Ticker

6/recent/ticker-posts

বাংলা সাহিত্যে নারী সমকামিতা - শঙ্করী মুখোপাধ্যায়

বাংলা সাহিত্যে নারী সমকামিতা - শঙ্করী মুখোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে নারী সমকামিতা
শঙ্করী মুখোপাধ্যায়
ভূমিকা
খ্রিস্টধর্মের মৌল তত্ত্বকথায় আছে "আদিপাপবর্জিত জন্ম", বা ভারতীয় পুরাণ ও উপকথাতে আছে 'অযোনিসম্ভব আবির্ভাব’ (Virgin Birth)? যেমন—‘সীতার জন্ম লাঙলের ফলায়, উর্বশীর জন্ম জহুমুনির জঙঘা থেকে, দ্ৰৌপদীর জন্ম হোমাগ্নি থেকে, বৌদ্ধশাস্ত্রে মাতা আম্রপালী পূর্ণযৌবনা স্বয়ম্বরূপে আম্রকাননে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু এগুলো উপকথা মাত্র। হিন্দু বা বৌদ্ধধর্মের মর্মমূলের তত্ত্বকথা নয়।
অপর পক্ষে খ্রিস্টান ধর্ম নরনারীর জৈব সম্পর্কের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে। খ্রিস্টধর্মে যাজকদের বার-বার আদম-ঈভের আদিপাপ থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ধর্মযাজক সেন্ট অগাস্টিন তার শিষ্যদের সাবধান করে বলেছেন : “What does it matter whether it be in Person of mother or sister: We have to be beware of Eve in every woman” (নারীর মূল্যজ্জ শরৎচন্দ্র ) কিন্তু তথাপি একথা মানতে আমরা বাধ্য যে, প্রকৃতি-পুরুষের আবশ্যিক মিলনের মাধ্যমেই সূর্যের এই তৃতীয় গ্রহে জীবের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। এই ধ্রুব সত্যকে শুধু ভারতীয় ঋষিরাই নয়, প্রতিটি প্রাচীন সভ্যতা মেনে নিয়েছে খ্রিষ্টের জন্মের কয়েক সহস্রাদি পূর্বকাল থেকেই। হিন্দুশাস্ত্র বলে; একই সত্তা সৃষ্টির জন্য নারী-পুরুষ রূপে দ্বিরূপপ্রাপ্ত হয় নিরাকার। আত্মসংযম বা ইন্দ্রিয়সংযমের বিধান ধর্মে থাকলেও, কোথাও কোনো ধর্মেই গৃহীদের ক্ষেত্রে ‘বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি’-র কথা বলা নেই। প্রজনন-প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তা কোনো সভ্যতাই সার্বিকভাবে অস্বীকার করেনি।
যে দিন থেকে মানবসভ্যতা প্রজননকে গুরুত্ব দিতে শুরু করল, নারীর যৌনতাকে শৃঙ্খলিত করা হল প্রজননের ক্ষেত্রে সীমিত রেখে। বিবাহ-প্রথার মাধ্যমে নারীকে নির্দিষ্ট স্বামীর (পুরুষের) সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হল। নারী নিজের সহজাত স্বাভাবিক যৌন্সম্ভোগের স্বাধীনতা হারাল। সেই প্রাচীন প্রস্তরযুগে সমাপ্তির পর থেকে আজ অবধি চলে আসছে নারীর স্বাভাবিক যৌন কামনাকে বেঁধে রাখার ইতিহাস। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন পরিবর্তন এসেছে এই বাধনকে পোক্ত করতে। স্বতীত্ব, উপাচার, সন্তান, ধর্ম, পরিবার, ন্যায়-নীতি, সবই দিয়েছে তাকে তার নিজের কথা ভুলিয়ে রাখার জন্য। তাকে এসব দিয়ে বোঝানো হয়েছে সন্তান, ধর্ম, স্বামী, পরিবার-পরিজন এদের প্রতিপালনেই তার আসল সুখ- এরা সুখে থাকলেই নারীর প্রকৃত সুখ।
অথচ বৈষ্ণব ধর্ম বলে; “পুরুষসঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন রাধা। রাধা ও গোপীদের শর্তেই পরিচালিত হত দেহ-মিলন। নারীর সেবা ও সুখবিধান ছিল এ মিলনের উদ্দেশ্য। নারীদেহের সুখবোধ সুখ-অনুভবের কেন্দ্র ও অঙ্গ ভিন্ন। নারীরা পুরুষকে শেখাত এই তত্ত্ব। দেহমিলনে বৈদিক স্বামীর অধিকার বা কর্তৃত্ব ছিল না। পুরুষের সন্তান উৎপাদনের বা জাত সন্তানের অধিকারও ছিল না পুরুষের। চৈতন্যলীলায় ব্যাস, বৃন্দাবন দাস ছিলেন শ্রীনিবাস পরিবারের বিধবা নারায়ণীর সন্তান, পিতা অজ্ঞাত।...