাপাশি আর যে স্লোগানগুলোর সঙ্গে আমরা গলা মেলাতাম সেগুলো হলো—বন্দেমাতরম, জয়হিন্দ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হােক এবং ইনকিলাব জিন্দাবাদ। শেষের স্লোগানটা ছিল কম্যুনিস্টদেরও। আসলে এটি নাকি আদিতে কম্যুনিস্টদেরই ছিল, পরে কংগ্রেসীরাও তাকে গলায় তুলে নেয়। জ্ঞানের আলো' নামে একটি সাধারণ জ্ঞানের বই আমাদের পাঠ্য ছিল। প্রশ্নোত্তরের ধাঁচে তাতে লেখা ছিল, ইনকিলাব জিন্দাবাদ কথাটার অর্থ কি? উত্তর—বিপ্লব দীর্ঘজীবী হউক।' এতেও আমার কাছে অর্থটা খুবই একটা পরিষ্কার হয়নি। ইনকিলাব' কিংবা ‘বিপ্লব' এ দুয়ের কোনোটারই সঠিক তাৎপর্য সে বয়সে আমার চৈতন্যে ধরা পড়েনি। তবু এই স্লোগানটা উচ্চারণ করতে খুব জোশ পেতাম। জয়হিন্দু' শব্দটা তো কয়েকমাস ধরে আমাদের সার্বক্ষণিক বুলিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আমরা বালকরা (অবশ্যই হিন্দু বালকরা) পরস্পরকে ‘জয়হিন্দ' বলে প্রীতি সম্ভাষণ করতাম। আমাদের শেখানো হয়েছিল চিঠির শিরােভাগে লিখতে হয় শ্রীশ্রীদুর্গা কিংবা শ্রীশ্রী হরি। এখন দুর্গা ও হরির স্থান দখল করলো 'জয়হিন্দ'।
আমাদের গাঁয়ের পূর্বদিকে উগরাকান্দা বাজারে চৈত্রমাসে বারুণী মেলা বসতো। এখনো হয়তো বসে। জানি না, এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে সে-মেলার আকর্ষণ কতোখানি। তবে আমি এখনো, এই বুড়াে বয়সেও, চোখ বুজলেই বারুণীর মেলার উত্তেজনায় আট-দশ বছরের বালকটি হয়ে যাই। একদিনের মেলা, কিন্তু সারা বছর তার আমেজ লেগে থাকতত আমাদের মনে। মেলায় জিলিপি ভাজা হতো, কুড়মুড় ভাজা আর শােন পাপড়ি বিক্রি হতো, চিনির তৈরি হাতিঘােড়া ও বিন্নি ধানের খৈ পাওয়া যেতো, আমাদের মতো ছেলেদের মুখে সারাক্ষণ টিনের বাঁশী বাজতো, বেলুন ফাটার ফটাস ফটাস শব্দ হতো, ছেলেমেয়েরা নাগরদোলায় চড়ে মহানন্দে দোল খেতো, ছােট ছােট মেয়েরা আল্লাদী পুতুল কিনতো, ম্যাজিকওয়ালা ম্যাজিক দেখাতো, এক আনার টিকেটে লটারী খেলা হতো এক দিনের জন্য যেন আমাদের কাছে স্বর্গ নেমে আসতো। ছেচল্লিশ সালে বারুণীর মেলায় আরেকটা নতুন জিনিস এসে যুক্ত হলো। গান্ধী, সুভাষ, নেহেরুর ছবিওয়ালা ব্যাজ'। একটা ব্যাজের দাম মাত্র দু'আনা। সুভাষের ছবিওয়ালা ব্যাজই হয়েছিল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। বালক-কিশাের-যুবকদের বুকে বুকে শশাভা পেতে এই ব্যাজ। ব্যাজ বুকে লাগিয়ে সবাই যেন নিজেকে ভাবতে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের এক এক জন সৈনিক।
‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’কে বলা যেতে পারে লেখকের স্মৃতিকথা। স্মৃতির আধারেই বিধৃত হয়েছে ইতিহাস। এ ইতিহাস কোনো বইয়ে পাওয়া যাবে না। মানুষের মনোলোকের ইতিহাস উঠে এসেছে এখানে।
এ বইয়ের ‘দর্শন’ শব্দটি ‘দেখা’ ও ‘ফিলসফি’-দুটো অর্থই ধারণ করেছে। পাকিস্তানের জন্ম ও মৃত্যুকে লেখক যেভাবে দেখেছেন তার বর্ণনা যেমন আছে এ বইয়ে, তেমনই আছে পাকিস্তান মানক রাষ্ট্রটির জন্ম ও মৃত্যর পেছনে সক্রিয় ছিল যে দর্শন তারও অনুপুঙ্ক্ষ বিশ্লেষণ। পাকিস্তানের জন্মের দর্শনটি ছিল একান্তই অপদর্শন। অপদর্শন ছিল বলেই পাকিস্তানের মৃত্যু ছিল অপরিহার্য। বাংলাদেশের জন্মের যে দর্শন, সেই দর্শনের মধ্যেই নিহিত ছিল পাকিস্তানের মৃত্যুর দর্শন। পাকিস্তানের এই জন্মমৃত্যুর দর্শন সম্পর্কে এ-রকম মনোগ্রাহী বিশ্লেষণ আর কোথাও পাওয়া যাবে না। লেখকের জীবন কেটেছে গ্রামে ও মফস্বল শহরে। আমাদের ইতিহাস বইগুলোতে গ্রামের চিন্তা-চেতনার পরিচয় কিংবা মফস্বল শহরের মানুষের অবদান সম্পর্কে কিচুই লেখা হয় না। ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ এক্ষেত্রেও একটি ব্যতিক্রমী পুস্তক। সাধারণ পাঠক যেমন, তেমনই ইতিহাস লেখকগণও এ বইয়ে অনেক ভাবনার খোরাক পাবেন।
বইটির উদ্ধৃতাংশ
পাকিস্তানের জন্মের আগে : হিন্দুদের কংগ্রেস-ভাবনা।
মহাত্মা গান্ধী কি জয়' নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু কি জয়' মওলানা আবুল কালাম আজাদ কি জয় জওহরলাল নেহেরু কি জয়'—এসব স্লোগান দিয়ে আমরা শান্ত পল্লীর পথ মুখরিত করে তুলতাম পাকিস্তানের জন্মের আগের বছর, ১৯৪৬ এর সাধারণ নির্বাচনের সময়। 'নির্বাচন'- এই ভারি বাংলা শব্দটা তখনো চালু হয়নি; শিক্ষিত লোকেরা বলতো ইলেকশান' আর বেশির ভাগ মানুষের কাছে এর নাম ভোটাভুটি'। এই ভোটাভুটিতে হিন্দু-মুসলমানের এক সঙ্গে যোগ দেয়ার কোন ব্যবস্থা ছিল না। বিধান ছিল : হিন্দুরা দেবে হিন্দু প্রার্থীকে ভোট, মুসলমানরা মুসলমানকে। এই স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতিতে হিন্দুদেরও ভোট ছিল দু'ভাগে বিভক্ত—বর্ণ হিন্দু আর তফসিলি হিন্দু। ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বৈদ্য ও নবশাখ সম্প্রদায়ের মানুষ, এবং এ-রকম আর যারা নিজেদের ‘ভদ্রলোক' মনে করতো, তারাই হলো বর্ণ হিন্দু। আর তফসিলী হিন্দু হলো তারা, যাদের ছোঁয়া লাগলে বর্ণ হিন্দুদের জাত যায়। ধোপা, মালী, নমশূদ্র, পাটনী, জেলে মুচি, ডোম, বাগদী—এ রকম সব শূদ্র আর অন্ত্যজ-নামে-পরিচিত