বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি
দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
ছবিঃ অলক মিত্র
পথ চলতে চলতে চোখে পড়ে কলকাতার স্কাইলাইন কী দ্রুত পালটে যাচ্ছে। এমন একদিন হয়তো আসবে, যেদিন বহুতল বাড়ি আর ব্যস্ত রাস্তার লোকজনের ভিড়ে পুরনো কলকাতার স্থাপত্যের বনেদিয়ানা একেবারেই হারিয়ে যাবে। সেই স্থাপত্যকে যতটা সম্ভব ধরে রাখতেই রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকার পাতায় ১৯৮১ সালের ডিসেম্বর মাসে বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি লেখা শুরু হয়েছিল সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীর নির্দেশক্রমে। এই লেখা প্রসঙ্গে আমরা এমন এক আশ্চর্য, প্রায়-অনাবিষ্কৃত কলকাতায় গিয়ে পৌছেছিলাম, যেখানকার গলি-যুঁজিতে পুরনো ধুলোর গন্ধভরা এক-একটি অট্টালিকার অন্ধকার বিশাল বিশাল কক্ষে সময় আঠারো বা উনিশ শতকে থেমে আছে। সেই কলকাতার ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, সংস্কৃতি আমাদের অভিভূত না করে পারেনি। এই শহর শুধু জোব চার্নকের নয়। কলকাতা গড়ে তুলতে এমন সব মানুষের অবদান আছে, যাঁরা শহর কলকাতার সঙ্গে নিজেরাও সমানভাবে গড়ে উঠেছেন। নিজেরা ধনী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নের শহরকেও বিত্তশালিনী করতে চেয়েছেন নানাভাবে । তাঁরা আজ নেই। কিন্তু কলকাতা গড়ার ইতিহাসে জোব চার্নকের পাশাপাশি তাঁদের নামও সমানভাবে থাকবে। স্থাপত্যের বহিরঙ্গ সৌন্দর্যই তার একমাত্র পরিচয় নয়। তার ভেতরের মানুষজনের ইতিহাস, জীবনচযা ও সংস্কৃতি এই স্থাপত্যেরই অঙ্গ। তাই প্রাসঙ্গিকভাবেই এসেছে বনেদি কলকাতার মানুষজনের কথা। কলকাতার প্রত্যেকটি বনেদি পরিবারের আচার-আচরণ, শখ, শিক্ষা ও সমৃদ্ধির ইতিবৃত্ত স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। সব মিলে এ এক অন্য কলকাতা, চোখের কাছে থেকেও নিজেকে যে চোখের আড়ালে রাখতে ভালোবাসে । অন্য স্বাদের এই কলকাতার পরিচয় আজকের মানুষদের না দিলে কোথায় যেন অসম্পূর্ণতা থেকে যেত বলে মনে হয় । এই কলকাতার ইতিহাস যেমন রাজারাজড়া, জমিদার ও ধনী বণিকদের ইতিহাস, তেমনই এর সঙ্গে মিশে আছে বেশ কিছু সাধারণ মানুষের নিষ্ঠা, বুদ্ধি, অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের কাহিনী । শুধু ব্রিটিশদের তোষামোদ করে নয়, কেউ কেউ তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েও স্বাধীনভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এখানে । তা ছাড়াও আছেন এমন সব মানুষ ও মনীষী, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ, যাঁরা এই গাঙ্গেয় সভ্যতার বুকে এনেছিলেন রেনেসাঁস—যার ঢেউ পরবর্তীকালে বাংলা তথা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অন্যান্য দিক থেকে বনেদি কলকাতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে বাংলা ও বাঙালির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস । এই কলকাতাতেই ঘটেছে নুন উৎপাদক মলুঙ্গি ও নীলচাষিদের ওপর অকথ্য অত্যাচার। বিদেশি রাজশক্তির উত্থানের পাশাপাশি আবার এই শহরেই হয়েছে পরাধীনতার শেকল ছেড়ার যজ্ঞ । লক্ষ লক্ষ দরিদ্রকে শোষণ করে জমিদারেরা বিলাসিতার রংমশাল জ্বালিয়েছেন এখানে, আবার গৌরী সেনের মতো মানুষের দানধ্যানের খ্যাতি পরিণত হয়েছে প্রবাদবাক্যে। ধর্ম ও রাজনীতি, প্রেম ও উদাসীনতা, শোষণ কিংবা দয়াদাক্ষিণ্য—মানুষের সমস্ত রকমের দোষগুণ নিয়েই তৈরি বনেদি কলকাতা । সব ইতিহাসের মতো এর ইতিহাসও যেমন ঘৃণার, তেমনই ভালোবাসারও । আর সবচেয়ে বড় কথা—পূর্বপুরুষদের অবক্ষয়ের শেষ পরিণতি হিসেবে এখনকার বংশধরেরা মুছে যাননি । সময়ের সঙ্গে তাল রেখে, ভাঙাচোরা