জিন্না
ভারত দেশভাগ স্বাধীনতা
যশোবন্ত সিংহ
প্রস্তাবনা: একটি জটিল সূচনা
ভারতের সঙ্গে ইসলামের প্রথম পরিচয় কিন্তু দ্বন্দ্বের রূপ নেয়নি। তেমন কোনও দ্বন্দ্বের বোধই তখন ছিল না। ইসলাম ধর্মের সূচনার বহু আগে থেকে পারস্য, মেসোপটেমিয়া, আরবের নানা দেশের সঙ্গে যে নৌবাণিজ্য চলছিল, বণিকরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পরেও সে সম্পর্কের কোনও পরিবর্তন হয়নি। সপ্তম শতাব্দীর পর থেকে কিন্তু দেখা গেল, এই যোগাযোগের চরিত্র বদলে গিয়েছে। এর পর থেকেই পশ্চিম থেকে স্থলপথে হামলা, লুটপাট শুরু হয় ভারতে। কয়েক শতক ধরে বারবার আক্রমণ চলতে থাকে, প্রধানত ভারতের অতুলনীয় সম্পদ লুট করার জন্য। অনেক আক্রমণকারী সেই সময়ে ইসলাম ধর্মের ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সব রকম অ-ইসলামীয় স্থাপত্য বা মূর্তি বা প্রতীক ধ্বংস করতে শুরু করে। এরাই ইসলামের কালাপাহাড়, যারা সব রকম ‘শয়তানের প্রতীক’ নষ্ট করতে উদ্যত হয়। আক্রমণ, বংশানুক্রমে এ দেশে রাজত্বচালনা এবং আক্রমণকারীদের এ দেশের সঙ্গে মিশে যাওয়া, এ সব আরও পরের ঘটনা। এ তিন ঘটনাকে কখনওই জ্যামিতিক সূক্ষ্মতায় আলাদা করা যায় না, একটা কখনওই অন্যটাকে অনুসরণ করেনি, বরং একটার গতি অন্যটায় মিলিয়ে গিয়েছে। আক্রমণগুলির সঙ্গে সঙ্গে ভারতের এক নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে— অবিশ্বাসীদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ। তার পর এমন একটা সময় এসেছে যখন ইসলাম ভারতের দ্বারা পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে, তার সঙ্গে মিশে গিয়েছে, একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে ভারতের মধ্যে মিলিয়ে গিয়েছে। এই সামান্য কয়েকটি বাক্যে যে কথাগুলো আমরা বললাম, বাস্তবে তা ঘটতে লেগেছিল প্রায় দেড় হাজার বছর।
ইসলামের সঙ্গে ভারতের এই বিভিন্ন ধরনের মানব-অভিজ্ঞতার গোটা পরিধিটা স্থান পেয়েছিল এই উপমহাদেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে। বিজেতার ধর্মবিশ্বাস হিসেবে যা শুরু হয়, এই দেশকে ক্রমশ তা স্বভূমি বলে গ্রহণ করে। এবং শেষ অবধি সেই দেশকেই টুকরো করে তারা সে দেশ ছেড়ে চলে যায়। ইসলাম ভারতে এসেছিল প্রধানত মুসলিম আক্রমণকারীদের সঙ্গে, সিংহাসন জেতার লোভে, এই সম্পদশালী, উর্বর, সমৃদ্ধ দেশকে শাসন করবার আশায়। ফলে ইসলাম প্রধানত বিদেশি বিজেতার ধর্ম বলেই পরিচিত হয়েছিল।
এখানে আমাদের অনুসন্ধানের বিষয় হল ‘জিন্নার গমনপথ’— অর্থাৎ কী ভাবে ইসলাম এই বিদেশি পরিচয় হারাল, প্রথমে "ভারতীয় হল, তারপর এই ভৌগোলিক ভূখণ্ডে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করল। বহু দিন ধরে যা ছিল রাজা, সম্রাট এবং ভারতের শাসকদের ধর্ম, পরে সেটাই পরিণত হল বিচ্ছিন্নতাবাদীর ধর্মে, যে ধর্ম দেশকে বিভক্ত করে, ভারত থেকে নিজেদের (ধারণায়) সরিয়ে তার পূর্ব এবং পশ্চিম প্রান্তে সরে যায়, এবং যারা ভারতে থেকে গেল তাদের চিরকালের জন্য আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে সংশয় এবং দ্বিধায় পর্যবসিত করে। যারা থেকে গেল তাদের অসম্মান করে প্রশ্ন করা হল, ‘তোমরা আসলে কোথাকার? এই বিভ্রান্ত, স্বজনবিচু্যত মানুষেরা এখন দুঃখ করে বলেন, “আমরাও কি উম্মা-র নই? তা হলে মুসলিম লিগ যে গর্ব করে বলত, সে হল ‘ধর্মবিশ্বাসীদের এক এবং একমাত্র প্রতিনিধি ? লিগ দাবি করেছিল, সে ইসলামের আদর্শগত বিশ্বাসের ধারক, মুসলিম জনমতের একটা বড় অংশের প্রতিনিধি। তাই লিগ চেয়েছিল, কিংবা বলা ভাল, ধরেই নিয়েছিল, তারা হয়ে উঠবে একটিমাত্র