মানুষরা, যারা সমাজে সব দিক দিয়েই পিছিয়ে-পড়ার দলে, তারাই বিশেষ তফসিলভুক্ত (অর্থাৎ তালিকাভুক্ত) হয়ে 'তফসিলি হিন্দু' নাম পায়। তবে বাংলা বা ফারসি ‘তফসিলি’র চেয়ে ইংরেজি ‘সিডিউলড কাস্ট' (Scheduled Caste) কথাটাই বেশি চালু ছিল। কান্ট হিন্দু আর সিডিউলড কান্ট হিন্দু নির্বাচনে এই দুই গােষ্ঠীর মানুষের আলাদা আলাদা প্রতিনিধি পাঠাবার ব্যবস্থা ছিল সে- সময়কার নির্বাচন-পদ্ধতিতে। তফসিলি ফেডারেশন' নামে একটি সংগঠনও ছিল সিডিউলড কাস্ট হিন্দুদের। কিন্তু বর্ণ হিন্দুই হােক আর তফসিলি হিন্দুই হােক, হিন্দুদের রাজনীতিতে তখন কংগ্রেস দলেরই জয়জয়কার। অন্তত আমাদের এলাকায় তো তাই দেখেছি।
রামপুর বাজারে এসে কংগ্রেস নেতারা বক্তৃতা করেছেন। মাঝারি স্তরের মহকুমা পর্যায়ের নেতা। সে-নেতাদের কারাে নাম আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে, তাদের মাথায় থাকতো “গান্ধী টুপি'। এই টুপিটা আমার খুবই কৌতূহলের বস্তু হয়ে উঠেছিল। মুসলমান মৌলবী সাহেবরা টুপি পরেন দেখেছি, তবে তাঁদের টুপির আকৃতি গােল। গান্ধী টুপির লম্বাকৃতিটাই মৌলবীদের টুপি থেকে তাকে পৃথক করেছে। শুধু মৌলবীদের থেকেই বা বলি কেন, গান্ধী টুপি তো সকল মুসলমানের থেকেই হিন্দুদের পার্থক্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ছেচল্লিশ সনের আগে তো গ্রামে কোনো টুপিওয়ালা হিন্দু দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এবার হিন্দুর মাথায় টুপি উঠলো, তবে সে টুপিতেও হিন্দুত্বের চিহ্ন স্পষ্ট করে আঁকা।
কংগ্রেস নেতারা অবশ্য হিন্দুত্বের কথা বলতেন না। মুসলমান-বিরােধী কোনো কথাও তাদের মুখে শুনিনি। মহাত্মাজী নেতাজী পণ্ডিতজী সকলেই যে হিন্দু-মুসলমান সকলের নেতা, মুসলমান যাকে আল্লাহ্ আর হিন্দু ভগবান বলে যাকে তার চোখে সকলেই যে সমান, হিন্দু আর মুসলমান যে একই মায়ের পেটের দুই ভাইয়ের মতো, সাত-সমুদ্র তেরাে নদীর ওপার থেকে আসা ইংরেজরা যে এদেশের হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান সকলের সমান দুশমন—এসব কথাই কংগ্রেস নেতারা সভায় জোর দিয়ে বলতেন। কংগ্রেসের চোখে যে হিন্দু-মুসলমানে কোন ভেদ নেই, সে-কথাটা বােঝাবার জন্যই তারা বারবার মওলানা আবুল কালাম আজাদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেন। মওলানা আবুল কালাম আজাদ এতো বড়াে একজন মুসলিম শাস্ত্রবিদ পণ্ডিত, তিনি হলেন কংগ্রেসের সভাপতি—মূল নেতা। এরকম একজন শ্রদ্ধেয় মুসলমান যে- দলের নেতা, সে-দল কি কেবল হিন্দুদের দল হতে পারে?
তবে, কংগ্রেসের নেতারা যাই বলুন, আমার কিন্তু সেই ১৯৪৬ সালে—যখন আমার বয়স মাত্র দশ এবং আমি রামপুর ফ্রি বাের্ড প্রাইমারি স্কুলের ক্লাস ফোরের ছাত্র—মনে হয়েছিল যে, কংগ্রেস কেবল হিন্দুদেরই পার্টি। কারণ, কংগ্রেসের সভাগুলোতে কোনো মুসলমানকে দেখেছি বলে মনেই পড়ে না। সভার শেষে নির্বাচনী মিছিলে যারা যোগ দিতো, তারাও সবাই হিন্দু যুবক। রামপুরের কামিনী চক্রবর্তীর ছেলে জীবন, মহেন্দ্র চৌধুরীর ছেলে ফণি ও রণি এবং বুধপাশা, নন্দীগ্রাম ও আশুজিয়া গ্রামের এ-রকম বেশ কিছু হিন্দু যুবক কংগ্রেসের এসব মিছিল সংগঠিত করতো, আর রামপুর ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের ক্লাস থ্রি-ফোরের ছাত্র অনিল, সুশীল, ননীগােপাল, প্রাণেশরা চিৎকার করে স্লোগান ধরতো। এ-ব্যাপারে আমার তো ছিল সীমাহীন উৎসাহ। কিন্তু আমারই অন্তরঙ্গ সহপাঠী হােসেন আলী কোনোদিন কংগ্রেসের সভাতেও যায়নি, মিছিলেও যায়নি। যায়নি গফুর, হামিদ, হাশিমউদ্দিন, চান মিয়া, সুরুজ আলী, রশিদ—এ রকম কেউই। তাহলে কংগ্রেসকে হিন্দুদের পার্টি ছাড়া আর কী বলি?
আসলে কংগ্রেসের কথাই বলি বা অন্য যে কোনো রাজনৈতিক দলের কথাই বলি, গৈ গেরামের মানুষের কাছে এ-সবের কথা তো ইলেকশনকে কেন্দ্র করেই পৌছেছিল। ইলেকশন হচ্ছিল হিন্দু মুসলমানের আলাদা আলাদা। হিন্দুদের থেকে আলাদা হয়ে বাস করে মুসলমানের স্বার্থ রক্ষার কথা বলে মুসলিম লীগ মাঠে নেমেছে। মুসলিম লীগের ক্যান্ডিডেট গেছে মুসলমানের কাছে ভোট চাইতে, কংগ্রেস ক্যান্ডিডেট গেছে হিন্দুর কাছে। আমার মতো দশ বছরের ছেলের ভোট না থাকলেও, আমিতো হিন্দু; আমার বাপ-ঠাকুরদা ভোট দেবেন কংগ্রেসকে, কংগ্রেসের কথা তাদের মুখে মুখে, তাদের সঙ্গে আমিও কংগ্রেসের সভায় যাই। আমার বয়স অল্প বলে আমার উৎসাহ তো তাদের থেকে বেশি হবেই। দৌড় ঝাপ খেলাধুলা করতে গুরুজনরা আমাকে সব সময় নিরুৎসাহিত করলেও সভা-মিছিলের ব্যাপারে করতেন তার উল্টোটা। সেই ছেলেবেলায় সভা আর মিছিল আমার কাছে খেলাধুলার বিকল্প হয়ে দেখা দিয়েছিল, এবং সে-বিকল্প ছিল খেলাধুলার চেয়ে অনেক বেশি উদ্দীপক ও আনন্দদায়ক। বেশ মনে আছে, ছেচল্লিশের ইলেকশনের আগে ও পরে কয়েকটা মাস এক নতুন ধরনের আনন্দে একেবারে টৈ টুম্বুর হয়ে ছিলাম। কংগ্রেসের স্লোগানগুলো তো আমার কাছে গানের চেয়েও বেশি চিত্তরঞ্জক হয়ে উঠেছিল। গান্ধী, নেহেরু, আজাদ, সুভাষের নামে জয় উচ্চারণ করার পাশাপাশি আর যে স্লোগানগুলোর সঙ্গে আমরা গলা মেলাতাম সেগুলো