পুরুষতন্ত্র নারীকে কামিনী ও কামের প্রতিমূর্তি বলে প্রচার করেছিল।" (অন্য এক রাধা, শক্তিনাথ ঝা) পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পুরুষকে দিল অগাধ স্বাধীনতা। সেখানে রাধা হল প্রেমিকা অন্যদিকে তারা কৃষ্ণকে কাম স্বরূপ বললেন। কৃষ্ণলীলায় কাম ও বহুগামিতা পুরুষ-কৃষ্ণের বৈশিষ্ট্য ধার্য হল। ভারতীয় দেবতাচরিত্রে এবং সমাজে পুরুষদের এসব বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা হল। পুরুষ পেল বহু-বিবাহের স্বাধীনতা, যেখানে নারী পেল সহমরণ, সতীত্ব। সেই থেকে এতাবৎ কাল, হিন্দুধর্ম, কোরানহাদিস, বাইবেল কেউই দেয়নি নারীকে সমলিঙ্গের অধিকার। কোনো ধর্মেই দাসীবৃত্তি ছাড়া নারীর আর কোনো কাজই সমাজে ও ধর্মে নির্দেশিত হয়নি। কবি তুলসিদাস বলেছেন :
“ঢোল গাওয়ার শূদ্ৰ-পশু-নারী,
ইয়ে সব হ্যায় তাড়নাকে অধিকারী।"
এই হল নারীর যুগযুগান্তের দুর্ভাগ্যের কাহিনী।
“কোথায় জুড়াই?
হায় স্থান কোথা পাই?
নিশ্চিত্ত নিঃশঙ্ক হব—যে আবাসে গিয়া,
কোথা সে ভবন?"
—শ্ৰীযুক্ত সরলাবালা সরকার
এ নিশ্চিন্ত নিঃশঙ্ক ভবন যে বহু ক্ষেত্রেই আরেক সমব্যার্থী নারীর মনে হতে পারে, এতে আর সন্দেহ কোথায়। ষোড়শ শতাব্দীর কবি কর্ণপুর যাকে বলেছেন ‘মৈত্রী’। এই মৈত্রীকে কর্ণপুর বলেছেন অসমপ্রয়োগ বিষয়া রতি এবং ‘স্পর্শ দিকোচিতা। এই বিশ্লেষণে টিকাকার বিশ্বনাথ বলেছেন ‘স্ত্রীনাং’ পরস্পর যথেষ্ট স্পর্শাদি ব্যবহারে দোষ নাস্তি। তাই নারীতে-নারীতে হয়; যে গোপন কথা, সখ্যতা, প্রেম, ভালোবাসা। তাকে বিজ্ঞান নাম দিল ‘নারী সমকামিতা' ।
এই দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকার কারণ আমার পরিবেশনার বিষয় এখানে ‘নারী সমকামিতা বা ‘লেসবিয়নিজম' । এ বিষয়ে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকতেই পারে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, অস্বাভাবিক ও অপ্রাকৃত বলে তাদের তির্যক চোখে দেখা বা একঘরে করে রাখা হবে।
সমকামিতার ইতিহাস বহু প্রাচীন। মানুষের সমকামী হওয়ার বহুবিধ কারণ রয়েছে। যদিও কিছু কিছু মানুষ সমকামিতার অঙ্কুর নিয়েই জন্মগ্রহন করে। সমকামিতা নিয়ে মানুষের ভুল ধারণা যে সমকামিতার ক্ষেত্র বুঝি তবু শারীরিক, আসলে সমকামিতা ভীষণভাবে মনস্তাত্বিক, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সমস্যাটাই তাদের বহুদিনের আত্মদমনের সংস্কৃতির পাঠ থেকেই অঙ্কুরিত হয়ে মন ও শরীর দুয়ের মধ্যে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে গেছে। ফলে সঠিক কারণগুলোর সনাক্তকরণ সবসময় সম্ভব হয় না। আধুনিক বিশ্বে লেসবিয়ানিজম সমাজে অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে, এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের বহু ক্ষেত্রেই সম্যক ধারণা নেই।
আলোচিত অধ্যায় ও উপন্যাসের মাধ্যমে নারী সমকামীরা যে অপ্রাকৃত বা অস্বাভাবিক কোনো নারী নয়, তারাও আমাদেরই মতো স্বাভাবিক নারী—এটাই সাধ্যমতো বলার চেষ্টা করেছি। বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত এই বিষয়ে এর আগে কোনো কাজ তেমনভাবে হয়নি। স্বল্প পরিসরে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সঠিক পর্যালোচনা এক কথায় অসম্ভব।
সৌজন্যেঃ Sabbir Hossain
বইটি পড়তে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন।