বাংলা টেলিভিশনের ৫০ বছর - ফরিদুর রেজা সাগর
বাংলা টেলিভিশনের ৫০ বছর সরল গদ্যে লেখা এক অনন্য দলিল। টেলিভিশন তখন এক ‘আজব বাক্স’ কিংবা ‘জাদুর বাক্স’। সেই বাক্সের প্রেমে মোহগ্রস্ত হন তিনি শৈশব-কৈশোরে। বলতে গেলে টেলিভিশনের আবহেই বেড়ে ওঠা তাঁর। তাই বড় হয়ে টেলিভিশন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে লিখেছেন নানা ধরনের লেখা। হ্যাঁ, খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক, টিভি ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগরের কথাই বলছি। তাঁর সেসব লেখায় ফুটে উঠেছে কখনও স্মৃতিকথা, কখনও নতুন পরিকল্পনা, কখনও বা মিডিয়া ভাবনা। সেই লেখাগুলো নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর চারটি বই ‘একজীবনে টেলিভিশন’, ‘টেলিভিশন আরেক জীবন’, ‘টেলিভিশন : জীবনের সঙ্গী’, ‘টেলিভিশন ভাবনা’। আলোচ্য বইটি এই চারটি বইয়েরই সঙ্কলিত রূপ।
বর্তমানে গণমাধ্যমই সময়ের সবচেয়ে বড় প্রভাবক। ব্যক্তি, সমাজ, এমনকি রাষ্ট্রীয় জীবনে গণমাধ্যম আজ সবচেয়ে বড় অনুঘটক। গণমানুষের চেতনা বিকাশ থেকে শুরু করে সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এর অবদান আজ অনস্বীকার্য। আর এই সময়টিতে পৌঁছতে কেটে গেছে অর্ধশতাব্দীকাল। বাংলা টেলিভিশনের অর্থশতাব্দী। আর বাংলাদেশ টেলিভিশনের সুবর্ণ জয়ন্তীর এ মাহেন্দ্রক্ষণে প্রকাশিত হয়েছে ফরিদুর রেজা সাগরের টেলিভিশনবিষয়ক বৃহৎ গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ টেলিভিশনের ৫০ বছর’। গ্রন্থের মুখবন্ধে লেখকের সুহৃদ শাইখ সিরাজ উল্লেখ করেনÑ ‘আমার বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে। আমরা একসঙ্গে যারা বেড়ে উঠেছি তাদের প্রায় সবাই ষাটোর্ধ্ব। আমার বন্ধু ফরিদুর রেজা সাগর এই ষাটোর্ধ্ব জীবনে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন টেলিভিশনের সঙ্গে। ওর জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে টেলিভিশন। চেতনায় ও মননে টেলিভিশন। যারা আমাদের বয়সী তারা টেলিভিশনকে পঞ্চাশ বছর ধরে দেখছি, কিন্তু সাগর যেভাবে দেখেছেন বা দেখছেন তা আর কেউ দেখছি বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ টেলিভিশনের যন্ত্রপাতি, আসবাব, কর্মঘণ্টাসহ প্রতিটি কর্মীর সঙ্গে ওর নিবিড় সখ্য। বলা যায় টেলিভিশনই ওকে তৈরি করেছে একজন ফরিদুর রেজা সাগর-এ। টেলিভিশন জীবনে দীর্ঘকাল যুক্ত থাকার সুবাদে গভীরভাবে উপলব্ধি করছি, এরকম একটি গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়ার মতো অনেকেই ছিলেন, কিন্তু সাহস করে এগিয়েছেন শুধু সাগর। সাফল্যের সঙ্গে সুচারুভাবে এমন ঐতিহাসিক একটি দলিল, সরল গদ্যে লিখেছেন। যা টেলিভিশনের এই যুগে এই মাধ্যমের যে কোনো অংশের সঙ্গে যুক্ত যে কোনো মানুষকে তথ্যে সমৃদ্ধ করবে, জানাবে বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশের আরেকটি পর্যায়ের গল্পগুলোর ভেতরের আনন্দ, রস ও উত্থান-পতনের কাহিনি।’
বইতে রয়েছে বিটিভির সোনালি যুগের বহু নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, টকশো, বিষয়ভিত্তিক অনুষ্ঠান, কুইজ অনুষ্ঠান, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ধারাবাহিক নাটক, লাইভ ফোন ইন অনুষ্ঠান, সঙ্গীতানুষ্ঠান, ছোটদের অনুষ্ঠান, ছোটদের প্রতিভা সন্ধান (নতুন কুঁড়ি) ও অসংখ্য সফল ও জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গ। বইয়ের কয়েকটি অধ্যায়ে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অসহযোগের সময় ও মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ ঢাকায় বিটিভির সাহসী ভূমিকাও আলোচিত হয়েছে। বইটির ভূমিকায় মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর লিখেছেনÑ “এই বইতে ‘বাংলাদেশে টেলিভিশনের’ পটভূমি, জন্ম, সূচনা পর্ব ও ডিআইটি পর্বের প্রথম একদশক সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে, যা যে কোন পাঠককে কৌতূহলী করে তুলবে। বিশেষ করে যাঁরা স্যাটেলাইট টিভির যুগের শিল্পী ও কর্মী তাঁদের কাছে ‘বিটিভি’র ডিআইটি পর্ব রূপকথার মতো মনে হবে। অথচ একদিন সেটাই ছিল বাস্তব।”মছোট ছোট বিভিন্ন পর্বে ভাগ করে লেখা হয়েছে বইটি। হাতের মুঠোয় টেলিভিশন, প্রাণের ছোঁয়ায় টেলিভিশন, প্রাণের স্পন্দনে টেলিভিশন, সবাইকে নিয়ে টেলিভিশন, প্রতিভার খোঁজে টেলিভিশন, গৌরবের টেলিভিশন, আন্তরিকতার টেলিভিশন, দেশপ্রেমের টেলিভিশন, গীতিময় টেলিভিশন, সোনালি দিনের টেলিভিশন, মমতার টেলিভিশন, সরাসরি টেলিভিশন, প্রতিভাবানের টেলিভিশন, সুখস্মৃতির টেলিভিশন, মায়ামমতার টেলিভিশন, সৃজনশীলতার টেলিভিশন, সোনালি সময়ের টেলিভিশন, স্নিগ্ধতার টেলিভিশন, দূরদৃষ্টির টেলিভিশন, উজ্জ্বলতার টেলিভিশন, অস্তিত্বের টেলিভিশন, উজ্জ্বল স্মৃতির টেলিভিশন, ছন্দে আনন্দে টেলিভিশন, প্রাণের গানের টেলিভিশন, আসা-যাওয়ার টেলিভিশন, প্রত্যাশার টেলিভিশন, প্রেম-ভালোবাসার টেলিভিশন, শিক্ষায় টেলিভিশন, জীবনযাত্রার টেলিভিশন, সামনে চলার টেলিভিশন, ভালবাসার টেলিভিশন, উৎসব টেলিভিশন, ইচ্ছাপূরণের টেলিভিশন, মন ছুঁয়ে যাওয়া টেলিভিশন, আলো-ছায়ার টেলিভিশন, রংতুলির টেলিভিশন, চিরসবুজ টেলিভিশন, সূচনার টেলিভিশন, সময় নির্ধারণের টেলিভিশন, ইতিহাসের টেলিভিশন ইত্যাদি শিরোনামে শেষ হয় প্রথম পর্ব ‘একজীবনে টেলিভিশন’। এরপর যথাক্রমে ‘টেলিভিশন আরেক জীবন’, ‘টেলিভিশন : জীবনের সঙ্গী’, ‘টেলিভিশন ভাবনা’ অধ্যায়গুলো। ‘বিটিভি’ সম্পর্কে এমন তথ্যবহুল, সুখপাঠ্য বই সত্যিই বিরল। ফরিদুর রেজা সাগর সেই অসাধ্য সাধন করেছেন।