সম্পত্তি নয়, সম্পদ হয়ে উঠুন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘হৈমন্তী’র নায়ক একবার বলেছেন, ‘কিন্তু আমি বিবাহসভাতেই বুঝিয়াছিলাম, দানের মন্ত্রে স্ত্রীকে যেটুকু পাওয়া যায় তাহাতে সংসার চলে কিন্তু পনের আনা বাকি থাকিয়া যায়। আমার সন্দেহ হয়, অধিকাংশ লোকে স্ত্রীকে বিবাহমাত্র করে, পায় না এবং জানেও না যে পায় নাই ; তাহাদের স্ত্রীর কাছেও আমৃত্যুকাল এ খবর ধরা পড়ে না। কিন্তু সে যে আমার সাধনার ধন ছিল ; সে আমার সম্পত্তি নয় সে আমার সম্পদ।’ তবু তো তখনকার দিনের নারীরা আজকের মতো বাইরে বেরোতে শেখেন নি। কিন্তু শিক্ষিত স্ত্রীরা তাদের শিক্ষিত স্বামীদের সুযোগ্য সঙ্গী হয়ে উঠবেন বলেই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন। বারোহাত কাপড়ে পেঁচানো একটা কলের পুতুলকে তো আর কেবল সম্মান দেখিয়ে সম্পদ ভাবা যায় না।
কিন্তু এ পিতৃতান্ত্রিক সমাজে স্ত্রী হচ্ছে স্বামীর স্থাবর সম্পত্তি। সম্পত্তির সংজ্ঞা কী ? যা আমার অধিকারভুক্ত তাই সম্পত্তি। জড় পদার্থ, অবলা প্রাণী, ক্রিতদাস মানুষের স্থাবর সম্পত্তিরূপে পরিগণিত। পুরুষের চোখে এই তিন গুণাবলির আধার নারী। এখনো পুরুষরা স্ত্রীকে নিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সময় তিনটা পোটলা প্রস্তুত করলে গোনার সময় গোনেন চারটি। বলাই বাহুল্য চতুর্থ পোটলাটি স্ত্রী। অনেক স্ত্রী এখনো পোটলা পরিচয়েই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সবকিছু মানিয়ে চলতে শিখিয়ে দেন আমাদের মা বাবারা। পুরুষরা সুন্দরী অবলা খুঁজে বেড়ান বিয়ে করার জন্যে। ‘লজ্জা নারীর ভূষণ’ আখ্যা দিয়ে নারীকে জড় সম্পত্তিতে পরিণত করার ফন্দি আঁটেন। ব্রীড়াবনত নারীকে ঘিরে সব সৌন্দর্য দানা বাঁধতে থাকে। শেকস্পিয়ার ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’ লিখে অবলা নারীদের নারী-সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। বাচালতা নারী-সৌন্দর্যের অঙ্গহানি ঘটায়। প্রকারান্তরে সম্পত্তি তথা ক্রিতদাস হয়ে ওঠার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
আমাদের আপামর পুরুষজাতি উত্তরাধিকারসূত্রে স্ত্রীকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিবেচনা করেন। তারা তাদের পিতাদের দেখে শেখেন, পিতারা তাদের পূর্বপুরুষদের। বিয়ের পরদিন থেকেই স্বামীরা ‘স্বামী’ অর্থাৎ প্রভু হয়ে বসেন। তার সম্পত্তির যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু করেন⎯ কী বিছানায়, কী বিছানার বাইরে। পরিবারের কেউ সেই ব্যবহারের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করতে পারেন না।
