দিনলিপি - সরদার ফজলুল করিম
সরদার ফজলুল করিম আমাদের কালের একজন অসাধারণ মানুষ। কৃষক পরিবারের সন্তান, আপন মেধা ও শ্রমে হয়ে উঠেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র, শিক্ষকদের স্নেহধন্য। এম.এ পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিলেতে উচ্চশিক্ষালাভের জন্য পেয়েছিলেন সরকারি বৃত্তি। মানুষের মুক্তির সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে সংকল্পবদ্ধ এই বৃত্তি প্রত্যাখান করেছিলেন, ছেড়ে দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ম। আত্মগোপন করে কমিউনিস্ট পার্টির কাজ শুরু করেছিলেন। সেই অবস্থায় গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় আট বছর ছিলেন কারান্তরালে। তারই মধ্যে আরেক বিস্ময়। কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থীরূপে জেল থেকেই নির্বাচিত হয়েছিলেন পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য। সে গণপরিষদ যখন ভেঙে দিলো স্বৈরাচারি চক্র, তখন তার স্থান হলো আবারো কারাগারে। বেরিয়ে এসে যোগ দিলেন বাংলা একাডেমিতে, শুরু করলেন অরাজনৈতিক জীবন। অরাজনৈতিক কেবল সংগঠনের সঙ্গে সংস্রবের ক্ষেত্রে, অন্তরের দীপশিখা রইল অমলিন। তাই ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে আবার নিক্ষেপ করল কারান্তরালে। মুক্তিলাভ করলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পরে। প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের আহবানে ফিরে এলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পঠনপাঠনের পাশাপাশি চলল দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ধ্রুপদী সবগ্রন্থের বাংলা অনুবাদ, কোষগ্রন্থের বাংলা অনুবাদ, গ্রন্থ রচনা, নানা বিষয়ে মৌলিক লেখা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়া সত্ত্বেও লেখালেখি চলেছে অবিরাম, পড়িয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। মৃত্যু এসে যেদিন নিয়ে গেল তাকে, সেদিন রয়ে গেল রচনার অবিস্মরনীয় সম্ভার।
সরদার ফজলুল করিম নিয়মিত দিনপঞ্জি লিখেছেন। জ্ঞানের কথা, চিন্তার কথা থেকে শুরু করে তাকে বহনকারী রিকশাওয়ালার কথা, ছাত্রছাত্রীর কিছু সামান্য কথা যতদূর সম্ভব লিখে রাখতেন অকপট ভাষায়। ১৯৭৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছর বিভিন্ন সময়ে লেখা তার দিনপঞ্জি খণ্ডিতভাবে হাতে এসেছে মার্জিয়া লিপির- সরদার ফজলুল করিম কন্যা আফসানা করিম স্বাতী ও প্রিয় শিষ্য এম. এম. আকাশের সৌজন্যে। মার্জিয়া এসবের পাঠোদ্ধার করেছে, বিন্যস্ত করেছে একটা শৃঙ্খলায়, তারপর তুলে ধরেছে আমাদের কাছে। এসব অংশে আছে বহু রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী এবং সাহিত্যেকের প্রসঙ্গ, আছে অনেক বইপত্র ও অডিও টেপের বিষয়, আছে তার শিক্ষক ও গুরুজনের কথা, আছে দেশিয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ও মতাদর্শের সংঘাত নিয়ে তার ভাবনা, আছে কাছের মানুষের প্রসঙ্গ, আছে রিকশাচালকের পর্যবেক্ষণের উদ্ধৃতি। দিনপঞ্জিতে আছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরেও সমাজতন্ত্রে তার অটুট বিশ্বাসের কথা, আবার মৃত স্ত্রীর জন্য দোয়া করার ঘটনাও লেখা হয়েছে।
সরদার ফজলুল করিমের জ্ঞানের পরিধি, জীবনের নানা বিষয়ে তার আগ্রহ বিভিন্ন ব্যক্তির গুণগ্রাহিতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও উপলব্ধির উদারতার পরিচয় এই দিনপঞ্জির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। এসকল বৃত্তান্ত পাঠককে সমৃদ্ধ করবে, জানতে সাহায্য করবে ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য।
মার্জিয়া লিপিকে অভিনন্দন এই কাজটি করার জন্যে। প্রকাশককে ধন্যবাদ এসব লেখা আমাদের গোচরে আনার সুযোগ করে দেয়ায়। জ্ঞানতাত্ত্বিক সরদার ফজলুল করিমের ব্যক্তিগত ও মানবিক পরিচয় লাভ করে পাঠকগণ নিশ্চিতভাবে উপকৃত হবেন।
২৩ জানুয়ারি, ২০১৫
আনিসুজ্জামান
বাংলা বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Download and Comments/Join our Facebook Group