আহমদ শরীফ রচনাবলী ০৩
ভূমিকা
বাংলাদেশের জ্ঞানম নীষা ও পাণ্ডিত্যের জগতে আহমদ শরীফ মহীরুহ সদৃশ ব্যক্তিত্ব। ঊনাশিতম জন্মদিন উদযাপন শেষে আশি বছরের জীবন শুরু করার পর্যায়ে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ তিনি প্রয়াত হন। কিন্তু রেখে যান তার সারাজীবনের সঞ্চয়--অজস্র রচনা, অসংখ্য গ্রন্থ, অগণিত মূল্যবান গবেষণা। জীবনে এত বেশি লেখালেখি করেছেন যে সেগুলোর মুদ্রিত পৃষ্ঠা জড়ো করলে এক মহাস্তুপে পরিণত হবে বৈকি। নিঃসন্দেহে উত্তরসাধকেরা তার বিপুল গবেষণার ফসল দ্বারা ঋদ্ধ এবং তার অমল হিতবাদী চিন্তু দ্বারা অনুপ্রাণিত | বাংলাদেশের মনন ধারার সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি এক প্রভাবশালী পুরুষ । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গবেষণা সহকারী হিসেবে তার যথার্থ অধ্যাপনা জীবন শুরু । কিন্তু প্রভূত অধ্যয়ন, পরিচ্ছন্ন ইতিহাসজ্ঞান ও সমাজদৃষ্টির বিশ্লেষণী ক্ষমতা দিয়ে তিনি তাঁর গবেষণা ও জ্ঞানকে অসামান্য এক ঠিকানায় পৌছে দেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের গবেষক হিসেবে তার খ্যাতিও তুঙ্গে ওঠে । এ খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সবখানে, বাংলাভাষী সব অঞ্চলে ! আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের ভাইপো ও পোষ্যপুত্র এবং ভাবশিষ্য আহমদ শরীফ আবদুল করিমেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় ব্ৰতী হন। সংস্কৃতি ও সাহিত্য ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানের আত্মস্বরূপ অনুসন্ধানে ডক্টর শরীফের গবেষণা দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে। আধুনিক । বাংলা সাহিত্যের মতো মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যও যে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সাহিত্য সেই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করার কৃতিত্ব আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের ও আহমদ শরীফের । বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাহিত্য রাজ্যের বরপুরুষের পিতৃব্য ও ভাইপো উভয়কে নিশ্চয়ই উচ্ছ্বসিত করতালি দেবেন। উপাত্তে মধ্যযুগ, কিন্তু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পূর্ণ আধুনিক—এই হল আহমদ শরীফের মধ্যযুগের সাহিত্য গবেষণা। কিন্তু তবু অচিরে মূর্তিমান মধ্যযুগের তথাকথিত ভাবমূর্তি ভেঙে দেন আহমদ শরীফ এবং পদার্পণ করেন আধুনিক সাহিত্যের জগতে । মূল্যায়নে অভিনিবেশী হন উনিশ বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকারদের–বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত এবং আরো অনেকের; একসময় যেমন তিনি মূল্যায়ন করেছেন সৌলত উজির বাহরাম খান, আলাওল, কাজী দৌলত, মুহম্মদ কবীর, সৈয়দ সুলতান, মুহম্মদ খান প্রমুখের। হয়তো কখনো তার মূল্যায়ন প্রতিক্রিয়াপূর্ণ, কিংবা কখনো বিতর্কিত, কিন্তু আহমদ শরীফের লেখার মূল্য এইখানে যে, একটা নতুন অভিমত ও দৃষ্টির পরিচয় সেখানে অবশ্যই আছে। আবার প্রতিদিনের সমাজপ্রবাহকে তিনি অভিনিবেশ সহকারে দেখেন, প্রগতি ও প্রগতির দ্বন্দকে বুঝতে চেষ্টা করেন, কিন্তু সবসময় প্রগতির পক্ষেই নিজের চিন্তা ও অভিমত অনুকূল করে রাখেন । আহমদ শরীফের লেখায় বাংলাদেশের ভাঙাচোরা ও দুষ্ট সমাজের ক্লেদ ও ক্লিন্ন চিত্রগুলো অবশ্যই আছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই আহমদ শরীফ নৈরাশ্য ভারাতুর নন বরং মানবিক প্রত্যয় ও প্রত্যাশায় দারুনভাবে বিশ্বাসী। আহমদ শরীফ কলাবাদী লেখক নন, উপযোগিতাবাদী লেখক । সেই উপযোগিতাবাদের মূল আধার মানুষ, বাংলাদেশের মানুষ, বাংলা ভাষার মানুষ, নির্যাতিত নিপীড়িত যানুষ । বাংলাদেশের আধুনিক চিন্তাচেতনার জগতে আহমদ শরীফ একটি বলিষ্ঠ ভিত্তি নির্মাণ করেছেন । তিনি পুরোনো মূল্যবোধ ও সংস্কারের ঘোর বিরোধী, সর্বপ্রকার সামাজিক, রাজনৈতিক আধি-ব্যধির তুমুল সমালোচক । শ্রেয়সের সন্ধানী তিনি, তিনি গণমানবের হিতৈষী, সমাজতন্ত্রে আস্থাশীল, একশ ভাগ অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী এবং সেইজন্যই নাস্তিক্য দর্শনের অনুরাগী । তার গণমানব হিতৈষণা, মানবতাবাদ এবং সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, তাকে বাংলাদেশের বামধারায় লোকদের প্রিয় করেছে । স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সাহসী বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় তিনি সবসময় শ্রদ্ধেয় ও মান্য । অসংখ্য গ্রগতিবাদী ও স্বদেশহিতৈষী সংঘ, সমিতি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি ছিলেন যুক্ত এবং এই সব জায়গায় সবসময় তিনি স্পষ্টভাষী, অন্যায়ের প্রতিবাদকারী এবং গণমানবের হিতকামী । তারুণ্যমণ্ডিত আহমদ শরীফ জীবনে প্রচুর আড্ডা দিয়েছেন, জ্ঞান ও বিদ্যার কথা বলেছেন অজস্র ; ভাষণ, বক্তৃতা, বিবৃতি দিয়েছেন অসংখ্য । আহমদ শরীফ বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে একজন সেরা গবেষক, উল্লেখযোগ্য প্রাবন্ধিক ও লেখক এবং চিন্তাময়িক । চল্লিশটির বেশি মৌলিক গ্রন্থ এবং মল্লিশটিরও বেশি সম্পাদিত গ্রন্থ তিনি প্রকাশ করেছেন। দৈনিকে সাপ্তাহিকে কলাম লিখেছেন প্রচুর এবং আমৃত্যুই লিখেছেন। তাঁর রচনাসম্ভার নানা বিষয়ের, নানা প্রসঙ্গের ও নামা রসের ও ব্যঞ্জনার । ইতিহাস ও ধর্মদর্শনের অতি গুরুতর রচনা যেমন তার আছে, তেমনি আছে হালকা চালের লঘু রচনা। এত বিপুল রচনাসম্ভার রচনাবলীর আকারেই পরিবেশনযোগ্য !