অন্যদিকে আবার স্বামীরা অনাদিকাল থেকেই স্ত্রীদের সম্পদ, তারা স্ত্রীর সম্পত্তি হতে অপমানবোধ করেন। যে সকল স্ত্রী স্বামীকে সম্পত্তি জ্ঞান করেন সে সকল স্বামী দুর্মুখদের কাছে ‘স্ত্রৈণ’ নামে অভিহিত। পুরুষশাসিত সমাজে ‘স্ত্রৈণ’রা যেন সমাজের ক্লাউন। ‘জরু কা গোলাম’ হচ্ছে পুরুষকে গালি দেবার সবচে’ মোক্ষম শব্দগুচ্ছ। অন্যদিকে যেসব স্ত্রী যত স্বামীঅন্তপ্রাণ, যত হুকুম তামিলে পটু, সেসব স্ত্রী সমাজে তত বাঞ্ছনীয়, তত আদরণীয় এবং সুশীল নারীজাতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আগেকার দিনে পরাজিত যোদ্ধাদের দেশ বা অঞ্চল অথবা পরিবারের নারীরা অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মতো জয়ী যোদ্ধাদের সম্পত্তি বা ‘গনিমত’ হিসেবে গৃহীত হতেন। এ মনোভাব থেকে আজকের বিজয়ীরাও একেবারে মুক্ত হয়েছেন তা হলফ করে বলা যায় না। শোনা যায়, এদেশের সংখ্যালঘু কোনো এক হতদরিদ্র বাবা সাম্প্রদায়িক আক্রমণকারীদের প্রতি তার একমাত্র রুটি রুজির সম্বল গরু দু’টোর পরিবর্তে তার কন্যাদের নিয়ে যেতে অনুরোধ করেছিলেন।
নারীরা যদ্দিন নিজেকে সম্পত্তি বিবেচনা করবেন, তদ্দিন নারীর মুক্তি নেই। সম্পত্তি-নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই, মতামতের মূল্য নেই, সিদ্ধান্তপ্রদানের ক্ষমতা নেই, স্বনির্ভর হওয়ার পথ নেই, ক্ষমতায়নের আশা তাদের দুরাশামাত্র। এ সবকিছুই অর্জন করতে পারেন, যে নারী নিজেকে সম্পদশালী হিসেবে গড়ে তোলেন তিনি। আর বলাই বাহুল্য, শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণই নারীকে অন্তরে-বাহিরে সম্পদশালী হতে সাহায্য করে। আজকাল সুশিক্ষিত বুদ্ধিমান পুরুষেরা সম্পদের মাহাত্ম্য বুঝতে শিখছেন শুধু নিজেদের নাগরিক জীবনযাপনে সচ্ছলতা আনার জন্যেই না, মানসিক সঙ্গীর সাহচর্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ মানসিকতায় বেড়ে ওঠার জন্যেও। তারা স্ত্রী হিসেবে পাবার জন্যে উচ্চশিক্ষিত-কর্মজীবী নারীর পাণিপ্রার্থী হচ্ছেন। কিন্তু তারপরেও নারীর দুর্ভোগ কেন কমছে না ?
আনজুমানের বয়স যখন আঠারো/উনিশ, তখন চল্লিশ বছর বয়সের এক বিপত্নীক জেলা প্রশাসকের সাথে তার বিয়ে হয়। আনজু যশোর অঞ্চলের গ্রামের মেয়ে। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই সুন্দরী আনজু জেলা প্রশাসকের নজরে পড়ল। তার পোশাক-আশাক ও হাবভাবে গ্রাম্য ছাপ স্পষ্ট হলেও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জেলা প্রশাসক বুঝে নিলেন, এ মেয়েকে ঘষেমেজে গড়ে তুলতে তার বেগ পেতে হবে না। যেমনটি বেগ প্রথম বিয়ের বেলা পেতে হয়েছিল। জেলা প্রশাসকের প্রথম বিয়ে হয় তার ইউনিভার্সিটির ইয়ারমেট বুলবুলির সাথে। আইনের ছাত্রী বুলবুলি আইন ব্যবসায় যোগদান করেন বিয়ের আগেই। ঢাকা হাইকোর্টে প্রাকটিসের জন্য স্বামীর চাকুরিস্থলে থাকতে পারতেন না বুলবুলি। স্বামী বুলবুলিকে তার পেশা ছেড়ে দিয়ে ঘর-সংসারে মন দিতে বলেছিলেন। বুলবুলি বলেওছিলেন যে সন্তান নেয়ার সময় হলে তিনি কিছুদিন প্রাকটিস বন্ধ রাখবেন। এমনকি সন্তান একটু বড়ো না হওয়া পর্যন্ত কাজে যোগ দেবেন না। কিন্তু স্বামী ওসব সাত-পাঁচ শুনতে রাজি নন। বুলবুলি