অলীক মানুষ - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
সিরাজের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস অলীক মানুষ। এই উপন্যাস লেখার প্রস্ত্ততিপর্বে ইতিহাস দর্শন, সাহিত্য, নানা ধর্মের ধর্মশাস্ত্র, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি নানা বিষয়ের ওপর তিনি গভীর পড়াশোনা করেছেন। চতুরঙ্গ পত্রিকার আমন্ত্রণে অলীক মানুষ উপন্যাস লেখা শুরু করেন। আটটি পরিচ্ছেদ লেখার পর তিনি চতুরঙ্গ সম্পাদককে লেখায় বিরতি টানার কথা জানান। প্রীতিভাজন সম্পাদক আবদুর রাউফ সম্প্রতি ফোনে অলীক মানুষ লেখার পটভূমিতে সে-কথা সমর্থন করেন। তখন চতুরঙ্গ-সম্পাদকের সনির্বন্ধ অনুরোধে, উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে আরো অনেকদিন লেখার জন্য সিরাজ গভীরমনস্কচিত্তে নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, দর্শনশাস্ত্র, ইতিহাসের পাশাপাশি হোমার-দান্তে-ওভিদ-নিৎশে-বোদলেয়ার, গ্যেটে, সফোক্লিস-প্লেটো-বৃহদারণ্যক উপনিষদ-কঠোপনিষদ-হাফিজ প্রভৃতি বিশ্বের সাহিত্যগ্রন্থ পাঠে নিরত হন। এই গ্রন্থরচনার প্রেক্ষিতে জানান, ‘আমার মনে শুধু এটুকু চিন্তা ছিল ব্যক্তিজীবনকে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে স্থাপন এবং বিমূর্তায়ন।... এই উপন্যাসে আমি অনেক দেশি-বিদেশি উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছি - সে-সব উদ্ধৃতি ভাষায় বিভিন্ন। আমি কখনই পন্ডিতি দেখাতে চাইনি। আসলে বিমূর্তায়নের প্রয়োজনে উদ্ধৃতিগুলিকে আবহসংগীত হিসাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছি।’
বদু পীর জীবনস্রোতে যেন মহামানব থেকে অলৌকিক হয়ে যান। তাঁর পুরো নাম সৈয়দ আবুল কাসেম মুহম্মদ বদিউজ্জামান আল-হুসেইদি আল-খুরাসানি। তাঁর পুত্র শফিউজ্জামান ঘটনা পরম্পরায় ধর্মদ্রোহী থেকে নৈরাজ্যবাদী, পরিণামে আত্মদ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত নিষ্ঠুর ঘাতক। লৌকিক-অলৌকিক, মায়া-বাস্তবতা মেশানো এই উপন্যাস সম্পর্কে লেখক সিরাজ বলেছেন : ‘অলীক মানুষ’ বলতে আমি বুঝিয়েছি ‘মিথিক্যাল ম্যান’। রক্তমাংসের মানুষকে কেন্দ্র করে যে মিথ গড়ে ওঠে - সেই মিথই (myth) একসময় মানুষের প্রকৃত বাস্তব সত্তাকে নিজের কাছে অস্পষ্ট এবং অর্থহীন করে তোলে। ব্যক্তিজীবনের এই ট্র্যাজেডি অলীক মানুষের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।... নিজের খুশিমতো নিজের আনন্দে লিখে গেছি। সেদিক থেকে দেখলে এই উপন্যাসের লেখক হিসাবে আমাকে অন্যতম নায়ক শফিউজ্জামানের মতোই স্বেচ্ছাচারী বলা যায়।’
শেষ থেকে শুরু হয় এই উপন্যাস - ‘দায়রা জজ ফাঁসির হুকুম দিলে আসামি শফিউজ্জামানের একজন কালো আর একজন সাদা মানুষকে মনে পড়ে গিয়েছিল।’ কাঁটালিয়া-পোখরা-বিনুটি-গোবিন্দপুর-নবাবগঞ্জ-কুতুবপুর-খয়রাডাঙা-মোল্লাহাট - এই সব গ্রাম থেকে গ্রামে সংসার গেরস্থালি নিয়ে ঘুরেছেন বদিউজ্জামান। তার পেছনে কোনো দার্শনিক অনিকেত ভাবনা নেই, তা শিকড়হীন মানুষের জঙ্গমতা। অথচ বদু পীরকে দেখতে পেয়ে, মোল্লাহাটের ‘লোকগুলির মুখে চোখে ঐশী নিদর্শন অনুসন্ধানের প্রচন্ড আকুলতা, আর তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল আকাশে। তারা ছবিতে অাঁকা মানুষের মতো স্থির আর শব্দহীন। দিঘির উঁচু পাড়ে শাহী মসজিদের প্রান্তের একখন্ড পাথরের উপরে দাঁড়িয়ে আছেন বদিউজ্জামান। ঐখানে কোনো বৃক্ষলতা নেই। চৈত্রের নীল ধূসর আসমানের গায়ে অাঁকা সাদা আলখেল্লা আর সাদা পাগড়ি-পরা মূর্তিটিকে দেখে মনে হয় - ঐ মানুষ দুনিয়ার নন।’
উপন্যাস জুড়ে আছে দৃশ্যমান জগৎ ও অদৃশ্য জগতের দ্বন্দ্ব। মানুষ বদিউজ্জামান ও সাধক বদু পীরের দ্বন্দ্ব। বাস্তব-অলীকের সংঘাত, লৌকিক-অলৌকিকের মায়াবী আলো-অাঁধারি জগৎ, গতি এবং বিপ্রতীপ গতির দ্বন্দ্ব দেখা যায় এই উপন্যাসে। সুদীর্ঘ প্রায় একশ বছরের দেশসমাজের নানা পরিবর্তনের ইতিহাস দেখা যায় একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে। কখনো সলিটারি সেলে শফির আত্মকথন, কখনো বদিউজ্জামানের বয়ান। শফির ক্রমিক রূপান্তর। উপন্যাসের পর্বান্তরের মাঝে উনিশ-বিশ শতকের একটি পীর পরিবার, সামাজিক পট পরিবর্তন, মুসলমান সমাজ, ব্রাহ্মসমাজ ইত্যাদি সুন্দরভাবে চিত্রিত।
বদিউজ্জামানের ক্রমশ একা হয়ে যাওয়ার নিঃসঙ্গতা; মানুষ থেকে অলীক মানুষ হয়ে ওঠার যন্ত্রণা - ‘উঁচুতে উঠে গেলে যেন মানুষের সবটুকু চোখে পড়ে না নিচে থেকে। ওরা ভাবে আমার ঘর-গেরস্থালি নেই, স্ত্রী-পুত্র নেই, আমি এক অন্য মানুষ। অথচ আমার মধ্যে এই সব জিনিস আছে। টিকে থেকে গেছে সব কিছুই। আমার কষ্ট, আমার মনে খাহেশ। তসবিহ জপে ভুল হয়... আমার চারদিকে তারপর থেকে হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার... অথচ রাত নিশুতি হলে সেই হুঁশিয়ারির মধ্যেও চাপা হাসিকান্নার মানবিক আর্তি ভেসে আসে... সারা রাত ঘুম আসে না দু’চোখে।’
শফির মুখে শোনা যায় - ‘বইটির পাতা উল্টেই একটা বাক্য চোখে পড়ল। চমকে উঠলাম। স্ট্রেঞ্জ লিবার্টি। সত্যই তাই। আমিও প্রকৃতিতে যাই এবং ফিরে আসি অদ্ভুত স্বাধীনতা নিয়ে।’ শফির জীবনে যেন বোদলেয়রীয় দর্শন - বিষাদ থেকে বিতৃষ্ণায়, বিতৃষ্ণা থেকে নির্বেদে। নিজে নামহীন ত্রাসে পরিণত এক শিলাখন্ড মাত্র! সিরাজ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মার্কেজের ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুইড উপন্যাসের সঙ্গে অলীক মানুষ উপন্যাসের কোথায় যেন একটা মিল আছে।’