মুসলিম মাধ্যম একটি বিশিষ্ট জাতির ধারণা তৈরি করে তা থেকে নিজের জন্য একটি আলাদা ভূখণ্ড দাবি করেছিল। সেই জন্যই এই প্রশ্ন আমাদের বারবার পীড়া দেয়: কীসের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছিল তারা ? যারা ভৌগোলিক ভাবে আলাদা হতে পারেনি, তাদের জন্য কা রইল ? ভৌগোলিক, কিংবা ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিতে অভিন্ন যে দেশ, তাকে কী করে ভাগাভাগি করা যায়? কেবল মানচিত্রে লাইন একে? মাউন্টব্যাটেন-এর ভাষায়, ‘অস্ত্রোপচার করে’ ? দুঃখের বিষয়, নেহরু, পটেল আর কংগ্রেস দল কিন্তু এই ভাগাভাগি শেষ পর্যন্ত মেনেই নিয়েছিল। জিন্না তো তারও আগে থেকে এটাই দাবি করে আসছিলেন।
এই অর্থে মুসলিম লিগ জিন্নার নেতৃত্বে সাফল্য পেয়েছিল, কারণ তিনি যা করতে চেয়েছিলেন, ঠিক তাই করতে পেরেছিলেন। লিগ ছিল তাঁর রাজনৈতিক অস্ত্র, আর তাঁর সূক্ষ্মদৃষ্টি তাঁকে কংগ্রেসের দুর্বলতা-গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিল, বিশেষত ১৯৩০ সালের পর। তার সঙ্গে তিনি যোগ করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দুর্বলতা। এই সবের সাহায্যে তিনি কেটে বার করে নিয়েছিলেন পাকিস্তানকে, যদিও জন্ম থেকেই তার চেহারা ছিল ‘পোকায়-খাওয়া’।
ইতিহাসের টীকাকাররা অনেকেই এ বিষয়ে চিন্তা করেছেন, যেমন ‘দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া: পলিসিজ অ্যান্ড পার্সপেক্টিভ ১৯৩৫-১৯৪৭’ বইয়ের লেখক সি এইচ ফিলিপস এবং মেরি ডরিন ওয়েনরাইট লিগের জয়ের এই রাস্তাটি যথেষ্ট আলোচিত, যদিও তা এখন কিছু আবছা হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। আমরা এই রাস্তাতেই আরও একবার হাটব। আলোচনা করব মহম্মদ আলি জিন্নার রাজনৈতিক যাত্রাপথ। প্রশ্ন করব, কী করে? কেন ? বিংশ শতকের প্রথম ৪৭ বছর যিনি ছিলেন ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রথম সারির একজন নেতা— কেন তিনি নিজেকে ভারতের এক প্রান্তদেশে সরিয়ে নিলেন? সুতরাং এই যাত্রা ভারতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যেরও যাত্রা। গোখলে, এবং পরে সরোজিনী নাইডু যাঁকে ভারতের হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীক বা দূত বলেছিলেন, তিনি কী করে পাকিস্তানের প্রথম এবং, আয়েশা জালালের কথায়, ‘একমাত্র মুখপাত্র’ হয়ে উঠলেন ? তিনি কি সত্যিই তাই ছিলেন? না কি এক সামগ্রিক ভুলের ফলেই তৈরি হয়েছিল তাঁর পাকিস্তান ? লয়েড এবং সুসান রুডলফ একটি বক্তৃতায় এই প্রশ্নটি সোজাসুজি তুলে ধরেছেন, “জিন্নাকে উদার, বহুসংস্কৃতিমান এবং ধর্মনিরপেক্ষ বলেই দেখা হত, যিনি ভারতের ঐক্যের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন, ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো যাঁকে বলেছিলেন, কংগ্রেসের চেয়েও বেশি কংগ্রেস।” তা হলে ঠিক কী ঘটেছিল ? কী করে দেশভাগের মতো বিধ্বংসী একটা ঘটনা ঘটতে পারল, যা চল্লিশের দশকের গোড়াতেও কল্পনা করা যেত না, ১৯৪৬ সালের আগে যে বিষয়ে কোনও বুদ্ধিগ্রাহ্য ধারণাও জন্মায়নি? কেন এবং কখন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত, উদারপন্থী সংবিধানবাদী, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী মহম্মদ আলি জিন্না শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠলেন, ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের ভাষায়, এক ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন সৃষ্ট দানব’, যে সেই জগৎকেই টুকরো-টুকরো করে, যার মহানুভবতা তাকে নির্মাণ করেছে?