যদি তার কাজ ছাড়তে না পারেন তবে তিনি অন্যরকম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবেন। বুলবুলি স্বামীর কর্মস্থলে গিয়ে জানতে পারলেন, আনজুমান নামের এক সুন্দরীকে তার স্বামী নাকি ইতোমধ্যেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। এ সংবাদ তার আত্মমর্যাদাবোধে গভীরভাবে আঘাত করলে তিনি আর স্বামীর সংসারে ফিরে যান নি। এদিকে জেলা প্রশাসক থেকে পদোন্নতি পেয়ে স্বামী আনজুমানকে নিয়ে ঢাকা চলে এলেন। প্রতিনিয়ত বিউটি পারলার ও আধুনিক সাজপোশাকে সাজিয়ে একবছরের মাথায় আনজুকে তার স্বামী অতি আধুনিকা তরুণীতে পরিণত করলেন। বড়ো বড়ো পার্টিতে স্ত্রীকে নিয়ে হাজির হতে লাগলেন। দু’তিন বছরের মাথায় ঢাকার অভিজাত এলাকায় বাড়ি, দামী গাড়ি হলো আর মাঝেমধ্যেই বিদেশ ভ্রমণ করে সময় কাটাতে লাগলেন আনজু ও তার স্বামী। বুলবুলির স্বনির্ভরতার পেছনে কারণ ছিল আত্মোন্নতির সাথে সাথে নিজেকে মর্যাদাবান ও ক্ষমতায়িত করা এবং নিজের পরিবারকেও সচ্ছলতা দেয়া। স্বামী তখন স্ত্রীর শ্রমার্জিত টাকা সংসারের কাজে লাগানোকে পৌরুষের অবমাননা ভেবেছিলেন। কিন্তু বর্তমান স্ত্রীর বদৌলতে পাওয়া ধন-সম্পদে দিন দিন ধনী হচ্ছেন স্বামী। এখানে স্বামীর কোনো আফসোস বা অবমাননা নেই। কিন্তু আনজু কি স্বনির্ভর ? আনজুর নিজের সৌজন্যে অর্জিত টাকায় আনজুর অধিকার কতটুকু ? বুলবুলি হতে চেয়েছিলেন স্বামীর সম্পদ। আনজু পরোক্ষভাবে বুলবুলির চেয়ে বেশি টাকা উপার্জন করলেও সে স্বামীর নির্ভেজাল সম্পত্তি।
জাবিন মাহমুদের বিয়ে হয়েছিল রংপুরের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর সাথে। জাবিনের বাবা মধ্যবিত্ত। কিন্তু বাবা-মাকে স্বামী বা তার পরিবারের কাছে জাবিন কী করে ছোট করবে ? তার ছোট বাচ্চা দুটোকে তার বাবার বাড়ির এলাকার একটা ছেলে প্রাইভেট পড়াত। কোনো ঈদ বা উৎসবে স্বামীসহ বাবার বাড়ি যাওয়ার আগে স্বামীকে লুকিয়ে দামী শাড়ি, পাঞ্জাবি, বাচ্চাদের কাপড় কিনে জাবিন প্রাইভেট টিউটরের হাতে দিয়ে দিত। প্রাইভেট টিউটর ওরা যাওয়ার আগেই সেগুলো জাবিনের মায়ের হাতে পৌঁছে দিত। বাপের বাড়ি থেকে ফেরার আগের দিন জাবিনের মা জামাই-এর সামনে মেয়ের জন্য শাড়ি, জামাই-এর পাঞ্জাবি আর নাতি-নাতনিদের কাপড়চোপড় নিয়ে আসত। জাবিন কেবলই বলত ‘কী সুন্দর হয়েছে মা কাপড়গুলো!’ জামাই বলত⎯ ‘আহা এসবের আর কী দরকার ছিল’।
স্বনির্ভরতা কেবল সংসারেই সচ্ছলতা আনে না, নিজেকে গুরুত্বপূর্ণও ভাবতে শেখায়। তাই বলে যারা সচ্ছল, স্বামীর অঢেল ধন-সস্পত্তির মধ্যে অভাব নামক রোগটা বাসা বাঁধতে পারে না, তাদের কি আসলেই নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দরকার নেই ? তাহলে জাবিনের মতো আর কতদিন নিজের সাথে প্রতারণা করতে হবে ? একদিন হয়ত কোনো গৃহবধূর ইচ্ছে হলো যে তার মা চলাফেরা করতে পারেন না, তাই তাকে একটা হুইল চেয়ার কিনে দিলে তার জীবনটা অনেক সহজ হয়ে উঠতে পারে। কেননা তিনি তার স্বামীকে দেখেছেন তার বাবার জন্য ওরকম ব্যবস্থা করতে। তিনি তার ইচ্ছের কথা একদিন দ্বিধাভরে স্বামীর কাছে ব্যক্তও করলেন। স্বামী বিষয়টাকে অত গুরুত্ব না দিয়ে একদিন বেমালুম ভুলে গেলেন। শ্বশুরের হুইল চেয়ার ঠেলতে গিয়ে কি কখনো সে নারীর চোখ জলে ভিজে উঠবে না ? কিংবা ভাইয়ের ছেলে ভালো রেজাল্ট করেছে শুনে কারো ইচ্ছে হলো ছুটে গিয়ে ওকে একটা কিছু উপহার দিতে। কিন্তু উপহার দেবার টাকা চাইতে হবে তো সেই স্বামীরই কাছে ? তখন তিনি ভাববেন⎯ ইস্, যদি একান্ত নিজের একটা অ্যাকাউন্ট থাকত, নিজের আয়ে গড়া ? অনেক স্বামী হয়ত উদারতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে স্ত্রীকে বলেন, ‘আমার টাকাকে নিজের টাকা মনে করলেই পারো’⎯ আবার বাড়তি খরচ হয়ে গেলে হিসেবের খাতা খুলে বসেন। শিক্ষিত নারী হয়ে এই পরমুখাপেক্ষিতার জন্য বুকের মধ্যে খচখচ করে না ?
স্ত্রী কেবল নিজেই সম্পত্তি নন, স্ত্রী সম্পত্তির যোগানদাতাও। এখনো এদেশে যত নারীহত্যা হচ্ছে তার বেশিরভাগই যৌতুকের বলি। তবে কি স্ত্রী কেবল শিক্ষিত, স্বনির্ভর বা কর্মজীবী হলেই সম্পদে পরিণত হন, না হলে নয় ? না, কর্মজীবী না হয়েও অনেকে সম্পদ হতে পারেন। অন্তর্গত সম্পদে যার হৃদয় পরিপূর্ণ, তাকে বাহ্যিকভাবে সম্পদশালী না হলেও চলে।
সুরাইয়া জামান যখন শ্বশুরবাড়িতে আসেন তখন তার বয়স উনিশ/কুড়ি। বাড়ির বড়ো বউ। তার তিন দেবর, এক ননদ এবং শাশুড়ি। বাড়িতে ঢুকে যেখানে পা দেন সেখানেই আরশোলা। ঘরের যদ্দুর চোখ যায় টেবিল চেয়ার বিছানা সবগুলোর ওপর কাপড়ের স্তুপ। ওয়ার্ড্রােবের ড্রয়ার খুলতেই তিনটা ধেড়ে ইঁদুর ধাক্কা দিয়ে পালালো। জানালা-দরজার পর্দাগুলোর আসল রং কী ছিল তা গবেষণার জন্য রসায়নবিদকে ডাকা লাগে। সুরাইয়া মুহূর্তেই বুঝে ফেলল এ বাড়ির বারোটা বেজে আছে। বাড়ির প্রতিটি মানুষ অগোছালো। বৃদ্ধ মায়ের শাসন করার আর বয়স নেই। নিজের গুছিয়ে রাখার সামর্থ্যও নেই। উপরন্তু, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বিল জমে ডাঁই হয়ে আছে। ফ্রিজে আদ্দিকালের শুকনো পচা সবজি খাবার জমে আছে। সুরাইয়া যেদিকে হাত দেয়, সেখানেই আবর্জনার বোঝা। তিন ভাইয়ের এক বোনকে আদর দিয়ে ননীর পুতুল বানিয়ে রাখা হয়েছে। ঠিকে ঝি এসে নিজের মতো খেয়েদেয়ে রাজ্যের অপচয় করে টেবিলে খাবার দিয়ে যাচ্ছে। সুরাইয়া কোমর বেঁধে লাগল সংসার গোছাতে। প্রথম প্রথম সবাই একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল। বাড়ির বউ-এর আবার এতদিকে নজর দেয়ার দরকার কী ? কিন্তু বাড়িতে ঢুকে আত্মীয়-স্বজন যখন দেখল বাড়ির আমূল পরিবর্তন⎯ পরিচ্ছন্ন, গোছানো, সাজানো, ছবির মতো একটা বাড়ি, তখন সুরাইয়া হয়ে উঠল শ্বশুরবাড়ির সম্পদ। সুরাইয়ার মত না নিয়ে কেউ আর দু’পাও এগোয় না। যে মেয়ের হাতের স্পর্শে সবকিছু সোনা হয়ে উঠল, সে ছাড়া কে পারবে কঠিন কিছুর সমাধান করতে ?