দরদালানে গজিয়ে-ওঠা সবুজ বটচারাটির মতো তাঁরা সমকালীন পৃথিবীতে খুঁজে নিয়েছেন আলো ও জীবনীশক্তি । জীবিকার প্রয়োজনে ও বাঁচার তাগিদে এরা নতুন নতুন পথে পা বাড়িয়েছেন, কিন্তু গায়ে রয়ে গেছে বনেদিয়ানার শেষ গন্ধটুকু ৷ যা তাঁদের ছিল তা হারানোর দুঃখ থাকলেও তাঁরা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাননি। এ যেমন তাঁদের গৌরব, তেমনই এ-গৌরব কলকাতারও । কলকাতার অতীত সমৃদ্ধি যা ছিল তা প্রায় হারিয়ে গেলেও, কলকাতা ফুরিয়ে যায়নি। বরং প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে এই শহর নতুন করে গড়ে উঠেছে। উঠছে। তাতে তার পুরনো ঐতিহ্য লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেও, কমছে না, প্রসারিত হচ্ছে অন্যভাবে । গ্রিক কবি জর্জ সেফেরিসের কথা মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন—গ্রিস দেশে প্রাচীন গ্রিস বলে কিছু নেই। “Greece is a continuous process. In English the expression ‘ancient Greece’ includes the meaning of ‘finished', whereas for us Greece goes on living, for better or for worse ; it is in life, has not expired yet.' কলকাতার সম্পর্কেও কথাটি খাঁটি। সেফেরিসেরই কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে হয়–’the statues are not the ruins—we are the ruins'.
কলকাতা গড়ে ওঠার পেছনে সপ্তগ্রামের সরস্বতী নদী পরোক্ষ অবদান জুগিয়েছে। সরস্বতী নিজে মরে গিয়ে কলকাতাকে জাগিয়ে দিয়ে গেছে। ১৫২০-৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সরস্বতী নদী পলিমাটিতে বুজে যেতে থাকে। মধ্যযুগে এই নদীর তীরে সপ্তগ্রাম গঞ্জের শ্ৰেষ্ঠীরা মুঘল সম্রাটদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতেন । প্রিয় সপ্তগ্রাম ছেড়ে এসে শ্ৰেষ্ঠীরা তখন তাঁদের বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তুললেন হাওড়ার বিটোরে (আজকের ব্যাঁটরা) সেখানে ব্যবসা চলত পর্তুগিজদের সঙ্গে । শেষ পর্যন্ত তাঁরা গঙ্গার তীরে সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতায় বাসা বাঁধলেন। ছেড়ে-আসা সপ্তগ্রামের স্মৃতি দিয়ে গড়ে তুললেন এই তিনটি গ্রামকে । জোব চার্নকের কৃতিত্ব, তিনি তখনকার এই গ্রাম-গঞ্জগুলির ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বুঝতে পেরেছিলেন। বাকি ইতিহাস অনেকেরই জানা । ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অগস্ট কলকাতার প্রতিষ্ঠা । তারপর ১৬৯৮ সালে ইংরেজরা পান এই তিনটি গ্রামের জমিদারি স্বত্ব । আঠারো ও উনিশ শতকে এই গ্রামপুঞ্জই আধুনিক কলকাতা শহরের রূপ নেয় ।
শ্ৰেষ্ঠী, বণিক, জমিদার ও ইংরেজ কত ব্যক্তিদের নিয়ে তিনটি গ্রাম আস্তে আস্তে কীভাবে মহানগরে রূপান্তরিত হল, তারই একটি রূপরেখা পাওয়া যাবে বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি' গ্রন্থে । ইতিহাস থেমে থাকে না, তা বহমান—এ কথা মানলে কোনও ইতিহাসই সম্পূর্ণ নয়। স্রোতের প্রতিটি তরঙ্গকে ধরা যায় না। আমরা শুধু মূল স্রোতের দিকনির্ণয়েরই চেষ্টা করেছি। চেষ্টায় অসঙ্গতি,অক্ষমতা যে নেই তা নয়। কিছু ত্রুটিবিচ্যুতিও থাকতে পারে। কিছু কিছু বাড়ির কথাও লেখা হল না। কিন্তু এসব কথা স্বীকার করতে দ্বিধা হয় না এই ভেবে যে, পরিশ্রমে ক্রটি করিনি। কালাইল বলতেন, প্রতিভা না থাকলে পরিশ্রম তার ঘাটতি পুষিয়ে দেয়। কথাটা বিশ্বাস করতে ভালো লাগে ।
দুঃখের বিষয় সেই সব পুরনো বাড়ির অনেকই আজ কালের করালগ্রাসে ধ্বংস হয়েছে, কোথাও বা প্রগতির প্রয়োজনে উঠেছে বহুতল বাড়ি—তাই এই গ্রন্থের ছবিগুলি এখন তার ইতিহাসের একমাত্র সাক্ষী ।
বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক!