যখন নায়ক ছিলাম - ধীরাজ ভট্টাচার্য
সত্যিই একটা ভূমিকার বিশেষ দরকার, নইলে মস্ত বড় একটা ফাক থেকে যাবে পাঠক ও আমার মধ্যে। 'দেশ' পত্রিকায় যখন পুলিশ ছিলাম’ বার হবার সময় থেকেই বহু পাঠক-পাঠিকার অনুরোধপত্র আমি পাই। সবার বক্তব্য এক—পরবর্তী রচনা যেন আমার নায়ক জীবনকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়। তা না হয় হল। কিন্তু তারপর? এই তারপরের একটা সুষ্ঠ মীমাংসায় পৌছতেই প্রায় ছ' মাস কাটিয়ে দিলাম।
কথায় বলে, একে রামানন্দ তায় ধুনোর গন্ধ। আত্মজীবনী, তাও আবার সিনেমা নায়কের! বিশ বছর আগে হলে কল্পনা করাও মহাপাপ ছিল। আজ পৃথিবীর রংহাওয়া বদলে গেছে। ঢিলে হয়ে গেছে তথাকথিত সামাজিক ও নৈতিক বাধনের শক্ত গেরোগুলো। আজ দর্শক শুধু পর্দার ছায়ার মায়ায় ভুলতে রাজি নয়। আজ তারা পর্দার অন্তরালের মানুষগুলোর দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি ঘটনা, সুখ-দুঃখ বিরহমিলনের বার্তা জানবার জন্যে উদগ্রীব, আগ্রহশীল। সে আগ্রহ মেটাবার সাহস থাকলেও সামথ্য নেই। দেশটা ভারতবর্ষ না হয়ে পৃথিবীর আর যে কোনও সভ্য দেশ হলে এত ভাবনা-চিন্তার কারণ থাকত না। ও দেশের নায়ক-নায়িকারা তাদের ব্যক্তিগত জীবনের সব কিছুই খেলোয়াড়সুলভ মনোবৃত্তি দিয়ে বিচার করে বলেই বুক ফুলিয়ে জীবনটাকে খোলা চিঠির মতো দর্শক-সাধারণের চোখের সামনে মেলে ধরে। উৎফুল্ল দর্শক হাসাহসি করে, মাতামাতি করে, আবার দিনকতক বাদে সব ভুলেও যায়। কিন্তু এদেশের ভবি অত সহজে ভোলে না। ধরুন, বিশ বছর আগে রোমান্টিক আবহাওয়ায় কোনও এক দুর্বল মুহুর্তে একটি সুন্দরী নায়িকাকে প্রেম নিবেদন করেছিলাম, সাড়াও হয়তো কিছু পেয়েছিলাম। বর্তমানে সিনেমা-জগৎ ছেড়ে স্বামীপুত্র নিয়ে তিনি হয়তো সুখের নীড়ে নিশ্চিন্ত আরামে দিন কাটাচ্ছেন। আজ খুঁচিয়ে ঘা করার মতো একযুগ আগের বিস্মৃতপ্রায় সেই ঘটনা যদি আমার নায়ক জীবনে উল্লেখ করে বসি, পরিণামটা একবার চিন্তা করে দেখুন। তাছাড়াও আর একটা মস্ত বিপদ, নায়ক জীবন লিখতে বসে কোনও গোজামিল দিয়ে চলে যাবার উপায় নেই। কেননা অধিকাংশ পাত্র-পাত্রী এখনও জীবিত রয়েছেন। এইবার আমার অবস্থাটা একবার ভাল করে ভেবে দেখুন। রোমান্টিক নায়ক জীবন লিখতে হবে রোমান্সকে বাদ দিয়ে। ঠিক নুন বাদ দিয়ে মুখরোচক খাবার রান্নার মতো নয় কি? অনেক ভেবেও কোনও কুলকিনারা না পেয়ে কাপুরুষের মতো পিছু হটতে লাগলাম । হঠাৎ চেয়ে দেখি পৌছে গেছি পচিশ-ত্রিশ বছর আগে সিনেমার আদি যুগে। বর্তমান যুগের অধিকাংশ দর্শক বা পাঠকের ধারণাই নেই কত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে, কত হাস্যকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে নির্বাক যুগের ঐ বোবা শিশু একটু একটু করে এগিয়ে এসে আজ মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছে বর্তমানের মুখর যুগের মাঝখানে। দেখি সেদিনের অবহেলায় ফেলে আসা ছোটখাটো তুচ্ছ ঘটনাগুলো আজ হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আজ এক নতুন চোখে তাদের দেখতে পেলাম। যত্ন করে তাই একটি একটি করে বুকে তুলে নিয়ে কথার মালা গেথে আঁকাবঁকা পথে সামনে এগিয়ে চললাম। এরাই হল আমার নায়ক জীবনের মূলধন। এই হল যখন নায়ক ছিলাম’এর সত্যিকারের ইতিহাস। সত্যকে যথাযথ বজায় রাখবার চেষ্টা করেছি। কয়েকটি জায়গায় প্রয়োজনবোধে পাত্র-পাত্রীর নামধাম গোপন রাখতে বাধ্য হয়েছি, এইমাত্র।
আর একটি কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন। অনেক পাঠকপাঠিকার ধারণা, আমি ইচ্ছা করেই হঠাৎ কাহিনীর ছেদ টেনে দিয়েছি। ভুল ধারণা। চেষ্টা করেছি এবং দেখাবার চেষ্টা করেছি। প্রশংসার জয়মাল্যের পরিবর্তে পেয়েছি সমালোচনার নিষ্ঠুর কশাঘাত। তাই একঘেয়েমি কিছুটা এড়াবার জন্য, চরম লাঞ্ছনার মধ্যেই কাহিনীর যবনিকা টেনে দিয়েছি। অনেকে এই অভিযোগও করেছেন, এখনও তো আপনি নায়কের ভূমিকায় মধ্যে মধ্যে অভিনয় করেন, সুতরাং যখন নায়ক ছিলাম অত আগে শেষ করলেন কেন? উত্তরে তাদের একটু ধীরভাবে ভেবে দেখতে অনুরোধ করি টাইপ চরিত্রে আসার পর যে সব নায়ক চরিত্রে আমি রূপদান করেছি, সেগুলি কি রোমান্টিক নায়ক ? ধরুন নিয়তি', 'কঙ্কাল", মরণের পরে’, ‘ময়লা কাগজ’, ‘সেতু প্রভৃতি। যখন নায়ক ছিলাম’-এ এগুলোর উল্লেখ করলে আর যে অসংখ্য টাইপ চরিত্রে অভিনয় করে আমি পেয়েছি দর্শকের অকুণ্ঠ প্রশংসা, সেগুলি বাদ দেওয়া চলে কি? তাই রোমান্টিক নায়কের চিতার আগুন নেববার আগেই কাহিনীর শেষ করেছি। এর জন্য যা কিছু অপরাধ সব আমার, পাঠক-পাঠিকার কাছে এর জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
Download and Comments/Join our Facebook Group