বউ পেটাতে সব জাতের পুরুষই ওস্তাদ। কী ইউরোপ-আমেরিকা, কী ভারত-বাংলাদেশ। আমাদের দেশের একটা কৌতুক এরকম⎯ মজিদ মিয়া বউকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। বউকে একদণ্ড না দেখলে তার প্রাণ ছটফট করে। গ্রামের সবাই জানে মজিদটা একটা জরু কা গোলাম। মজিদের সমবয়সীরা মজিদকে টিটকারি করে যে, সে কি একটা পুরুষ ? বউ না পেটালে কেউ কি তাকে পুরুষ বলে মানবে ? তার বউ-ই তো তাকে পুরুষ নামের কলঙ্ক ভাববে। কিন্তু মজিদ মিয়া ভেবে পায় না, যে বউকে সে প্রাণের অধিক ভালোবাসে সে তাকে খামোখা মারতে যাবে কেন ? কিন্তু সে যে পুরুষ তারও তো প্রমাণ দিতে হবে। একদিন একটা সরু পলকা পাটকাঠি দিয়ে সে সবার সামনে বউকে ঠুকঠুক করে পিটালো।
আর মহাগর্বে সবাইকে বলতে লাগল⎯ লোকে দেখুক মজিদ মিয়া বউ পেটায় কি না। পেটাতে পেটাতে এই যে আমি লাঠি ভেঙে ফেলেছি। বলে সে নিজেই কেঁদে ফেলে। লোকে মুখ টিপে হাসে। কেননা তারা জানে পাটকাঠিও লাঠি নয়, আর মজিদ মিয়াও পুরুষ নয়।
বড়োলোকের একমাত্র মেয়ে মৌমিতাকে প্রচুর যৌতুক নিয়ে বিয়ে করল হারুন। মৌমিতাকে অনেক আদরে আহ্লাদে মানুষ করেছিলেন বাবা-মা। মেয়েকে কুটো ভেঙে দুটো করার ক্লেশ সহ্য করতে দেন নি। বিয়ের প্রথম প্রথম বেশ যতেড়বই থাকল সে। কদিন পরেই স্বামী তার সাথে দাসীবাঁদির মতো ব্যবহার শুরু করল। বাড়ি থেকে বেরোনোর মুখে এক লাথি, ঢুকেই এক লাথি। কেন ? না, স্বামী বউকে যখন ইচ্ছে বিনা কারণেই মারতে পারে। বউ তো স্বামীর সম্পত্তি। কারণও কদিন পরেই উদ্ঘাটিত হলো। আরো যৌতুক চায় স্বামী। মৌমিতাকে তিনদফা বাপের বাড়ি পাঠিয়ে আরো দ্বিগুণ যৌতুক আদায় করল সে। চতুর্থবার মৌমিতা যখন আর রাজি হলো না, তখন শাশুড়ি আর স্বামীর বেধড়ক পিটুনিতে মৌমিতা মারা গেল। মৃতকে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে আত্মহত্যার অপবাদ দিয়ে পার পেতে চাইল স্বামী-শাশুড়ি। কিন্তু দশ বছর পর বিচারে শেষরক্ষা হলো না।
স্বামী শব্দটিই এসেছে ঈশ্বর বা প্রভু থেকে। ঈশ্বরকেও আমরা ‘জগতের স্বামী’ বলে অভিহিত করি। বাস্তবের স্বামীদের অবস্থান ঈশ্বরের ইমিডিয়েট নিচে। আমাদের চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে কবরীর মুখ দিয়ে গাওয়ানো হয়⎯
"আমি তোমার বধূ তুমি আমার স্বামী
খোদার পরেই তোমায় আমি বড়ো বলে জানি"
ভারতের চলচ্চিত্রেও ‘পতি পরমেশ্বর’ জাতীয় ছবির ছড়াছড়ি। স্বামীরা স্ত্রীদের বুঝিয়ে দেন তাদের সেবা করা একঅর্থে ঈশ্বরকেই সেবা করা। হিন্দু পুরাণে আদর্শ হিন্দুনারী সম্পর্কে এরকম মিথ রয়েছে⎯ আজীবন বেশ্যাসক্ত এক স্বামী যখন যৌনরোগে প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী, তখনো তার মাঝে মাঝে বেশ্যালয়ে যাওয়ার খায়েশ হতো। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত অসংযমের ফলে স্বামী রোগে জর্জরিত, চলচ্ছক্তিহীন। সাধ্বী স্ত্রী স্বামীর ইচ্ছাপূরণের জন্য তাকে ঝুড়ির মধ্যে বসিয়ে মাথায় করে বেশ্যালয়ে পৌঁছে দিত। তখন যে পশুচালিত শকট-টকট একবারে ছিল না তা কিন্তু নয়। তাহলে স্বামীকে মাথায় করে বেশ্যালয়ে পৌঁছে দিতে হবে কেন ? এরও একটা তাৎপর্য আছে বৈকি! তা হচ্ছে বেশিমাত্রায় পুণ্যলাভের আশা। আর স্বামী যেহেতু ঈশ্বরের প্রতিভূ, তাকে মাথায় তুলে রাখাই শ্রেয়। জগৎ দেখুক, ঈশ্বর স্বয়ং দেখুক, এরকম পতিপরায়ণরাই হচ্ছে হিন্দু নারীর আদর্শ।
ইসলাম ধর্মেও পতিপরায়ণ নারীরাই সকল নারীর মধ্যে উত্তম এবং আখিরাতে তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার পাবেন। কেমন পতিপরায়ণ হলে আল্লাহ খুশি হবেন ? এক ছিল কাঠুরিয়ার বউ। পুরুষ বউ পেটাবে, এ রীতি আবহমান কালের। কাঠুরিয়া বউ পেটাতে পারে না, কারণ বউ-এর কোনো দোষ সে দেখে না। সামান্য একটু দোষ পেলেও তো পৌরুষ জাহির করা যায়। কাঠুরিয়া অনেক চেষ্টা করে, কীভাবে বউকে ফাঁসানো যায়⎯ কিন্তু পারে না। কাঠুরিয়া যখন যা চায়, বউ সঙ্গে সঙ্গে তা হাজির করে। কাঠুরিয়ার মাথায় জেদ চেপে গেল। বউ-এর ত্রুটি সে বের করবেই। একদিন বউকে না মারলে সমাজে তো আর সম্মান থাকে না। কাঠ কেটে এসে একদিন কাঠুরে ঘরের দাওয়ায় বসতে না বসতেই বউ পাখা-পানি নিয়ে হাজির। কাঠুরে বলল⎯ ‘এসব কিছুই চাই না, আমি মনুষ্য বিষ্ঠা চাই। এক্ষুণি।’ কাঠুরে ভাবল এতদিনে বউকে বাগে পেয়েছে। এ জিনিস সঙ্গে সঙ্গে বউ দিতেও পারবে না, তারও মনের খায়েশ মিটবে। কিন্তু চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাশেই ঝুড়ি দিয়ে ঢেকে রাখা তার ছোট সন্তানটির সদ্য পরিত্যাগকৃত বিষ্ঠার প্রতি স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। কাঠুরের মিশন এবারেও ব্যর্থ।
ধর্মে নারীর বিষয় আলোচনার সময় বলা হয় যে, পুণ্যবতী বিশ্বজননী ফাতেমা জোহরা পৃথিবীতে সতী-সাধ্বী নারীর প্রতীক হিসেবে প্রথমে জান্নাতে প্রবেশ করবেন, কিন্তু তিনি যে ঘোড়ার পিঠে বসে প্রবেশ করবেন, সে ঘোড়ার লাগাম ধরে নিয়ে যাবেন সেই কাঠুরিয়ার বউ। অর্থাৎ কাঠুরিয়ার বউ-ই সর্বাগ্রে জান্নাতে প্রবেশ করবেন।
এ সকল গল্পের অবতারণা হয়েছে নারীর কেমন হওয়া উচিত তার উদাহরণ দেয়ার জন্য। বলা হয়েছে, পতিপরায়ণ ও বাধ্য নারী ছাড়া কেউ বেহেশত বা স্বর্গে যেতে পারবে না।
ধর্ম বা পুরাণ আদর্শ নারীর একটা ছবি প্রতিটি পুরুষের মনের মধ্যে এভাবেই প্রোথিত করে দেয়। পুরুষরা যুগ যুগ ধরে এ সকল ধারণা লালন ও পালন করতে থাকেন। তাই আজকের শিক্ষিত কর্মজীবী নারী সিলভিয়া সময়ের প্রয়োজনে বাইরে কাজ করার সুযোগ পেলেও ঘরে ফিরে তাকে স্বামীসেবা করতে হয়, সারাদিনের কর্মক্লান্তির পরেও বাইরের কাপড় ছেড়েই রান্নাঘরে ঢুকতে হয়, সকালে সবার খাওয়ার আয়োজন করেই কাজে বেরোতে হয়। সামাজিক প্রয়োজনে তাকেই অফিস থেকে ছুটি নিতে হয়। বসের হাতে-পায়ে ধরে বিভিন্ন জায়গায় বাধ্যতামূলক অফিসিয়াল ট্যুর বাতিল করার অনুরোধ করতে হয় এবং অবশেষে মাস শেষে নিজের কষ্টার্জিত বেতনের পুরোটাই স্বামীর হাতে তুলে দিতে হয়।
দিন পালটাচ্ছে। শিক্ষিত, স্বনির্ভর, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী নারীরা স্বামীর সম্পত্তি হওয়াকে বিশেষ অবমাননাকর মনে করছেন। শিক্ষায়, প্রশিক্ষণে, দক্ষতায় নারী নিজেই সম্পদশালী হয়ে উঠছেন। এ সকল সম্পদশালী নারীকে তাদের স্বামীদের সম্পদ না ভাবার তো কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু তারপরেও রক্তে এবং মানসিকতায় পুরুষতন্ত্রের বীজ সমূলে উৎপাটন করতে পারেন না বলেই উন্নত বিশ্বে সমমনা দুটি ছেলেমেয়ে ভালোবেসে বিয়ে করে বা একসাথে থাকার পরেও দ্রুত তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এ বিচ্ছেদের অনেকগুলো কারণ থাকে। তার মধ্যে প্রধান কারণ হলো স্বামীর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। স্বামীর সমশিক্ষিত, সমমর্যাদাসম্পন্ন, সমমজুরি বা অধিকতর বেশি উপার্জনক্ষম স্ত্রী বা সঙ্গী যেদিন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারেন তার স্বামী বা পুরুষ সঙ্গীটি তাকে নিজের চেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণী বলে বিবেচনা করছে এবং উৎপীড়কের হস্ত ক্রমাগত প্রসারিত করছে, সেদিন একটি স্থায়ী গৃহকোণের স্বপ্ন দেখা নারী বাধ্য হয়ে স্বামীর ঘর ছাড়েন। নারী আত্মনির্ভর হওয়াতে তারা যেমন নিজেই নিজের সম্পদ, তেমনি স্বামীদেরও তাদের সম্পদই বিবেচনা করা উচিত। এ সকল নারীর আত্মমর্যাদাজ্ঞান প্রখর হওয়ার জন্যে স্বামীর পীড়ন সহ্য করেও কেবল সমাজ-সংসারের মুখ চেয়ে সেই সংসারে পড়ে থাকার আর কোনো অর্থ খুঁজে পান না। বাইরে কাজ করে অর্থ উপার্জন না করলে কি সে নারী সম্পদশালী নন ? যে নারী প্রকৃতির চলমানতাকে গতিশীল রাখতে সন্তান নামক সম্পদ উদরে ধারণ করেন, জন্ম দেন, লালন ও প্রতিপালন করেন, তার তো অন্য কোনো সম্পদে সম্পদশালী না হলেও চলে। নারী নিজগুণে পরিবারের চারকোণ মমতায় আগলে রাখেন বলেই না পরিবারপ্রথা আজো পৃথিবীতে টিকে আছে। তবু নারীর এ অন্তর্নিহিত সম্পদকে সম্পদ বলে স্বীকার না করার কারণেই নারী অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন করে প্রকৃত সম্পদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করছেন।
পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবসম্পন্ন অনেকেই বলে থাকেন⎯ নারীর অবস্থান ঘরে। নারী সন্তান জন্ম দেবে। আবার সে সন্তান কেবল কন্যাসন্তান হলেই চলবে না, দিতে হবে পুত্রসন্তান⎯ ‘পুত্রার্থে ক্রয়িতে ভার্যা’। স্বামীর সেবা করবে। সন্তান লালনপালন করবে। পুত্রসন্তান জন্ম দিতে না পারলে সপত্নীর সাথে বসবাস করতে হবে। ধরিত্রীর মতো সর্বংসহা হতে হবে। রোবটের মতো চাহিদাহীন হতে হবে। প্রকারান্তরে গৃহপালিত পশুর মতো মনিবের মার খাওয়া সম্পত্তিতে পরিণত হতে হবে।