হলো—বন্দেমাতরম, জয়হিন্দ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হােক এবং ইনকিলাব জিন্দাবাদ। শেষের স্লোগানটা ছিল কম্যুনিস্টদেরও। আসলে এটি নাকি আদিতে কম্যুনিস্টদেরই ছিল, পরে কংগ্রেসীরাও তাকে গলায় তুলে নেয়। জ্ঞানের আলো' নামে একটি সাধারণ জ্ঞানের বই আমাদের পাঠ্য ছিল। প্রশ্নোত্তরের ধাঁচে তাতে লেখা ছিল, ইনকিলাব জিন্দাবাদ কথাটার অর্থ কি? উত্তর—বিপ্লব দীর্ঘজীবী হউক।' এতেও আমার কাছে অর্থটা খুবই একটা পরিষ্কার হয়নি। ইনকিলাব' কিংবা ‘বিপ্লব' এ দুয়ের কোনোটারই সঠিক তাৎপর্য সে বয়সে আমার চৈতন্যে ধরা পড়েনি। তবু এই স্লোগানটা উচ্চারণ করতে খুব জোশ পেতাম। জয়হিন্দু' শব্দটা তো কয়েকমাস ধরে আমাদের সার্বক্ষণিক বুলিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আমরা বালকরা (অবশ্যই হিন্দু বালকরা) পরস্পরকে ‘জয়হিন্দ' বলে প্রীতি সম্ভাষণ করতাম। আমাদের শেখানো হয়েছিল চিঠির শিরােভাগে লিখতে হয় শ্রীশ্রীদুর্গা কিংবা শ্রীশ্রী হরি। এখন দুর্গা ও হরির স্থান দখল করলো 'জয়হিন্দ'।
আমাদের গাঁয়ের পূর্বদিকে উগরাকান্দা বাজারে চৈত্রমাসে বারুণী মেলা বসতো। এখনো হয়তো বসে। জানি না, এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে সে-মেলার আকর্ষণ কতোখানি। তবে আমি এখনো, এই বুড়াে বয়সেও, চোখ বুজলেই বারুণীর মেলার উত্তেজনায় আট-দশ বছরের বালকটি হয়ে যাই। একদিনের মেলা, কিন্তু সারা বছর তার আমেজ লেগে থাকতত আমাদের মনে। মেলায় জিলিপি ভাজা হতো, কুড়মুড় ভাজা আর শােন পাপড়ি বিক্রি হতো, চিনির তৈরি হাতিঘােড়া ও বিন্নি ধানের খৈ পাওয়া যেতো, আমাদের মতো ছেলেদের মুখে সারাক্ষণ টিনের বাঁশী বাজতো, বেলুন ফাটার ফটাস ফটাস শব্দ হতো, ছেলেমেয়েরা নাগরদোলায় চড়ে মহানন্দে দোল খেতো, ছােট ছােট মেয়েরা আল্লাদী পুতুল কিনতো, ম্যাজিকওয়ালা ম্যাজিক দেখাতো, এক আনার টিকেটে লটারী খেলা হতো এক দিনের জন্য যেন আমাদের কাছে স্বর্গ নেমে আসতো। ছেচল্লিশ সালে বারুণীর মেলায় আরেকটা নতুন জিনিস এসে যুক্ত হলো। গান্ধী, সুভাষ, নেহেরুর ছবিওয়ালা ব্যাজ'। একটা ব্যাজের দাম মাত্র দু'আনা। সুভাষের ছবিওয়ালা ব্যাজই হয়েছিল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। বালক-কিশাের-যুবকদের বুকে বুকে শশাভা পেতে এই ব্যাজ। ব্যাজ বুকে লাগিয়ে সবাই যেন নিজেকে ভাবতে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের এক এক জন সৈনিক।
বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক!