আপনি কার জন্য লেখেন?
ওরহান পামুক
আপনি কার জন্য লেখেন? প্রায় ত্রিশ বছর ধরে, যখন থেকে আমি লিখতে শুরু করি সেই সময় থেকে, এই একই প্রশ্ন বার বার শুনতে হয়েছে আমাকে। সবচেয়ে বেশিবার আমাকে এই প্রশ্ন করেছেন আমার পাঠক আর সাংবাদিক আমি এই প্রশ্ন সব চাইতে বেশি শুনেছি আমার পাঠক আর সাংবাদিকদের কাছ থেকে। এর উদ্দেশ্য নির্ভর করে স্থান ও কালের উপর, তাদের কৌতুহলের মাত্রাও নির্ভর করে তার উপর, কিন্তু তাদের সকলের প্রশ্নের মধ্যে একটা সন্দিগ্ধ, উন্নাসিক ও অবজ্ঞার সুর ফুটে ওঠে।সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে, আমি যখন প্রথম ঔপন্যাসিক হবার সিদ্ধান্ত নিই তখন এই প্রশ্নের মধ্যে অবজ্ঞা ও উন্নাসিকতা ধরা পড়তো, একটা গরিব অ-পাশ্চাত্য দেশ যে আধুনিক হবার জন্য সংগ্রাম করছে তার জন্য শিল্প সাহিত্যের চর্চা একটা বিলাসিতা, এই বিলাসিতাকে প্রশ্ৰয় দেয়ার সামর্থ্য তার নাই। এর মধ্যে আরেকটা ইঙ্গিতও ছিল, “তোমার মতো একজন শিক্ষিত ও রুচিশীল মানুষ” তার দেশকে আরও বেশি ভালো ভাবে সেবা করতে সক্ষম হবে যদি সে ডাক্তার হয়ে মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করে কিংবা প্রকৌশলী হয়ে সেতু নির্মাণ করে। (জঁ পল সাৎর ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে তার এক মন্তব্য দ্বারা এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা এনে দেন। তিনি বলেন, তিনি যদি বায়াফ্রার একজন বুদ্ধিজীবী হতেন তাহলে তিনি নিজেকে উপন্যাস রচনার কাজে নিয়োজিত রাখতেন না ।)
পরবর্তী বছরগুলিতে প্রশ্নকর্তারা আরেকটি বিষয় জানতে বেশি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। সমাজের কোন অংশ আমার লেখা পড়বে এবং পড়ে মুগ্ধ হবে বলে আমি আশা করি? আমি বুঝতে পারি যে এটা একটা চতুর কুটিলতাপূর্ণ প্রশ্ন, কারণ আমি যদি “সমাজের সব চাইতে দরিদ্র ও পদদলিত মানুষদের জন্য লিখি” একথা না বলি তখনই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে যে আমি তুরস্কের ভূস্বামী ও বুর্জোয়াদের স্বার্থ রক্ষা করছি, একই সঙ্গে আমাকে এটাও স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে, পবিত্রচিত্ত ও সহৃদয় যে-লেখক দাবী করবেন যে তিনি কৃষক, শ্রমিক ও অভাবী জনগণের জন্য লেখেন তিনি আসলে তাদের জন্য লিখছেন যারা প্রায় পড়া-লেখাই জানে না। ১৯৭০-এর দশকে আমার মা যখন তার বিষন্ন ও চিন্তিত কণ্ঠে আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন আমি কাদের জন্য লিখছি, তখন তিনি আসলে জিজ্ঞাসা করতেন, আমি কীভাবে আমার আত্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবো? আর আমার বন্ধুবান্ধবরা যখন জিজ্ঞাসা করতো আমি কাদের জন্য লিখি, তখন তাদের গলায় যে ঠাট্টার সুর ফুটে উঠতো তা পরিষ্কার বলে দিতো যে তাদের বিবেচনায় আমার মতো একজন লোকের লেখা কোনো বই পড়বার ইচ্ছা কারো মনে কখনো জাগবে না।
ত্রিশ বছর পর এখন আমি এই প্রশ্ন আগের চাইতে বেশি ঘন ঘন শুনি। এর একটা কারণ সম্ভবত এই যে আমার উপন্যাসগুলি চল্লিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। গত দশ বছরে অনেকে আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, তারা হয়তো মনে করেন যে আমি তাদের কথা ভুল ভাবে গ্রহণ করতে পারি, তাই তারা প্রায়ই একটা কথা যোগ করেন, “আপনি তো তুর্কি ভাষায় লেখেন, তাহলে আপনি কি শুধু তুর্কিদের জন্য লেখেন, নাকি অনুবাদের মাধ্যমে আপনার লেখা যে বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর কাছে পৌছে যাচ্ছে তাদের কথাও ভেবে লেখেন?” তুরস্কের ভেতরে অথবা বাইরে যেখানেই আমরা কথা বলি, এই প্রশ্নের সঙ্গে সর্বদা যুক্ত থাকে ওই একই সন্দিগ্ধ ও অবজ্ঞামাখানো হাসি, যার ফলে আমি যদি আমার লেখাকে যথার্থ ও অকৃত্রিম বলে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত করাতে চাই তাহলে আমাকে বলতেই হবে, “আমি একমাত্র তুর্কিদের জন্যই লিখি।"
এই প্রশ্নটি পরীক্ষা করে দেখার আগে, কারণ এটা সৎও নয়, মানবিকও নয়, আমাদের স্মরণ রাখা দরকার যে উপন্যাসের উদ্ভব হয় জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভবের সঙ্গে, একই সময়ে । উনবিংশ শতকের মহান উপন্যাসগুলি যখন রচিত হয় তখন উপন্যাসের শিল্পকলা ছিল একান্ত ও সর্বোতভাবে একটি জাতীয় শিল্পকলা । ডিকেন্স, দস্তয়েভস্কি এবং টলষ্টয় একটি উত্থানরত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য লেখেন, তারা তাদের জাতীয় লেখকের রচনায় পরিবেশিত প্রতিটি রাস্তা, বাড়ি, ঘর এবং আরামকেদারা শনাক্ত করতে পারে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী বাস্তব জীবন ও ধারণাবলী নিয়ে যে রকম সানন্দ আলোচনায় মগ্ন হতো তাদের জাতীয় লেখকদের রচনা নিয়েও অনুরূপ আলোচনায় মগ্ন হতো। উনবিংশ শতকে গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের উপন্যাস প্রথমে জাতীয় সংবাদপত্রগুলির শিল্প-সাহিত্যের ক্রোড়পত্রে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতো, কারণ তাদের লেখকরা একটা জাতির কাছেই তাদের কথা বলতেন। তাদের বর্ণনামূলক কণ্ঠস্বরের মধ্যে আমরা সংশ্লিষ্ট দেশপ্রেমিকের একটা গভীর অস্বস্তির সুর শুনতে পাই, যে দেশপ্রেমিকের ঐকান্তিক কামনা তার দেশ যেন উন্নতির পথে অগ্রসর হয়। উনবিংশ শতকের শেষ নাগাদ উপন্যাস রচনা করা ও পড়া জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ নিয়ে একটা জাতীয় আলোচনায় যোগদানের ব্যাপার হয়ে ওঠে।
কিন্তু বর্তমানে উপন্যাস রচনা একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ পরিগ্রহণ করেছে। সাহিত্যিক উপন্যাস পাঠের ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটেছে। প্রথম পরিবর্তন দেখা যায় বিংশ শতকের প্রথমার্ধে, যখন আধুনিকতার সঙ্গে সাহিত্যিক উপন্যাসের যোগাযোগের কারণে তা উচ্চ শিল্পকলার মর্যাদা লাভ করে । তথ্য প্রবাহের ক্ষেত্রে গত ত্রিশ বছরে যে বিশাল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তার প্রভাবও হয় তাৎপর্যপূর্ণ। পৃথিবীব্যাপী যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে লেখক এখন আর স্বদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্দেশে লেখেন না, “সাহিত্যিক উপন্যাস”-এর লেখকরা এখন সারা বিশ্বের পাঠকদের কথা মাথায় রেখে লেখেন। এক সময় পাঠকবর্গ ব্যগ্রভাবে ডিকেন্সের একটা নতুন লেখার জন্য অপেক্ষা করতেন, শেষ সংবাদ শোনার মতো ব্যগ্রতা নিয়ে, এখন বর্তমান সময়ের সাহিত্যিক পাঠকরা একই রকম ব্যগ্রতা নিয়ে গার্সিয়া মার্কেজ, কুদসিয়া অথবা পল অস্টারের নতুন বই-এর জন্য অপেক্ষা করে। সাহিত্যিক ঔপন্যাসিকদের এই সম্মিলিত বিশ্বপাঠক দলের সংখ্যা তাদের স্বদেশের পাঠকবর্গের চাইতে অনেক বেশি ।
লেখকরা কাদের জন্য লেখেন, আমরা যদি এই প্রশ্নকে সাধারণীকরণ করি তাহলে হয়তো আমরা বলতে পারি যে তারা লেখেন তাদের আদর্শ পাঠকদের জন্য, তাদের প্রিয় মানুষদের জন্য, তাদের নিজেদের জন্য, অথবা কারও জন্যই নয়। এটা সত্য কিন্তু সামগ্রিক সত্য নয়। কারণ বর্তমান কালের সাহিত্যিক লেখকরা তাদের জন্যও লেখেন যারা তাদের লেখা পড়ে। এ থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে বর্তমানের কালের সাহিত্যিক লেখকরা ক্রমেই তাদের স্বদেশের অধিকাংশ মানুষদের জন্য (যারা তাদের লেখা পড়ে না) কম লিখছেন, এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের সংখ্যালঘু পাঠক গোষ্ঠীর জন্য, যারা তাদের লেখা পড়ে, তাদের জন্যই বেশি লিখেছেন। সেজন্যই এই পরিস্থিতি : এই সবই লেখকের প্রকৃত অভিপ্রায় সম্পর্কে সন্দেহ এবং নানা রকম খোচা দেয়া প্রশ্ন এবং বিগত ত্রিশ বছর ধরে এই যে নতুন সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছে তা নিয়ে অস্বস্তির কারণ।
অ-পাশ্চাত্য দেশগুলির সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং মতবাদ তৈরিকারীরা এই পরিস্থিতি দ্বারা সব চাইতে বেশি বিচলিত হয়। পৃথিবীতে নিজেদের অবস্থান অনিচ্ছুক, তাদের ইতিহাসের কালো দিকগুলি নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তারা কোনোরকম আলোচনা করতে চায় না । যেসব ঔপন্যাসিক ইতিহাস এবং জাতীয়তাবাদকে অজাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে তাদের সম্পর্কে এরা আবশ্যিক ভাবে সন্দেহ পোষণ করে। এরা মনে করে, যে-ঔপন্যাসিকরা জাতীয় শ্ৰোতৃবর্গের জন্য লেখেন না, তারা বিদেশিদের ভোগের জন্য নিজেদের দেশকে অদ্ভুত ও বিচিত্র সজ্জায় সজ্জিত করে পরিবেশন করে এবং যে সব সমস্যার বাস্তবে কোনো উপস্থিতি নেই তা উদ্ভাবন করে। পাশ্চাত্যে এরই সমান্তরাল একটা সন্দেহ আছে। তাদের অনেকের মতে স্থানীয় সাহিত্যের স্থানীয় চারিত্র্য বজায় রাখা উচিত, শিকড়ের প্রতি তার নির্ভেজাল আনুগত্য অক্ষুন্ন রাখা উচিত। তাদের গোপন আশঙ্কা নিজের সংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বাইরে থেকে শক্তি সংগ্রহ করে একজন যদি “বিশ্ব” লেখক হয়ে ওঠেন তাহলে তিনি তার অকৃত্রিমতা বিসর্জন দেবেন। এই আশঙ্কা যাকে সব চাইতে বেশি পীড়া দেয় তিনি হলেন সেই পাঠক তিনি একটা বই-এর মাধ্যমে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন একটা বিদেশে প্রবেশ করার জন্য এবং সে-দেশের অভ্যন্তরীণ ঝগড়া-বিবাদ প্রত্যক্ষ করার জন্য ব্যগ্র হয়ে থাকেন, প্রতিবেশীর পারিবারিক ঝগড়াঝাটি দেখার জন্য আমরা অনেকে যেমন ব্যগ্র হয়ে থাকি অনেকটা সেই ভাবে। একজন লেখক যদি অন্য সংস্কৃতির এবং অন্য ভাষাভাষী মানুষের উদ্দেশে তার কথাগুলি বলেন তাহলে ওই মায়াকল্পনাও ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
একজন লেখকের অন্তরের গভীরে অকৃত্রিম হবার একটা প্রবল আকুতি থাকে। সেজন্যই, এত বছর পরেও, আমি একটা প্রশ্ন শুনতে ভালোবাসি ; আমি কার জন্য লিখি; তবে একজন লেখকের অকৃত্রিমতার বিষয়টি তিনি যে-জগতে বাস করছেন সেই জগতের সঙ্গে নিজেকে বিজড়িত করবার ক্ষমতার উপর যেমন নির্ভর করে তেমনি ওই জগতে তার নিজের পরিবর্তিত অবস্থানটি বুঝবার ক্ষমতার উপরও নির্ভর করে । একজন আদর্শ ঔপন্যাসিক বলে যেমন কোনো জিনিস নাই তেমনি সামাজিক বাধানিষেধ ও জাতীয় পুরাণকথা থেকে ভারমুক্ত কোনো আদর্শ পাঠকও নাই। কিন্তু, তিনি জাতীয় হন বা আন্তর্জাতিক হন, সকল ঔপন্যাসিকই একজন আদর্শ পাঠকের জন্য লেখেন, প্রথমে নিজের কল্পনার সাহায্যে তিনি ওই পাঠকের অস্তিত্ব নির্মাণ করেন এবং পরে নিজের মনের মধ্যে তাকে ধারণ করে তার গ্রন্থগুলি রচনা করেন।