আবার বিবাহকেই জীবনের শ্রেষ্ঠ পরিণতি ভাবারও কোনো কারণ নেই। মেধা ও মননে সম্পদশালী হলে জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই ঠেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। দাম্পত্যজীবনে মতৈক্য-মতানৈক্যের
টানাপড়েনে সংসার ভাঙতেও পারে, আবার বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেও একছাদের নিচে দুটো জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন এ সমাজের অনেকেই। তবে যেহেতু পরিবারপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় সমাজবিজ্ঞানীরা বিবাহিত জীবনকে উৎসাহিত করছেন, সেহেতু একটা ভারসাম্যপূর্ণ স্থায়ী ছাদের জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই উভয়ের সম্পদ বিবেচনা করা সুফল বয়ে আনতে পারে। অনেকে হয়ত বলবেন, পশ্চিমের স্বামী-স্ত্রীরা উভয়েই শিক্ষিত সম্পদশালী কিন্তু সংসার টিকছে কই ? বরং এতে করে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ ও আত্মমর্যাদাবোধ এত প্রবল হয়ে উঠছে যে মর্যাদায় সামান্য আঘাত লাগলেই যে যার মতো কেটে পড়ছেন। কিন্তু এর কুফল ভোগ করছে তাদের নিষ্পাপ সন্তানেরা। এর মূলেও কিন্তু রয়েছে স্বামীদের পুরুষতান্ত্রিক সনাতন বিশ্বাসের ভিত অটুট রাখার দ্বন্দ্ব। আক্রমণটা আসছে মূলত পুরুষদের পক্ষ থেকে। শিক্ষিত ও রিসোর্সফুল স্ত্রী/সঙ্গী শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্যহীনতার কারণে পুরুষরা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পেয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু রক্তে শোষকের বীজ উপড়ে ফেলতে বড়োই যাতনাবোধ করছেন বলে সহাবস্থান তাদের জন্য কখনো কখনো পীড়াদায়ক হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে আত্মনির্ভরশীলতার কল্যাণে স্বামীর শোষণের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিয়ে নারীরা বেরিয়ে পড়ছেন। বিরোধীপক্ষ তর্কে অবতীর্ণ হয়ে বলতে পারেন, কেবল একপক্ষকে দোষারোপ করলে তো হবে না। নারীরাও কিছু ধোয়া তুলসীপাতা নন। কিন্তু সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, নারীরা শারীরিক এবং প্রাকৃতিক কারণেই একটি স্থায়ী দাম্পত্যজীবনকে অগ্রাধিকার দেন। এখনো খুব বাধ্য না হলে অনেক নারীই ছোটখাট মতানৈক্যকে প্রাধান্য না দিয়ে সংসার টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। জননী নারীকে সাতপাঁচ অনেক ভেবে ঘর ছাড়তে হয়। তিনি শিক্ষিত স্বনির্ভর হলেও। সে কারণেই পশ্চিমের নারীদের কাছে স্বামী হিসেবে প্রাচ্যের পুরুষরা ইপ্সিত। কারণ প্রাচ্য এখনো এক এবং স্থায়ী পারিবারিক মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা করে।
তাই প্রাতঃস্মরণীয় কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে হচ্ছে, স্ত্রীকে কেবল সম্পদ বিবেচনা করলেই মোক্ষলাভ হবে না, সেই সম্পদ সঠিকভাবে হেফাজতও বাঞ্ছনীয়। তা না হলে হৈমন্তীর মতো সম্পদকে এ কালের অপূর্বদেরও অকালে হারাতে হতে পারে।
-- উম্মে মুসলিমা