আমার মনে হয়, দেশভাগের আরও কিছু ট্র্যাজেডি আমাদের মনোযোগ দাবি করে। এই যে জীবন্ত একটি ভূখণ্ডকে দু-ভাগ করা, তা কি ভারতের স্বরূপকেই প্রশ্ন করে না? জিন্নার দাবি অনুসারে মুসলিমরা যদি একটি পৃথক জাতি হয়, তা হলে ভারত আসলে কী? দেশভাগের পর যা রইল, তা কি একটি জাতি নয়? আমরা কি অনেকগুলি গোষ্ঠীর একটি সমষ্টি? নাকি জিন্নার কথামতো, অনেকগুলি জাতির সহাবস্থান মাত্র? নিশ্চয়ই ভারত এ সব কিছু নয়, ভারত একটি জাতি। আমরা বলছি বলে নয়, ইতিহাসও তাই বলে। জাতি হিসেবে আমরা সমান অধিকার দিতে চাই সব নাগরিককে, এবং সকলকে এক নাগরিকত্ব দিতে চাই। তা হলে কী করে এবং কেন আমরা ধর্ম, জাত, গোষ্ঠী প্রভৃতি বিভিন্ন পরিচয় তৈরি করি, ভারতের সেই ঐক্য যা নিয়ে আমরা এত গর্ব করি, তাকেই আবার খণ্ডিত করার চেষ্টা করি? যারা দুর্গত, তাদের সাহায্যের জন্য আর ঐতিহাসিক, সামাজিক অসাম্য দূর করার জন্য আমরা সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করি, কিন্তু সেটা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ভ্রান্তদৃষ্টি থেকে সমাজগঠন। শেষ বিচারে এটাই তো ছিল ‘মুসলিমদের একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে জিন্নার কেন্দ্রীয় এবং ক্রমাগত দাবি, কারণ তিনিও চেয়েছিলেন মুসলিমদের একটি বিশেষ অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে, সরকারি চাকরিতে। গাঁধীজি আপত্তি করেছিলেন। অন্যরা প্রথমটা গোড়ায় অরাজি হলেও, পরে আশ্চর্য ভাবে সংরক্ষণের পিছল সিড়ি বেয়ে ওঠার জন্য তাড়াহুড়ো শুরু করলেন। কিন্তু এই চিন্তা জিন্নার যাত্রাপথে আমাদের যাত্রাকে ছাড়িয়ে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে।
আবার ফিরে তাকানো যাক। ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে, সেই সময়ের বড় বড় সংবিধানবাদীদের মধ্যে জিন্না আর নেহরুই মুসলিমদের বিশেষ অবস্থান’-এর সমর্থক হয়ে উঠলেন। জিন্না প্রত্যক্ষ ভাবে, নেহরু পরোক্ষে। সব ভারতীয়রাই সংবিধানের চোখে সমান, জিন্না তাই মুসলিমদের জন্য বিশেষ অবস্থান দাবি করলেন, এবং জিন্না যে মুসলিমদের একমাত্র মুখপাত্র, নেহরু সেই দাবিকে চ্যালেঞ্জ করলেন, এ ভাবে দু’জনেই ভারতীয়দের মধ্যে মুসলিমদের বিশেষ অবস্থানের সমর্থক হয়ে উঠলেন। দুঃখের কথা, এই দুই নেতাই মুসলিমদের মুখপাত্র হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। এটা ঘটল এই কারণেই যে, এরা দু’জনেই ইউরোপীয় চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক বিন্যাসে এমন গভীর ভাবে প্রভাবিত ছিলেন যে তাঁরা ভারতীয় সংস্কৃতিচেতনা থেকে অনেক দুরে সরে গিয়েছিলেন। তা হলে কে ভারতীয় ঐক্য নিয়ে কথা বলার জন্য থেকে গেলেন? দুঃখের কথা, কেবল গাঁধী।
নিষ্ঠুর সত্য এই যে, দেশভাগে যা হওয়ার কথা ছিল, হল ঠিক তার উলটো। দুই জাতির মধ্যে বিদ্বেষ দূর করার চাইতে বরং হিন্দু, মুসলিম, শিখ প্রভৃতি পরিচয় আরও উসকে দিল। দুর্ভাগ্যের কথা, মুসলিম, তফসিলি জাতি বা জনজাতির জন্য সংরক্ষণ এই সব পরিচয়ের দূরত্ব কমিয়ে দেয় না, বরং তার উপর দাগ বোলায়, তার শিকড়ে জল সেচন করে। স্বার্থসিদ্ধির সার দিয়ে পরস্পর-বিচ্ছিন্নতাকে জাগিয়ে রাখা হয়। সংরক্ষণ সমাজের মধ্যে দেওয়াল তোলে, ফলে শেষ অবধি জাতির একাত্মতাবোধ টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ভারতে মুসলিমদের জন্য বিশেষ অবস্থান’-এর দাবি শেষ পর্যন্ত সেই কাজটাই করল।
কিন্তু এ তো হল যা ঘটে গিয়েছে, তার একটা কাজ-চালানোর মতো স্কেচ। যে ঐতিহাসিক সময়ের কথা আমরা বলছি, তার কী হবে ? কোন সময় সেটা? সহজ উত্তর, সময়টা হল ১৮৫৭ এবং ১৯৪৭ সালের মধ্যে। ১৮৫৭ চিহ্নিত হয়ে রয়েছে যে ঘটনায়, তা হল ভিন দেশের বণিকদের দ্বারা ভারতের সার্বভৌমত্বের চিহ্নগুলি ছিনিয়ে নেওয়া। যদিও অষ্টাদশ শতকের গোড়া থেকেই ভারতে মুঘল সম্রাটদের কর্তৃত্ব কমতে শুরু করেছিল, তবু তার তুলনাতেও, ১৮৫৭ ছিল এক হিংস্র দখলদারি। এরই পশ্চাৎপটে আমাদের বিংশ শতকের প্রথম চার দশক পাড়ি দিতে হবে, ১৯০৬ সালের সিমলা চুক্তি থেকে ১৯৪৬ সালের ভারতের স্বাধীনতা আইন পর্যন্ত সময়কালটাকে বুঝতে হবে। এই চার দশকে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিবাসীদের জীবন উল্লেখযোগ্য ভাবে বদলে যায়, এবং তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের ঘটনা এবং সমস্যার উপরও প্রভাব ফেলে। বিশেষ সংরক্ষণ'-এর দাবি তুলে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের গণনার মধ্যে যে একটা পক্ষপাতিত্বের কথা থেকে সেই যাত্রার শুরু, শেষ অবধি দেশের ব্যবচ্ছেদে তার শেষ। এই দুঃখজনক যাত্রার এটাই হল বৌদ্ধিক, ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক সীমা। কিছুটা শঙ্কিত ভাবে এই সংকটময় পথে আমি পা বাড়াচ্ছি, বুঝতে চাইছি কী হয়েছিল। কী করে ১৯৪৭ সালের মহাসংকট উপস্থিত হল? এমন বৃহৎ পরিবর্তন আনল যে ঘটনা, তার সম্পর্কে নিশ্চয়ই সকলে একমত হতে পারেন না, অনেকেই বিরুদ্ধ মত পোষণ করবেন, তবুও..
“ভারতে যে মতটা খুব প্রচলিত, তা হল— দেশভাগ এক শোচনীয় ব্যাপার, এক জীবন্ত ব্যবচ্ছেদ’, তাই ভারতে এ বিষয়ে আলোচনার ঝোঁকটা পড়ে “উপমহাদেশের ঐক্য বজায় রাখতে ব্যর্থতার জন্য দোষারোপের উপর’, এবং দেশভাগের ভয়ানক ফল নিয়ে আক্ষেপ। এক প্রশংসনীয় নিরপেক্ষতার সঙ্গে সাধারণত কংগ্রেস নেতাদেরই এ বিষয়ে প্রধানত দায়ী করা হয়, তাকে তারিফ করা হয়: তারা যদি এই করতেন, বা ওটা করা থেকে বিরত থাকতেন, তা হলে দেশভাগ হত না। অন্য দিকে, পাকিস্তানে কিন্তু, স্বাভাবিক ভাবেই, দেশভাগ যে না-ও হতে পারত, সে কথাটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয় না, এবং ইতিহাসের গভীরে ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদের উৎসের সন্ধান করে চলা হয়, তার সঙ্গে একটি মুসলিম দেশ বা জাতির প্রতিষ্ঠার যোগসূত্র স্থাপন করে পৃথক রাষ্ট্রের জন্মকে অবশ্যম্ভাবী বলে দেখানো হয়।
এই অনুসন্ধান, এবং এই বইয়ের এটাই হল উৎস এবং সারাংশ। বইটির নির্মাণ অবশ্য আরও সরল। কেননা আমাদের সেই যুগান্তকারী দশকগুলির ওঠা-পড়ার নানা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেই যাত্রা করতে হবে।
এখানে একটি অসুবিধার কথা জানিয়ে রাখা ভাল। এই রচনা কি কেবল দেশভাগের একটি পুনর্বিবরণ? যা যা ঘটেছিল, তার সময়ানুক্রমিক কাহিনি? আমার এক বন্ধু স্কটল্যান্ড থেকে সম্প্রতি আমায় লিখেছেন যে ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস গ্রহণ করেছিলেন এই দৃষ্টিভঙ্গি যে, ইতিহাস হল নিয়মানুসারে পরীক্ষিত নানা তথ্যের সমাহার। আবার, বিখ্যাত আরব ঐতিহাসিক ইবন খালদুন দ্য মুকাদিমা’-তে ইতিহাস কী, বা কী হওয়া উচিত, সে বিষয়ে যা বলেছেন—
(ইতিহাস রচনা) বহু উৎস এবং অনেক বিষয়ে জ্ঞান দাবি করে। তার জন্য কল্পনাপ্রবণ মন এবং সর্বাত্মক চিন্তা চাই, যাতে ঐতিহাসিক সত্যের কাছে পৌঁছতে পারে, এবং তার ভুলচুক না হয়। যদি যে ভাবে ইতিহাস বাহিত হয়ে এসেছে তাকেই সে বিশ্বাস করে, পরম্পরা থেকে যে সব নীতি তৈরি হয়েছে তার পরিষ্কার ধারণা যদি তার না থাকে, রাজনীতির মৌলিক তথ্য, সভ্যতার প্রকৃতি, মানবসমাজ গঠনের শর্ত যদি সে না জানে, অধিকন্তু, প্রাচীন বিষয়বস্তুর সঙ্গে সমকালীন বিষয়ের তুলনামূলক মূল্যায়ন যদি সে না করে, তবে সে হোঁচট খাবে, পিছলে যাবে, সত্যের পথ থেকে বিচু্যত হবে। ঐতিহাসিকরা, কোরানের টীকাকাররা, জ্ঞানী মানুষেরা প্রায়ই তাঁদের কাহিনি এবং ঘটনার বিবরণে ভুল করেছেন। তাঁরা যা শুনেছেন তাকেই গ্রহণ করেছেন, তার মূল্যায়ন করেননি। তারা ঐতিহাসিক ঘটনার অন্তর্নিহিত নীতিগুলোর সঙ্গে ঘটনাগুলি মিলিয়ে নেননি, একই ধরনের বিষয়ের সঙ্গে তাঁরা তুলনা করেননি। তাঁরা দর্শনের নিরিখেও অনুসন্ধান করেননি, বস্তুর প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞানের সাহায্য নিয়ে, কিংবা ইতিহাসের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে চাননি। সেই জন্য তাঁরা সত্যের পথ থেকে সরে গিয়ে ভিত্তিহীন এবং ভ্রান্ত ধারণার মরুভূমিতে পথ হারিয়েছেন।"
অর্থাৎ আমাকে থাকতে হবে এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু স্পষ্ট নির্দেশাবলির সীমার মধ্যে। জিন্নার কায়েদ-এ-আজম রূপে বিবর্তনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই শর্তগুলিই আমি পূরণ করার চেষ্টা করব।
স্বীকার করে নিচ্ছি, কোনও বিবরণই নৈর্ব্যক্তিক নয়, তা হওয়া সম্ভবও নয়। যাই হোক না কেন, আমার বিবরণ বা ব্যাখ্যা তো সেই দহনকালের ব্যাখ্যা, যখন ভারত নামের এই প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐক্যভূমিকে জোর করে ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছিল। ঘটনার বিবরণ যে কোনও বৌদ্ধিক সিদ্ধান্ত, তত্ত্বের অনুসারী, কিংবা ব্যক্তিনিরপেক্ষ, সে দাবি আমি করতে পারি না। বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তো নয়ই। কেন এত প্রাচীন দেশটিকে ভাঙা হল ? এই প্রশ্ন আজও আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়, এবং প্রতিটি ব্যক্তি তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেই বিচিত্র ঘটনাপ্রণালীর অর্থ করে।
পাশ্চাত্যের কোনও দার্শনিক সিদ্ধান্ত থেকে কি এই বৃহৎ, পীড়াদায়ক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে? আমার তা বিশ্বাস হয় না। তা হলে কি কেবল ঘটনার পুনর্বিবরণে তা পাওয়া যাবে? আবারও, স্পষ্টতই এর উত্তর, না। আমরা যতদিন না নিজেরা প্রায় সেই যুগে ফিরে যেতে পারি, সেই সব কলহে শ্বাস নিতে পারি, সেই সব বিতর্কে যোগ দিতে পারি, যতটা নিকটে যাওয়া সম্ভব যেতে পারি, তা হলে কেবল ঘটে-যাওয়া ঘটনাক্রম, বা তার উপরে যা কিছু মন্তব্য করা হয়েছে সে সব বলে কোনও লাভ নেই। সে সময়ের প্রবল আবেগ বুঝতে গেলে অন্তত এটুকু আমাদের করতেই হবে। আর সেই আবেগে স্পন্দিত না হলে ইতিহাসের সেই প্রকম্পনের বিষয়ে কোনও কথা বলা চলে না। আমাদের নিজেদের স্বার্থরঞ্জিত কাচের মধ্যে দিয়ে দেখলে সেই বিশাল ট্র্যাজেডির কেবল একটি বিষগ্ন কৌতুকনাট্যই আমরা রচনা করতে পারব।
তথ্যসূত্র
১. লয়েড রুডল্ফ অ্যান্ড সুজান হেবার রুডল্ফ, পোস্টমডার্ন গাধী অ্যান্ড আদার এসেজ গাঁধী ইন দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড অ্যাট হোম, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস, সহ-প্রকাশক: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ইন্ডিয়া, ২০০৬, পৃ-২৭২
২. মুশিরুল হাসান (সম্পাদিত), ইন্ডিয়া’জ পার্টিশন প্রোসেস, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড মোবিলাইজেশন, ও ইউ পি, দিল্লি ১৯৯৩, ভূমিকা (পৃ ১০ ও ৩৬)
৩. রুডলফ অ্যান্ড রুডল্ফ, পোস্টমডান গাধ, পৃ-৬৪ ৪. আরবি শব্দ, যার অর্থ মুখবন্ধ (প্রিফেস) বা ভূমিকা (ইস্ট্রোডাকশন), ইবন খালদুন-কৃত বিশ্ব ইতিহাস কিতাব আল-ইবর (বুক অফ অ্যাডভাইস), ১৩৭৭, যে গ্রন্থে ইউনিভার্সাল হিস্ট্রি বিষয়ে মুসলিমদের প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়।
৫. ইবন খালদুন-এর লেখা দি মুকাদিমহ, অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু হিষ্ট্রি গ্রন্থের ভূমিকা থেকে সংগৃহীত। মূল আরবি ভাষা থেকে বইটি অনুবাদ করেন ফ্রান্জ রোজেনথাল এবং সংক্ষিপ্তকরণ ও সম্পাদনা করেন এন জে দায়ুদ, বলিনজেন সিরিজ, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস।