Ticker

6/recent/ticker-posts

চিরসখা - নবকুমার বসু

চিরসখা - নবকুমার বসু চিরসখা - নবকুমার বসু (অখন্ড পিডিএফ)
সাহিত্য জীবনের কথা বলে। আবার সাহিত্য জীবনকে ছাপিয়েও যায়। জীবনকে কোনও এক বিশেষ বোধে
পৌছে দেওয়াই তো সাহিত্যের ধর্ম। আবার কখনও কখনও এমনও তো হয়, সাহিত্য নিজেই সম্পৃক্ত হল জীবনে। কিংবা বলা যায়, অতিপরিচিত জগৎকে ছুয়ে-ছেনে দেখতে গিয়ে সাহিত্যের বাস্তব আর জীবনের বাস্তব এক হয়ে গেল। তখন বুঝি জীবন থেকে সাহিত্যকে, কিংবা সাহিত্য থেকে জীবনকে আর আলাদা করে ভাবা যায় না। নবকুমার বসুর বৃহত্তম উপন্যাস ‘চিরসখা' এমনই এক সম্পৃক্তির অনুভব।
বিপুলায়তন এই উপন্যাসটিকে লেখক ভাগ করেছেন তিনটি খণ্ডে। যদিও প্রতিটি খণ্ডের সমাপ্তি থেকেই অনুসৃত হয়েছে পরবর্তী অংশটি। অর্থাৎ কিনা উপন্যাসটি টানা একটি খণ্ডে লিখে গেলেও পড়তে কোনও অসুবিধে হত না। সম্ভবত মানসিক অবস্থানের ভিত্তিতে জীবনের পর্যায়গুলোকে ভাগ করে দেওয়াই লেখকের উদ্দেশ্য ছিল। চিরসখা'-র কাহিনি চলেছে প্রায় তিন দশক ধরে। নাকি তার একটু বেশিই ? শুরু সেই পঞ্চাশের দশক থেকে, যখন উপন্যাসের নায়ক বিভাস তার স্ত্রী অপর্ণা ছোট ছোট চার ছেলেমেয়েকে আঁকড়ে, আতপুরের টালির ঘরে, দারিদ্রের সঙ্গে এক লড়াই করে চলেছে। শিল্পী মানুষ বিভাস অবশ্য রাজনীতির সংকীর্ণ উঠোন থেকে পরে সরিয়ে নেয় নিজেকে, একাগ্র মনে ব্ৰতী হয় সাহিত্যরচনায়। কারণ সাহিত্যই যে তার ধ্যান-জ্ঞান-স্বপ্ন। অপর্ণাও প্রতি পলে উপলব্ধি করেছে বিভাসের এই সাহিত্যপিপাসাকে। টের পেয়েছে, সৃষ্টির পথে কোনও রকম বাধা এলেই বিভাস কেমন ছটফট করে। তাই হাজার অভাব অনটনের মধ্যেও বিভাসের প্রতিভাকে সে উজ্জীবিত রাখতে চায়।
এর পর তো আতপুর ছেড়ে নৈহাটি চলে এল তারা। বিভাস ততদিনে তার যথেষ্ট সমাদর, বিভাসের লেখা গল্প-উপন্যাস সিনেমাও হচ্ছে। এদিকে অপর্ণাও একটু একটু করে গড়ে তুলছে নৈহাটির বাড়িটিকে, গানের জগতে ফিরছে। একটি গানের স্কুলও তৈরি করে ফেলল সে। ছেলেমেয়েরাও বড় হচ্ছে ধীরে ধীরে। শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতভবনে গেল মেয়ে, বিয়ে করল। বড় ছেলেও হস্টেলে। সাহিত্যের প্রয়োজনে বিভাসও আর নৈহাটিতে থাকে না, কলকাতা থেকে আসে সপ্তাহান্তে। ক্রমে খ্যাতির চূড়ায় পৌছে গেল বিভাস, আর্থিক টানাটানি এখন অনেক কম। তবু অপর্ণা আর বিভাসের সম্পর্কে কোথায় যেন একটা ফাটল দেখা দিচ্ছিল একটু একটু করে। হয়তো সেটা আত্মিক ভাঙন নয়, হয়তো সেখানে শরীরী মোহের জাদুই বেশি প্রকট, তবু কিন্তু রোখা গেল না পরিণতিটাকে। অপর্ণার সংশয় আর আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে শেষ পর্যন্ত অপর্ণারই কন্যাসম ছোট বোন ইতুকে নিয়ে কলকাতায় আর একটা সংসার পাতল বিভাস। আঘাতে, অপমানে জর্জরিত অপর্ণা ভীষণ রকম অসুস্থ হয়ে পড়ল।
চিরসখা'-র দ্বিতীয় খণ্ড মূলত অপর্ণার নিজেকে সামলে নেওয়া আর আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর উপাখ্যান। বিভাসেরও আত্মানুসন্ধানের কাহিনি। তীব্র অভিমানে পুড়তে পুড়তেও অপর্ণা নতুন করে উপলব্ধি করতে চায় বিভাসকে। মনে হয়, যে মানুষটিকে সে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসে, সেই মানুষটি যেন নিজের কাছে নিজেই অসহায়। অথবা নিজের কৃতকর্মের কাছে। বিভাসের মুখ চেয়ে একসময়ে ইতুকেও মেনে নেয় অপর্ণা। ইতু-বিভাসের ছেলেকে বুকে টানে। তবু একটা ফাঁক বুঝি রয়েই যায়। এই ফাঁকটুকুকে, নাকি ফাঁকিটুকুকে সব থেকে বেশি বুঝতে পারে বিভাস স্বয়ং। এক চাপা অস্থিরতায় পীড়িত হতে থাকে বিখ্যাত সাহিত্যিক বিভাস চৌধুরী। এদিকে সময়ও বয়ে চলে আপন খেয়ালে। অপর্ণার ছেলেমেয়েরাও বিচিত্র আবেগ আর দোলাচলের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ পরিণত হয়ে ওঠে। বাবার প্রতি তাদের আছে এক ধরনের শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালবাসা, কিন্তু মা যেন তাদের অনেক অনেক বেশি কাছের। যেন এক পরম আশ্রয়। তা অপর্ণাও তো এদের সকলকে নিয়েই বাঁচতে চেয়েছিল। বাবা-মা, ভাইবোন, বন্ধুবান্ধব, চেনাপরিচিত সকলের জন্যই তার ভারী মায়া। কিন্তু কোনও ভাবেই তার জীবনে স্বস্তি এল কই! ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যেতে যেতে শেষে তো সে ফুরিয়েই গেল একদিন।
তবু অপর্ণার কি কখনও মৃত্যু হয়? তার প্রিয়জনদের কাছে? চিরসখা'-র তৃতীয় খণ্ডে অপর্ণার এই অদৃশ্য উপস্থিতির কথা শুনিয়েছেন লেখক। লিখেছেন অপর্ণ বিনা বিভাসের আরও একা হয়ে যাওয়ার গল্প। কারণ বিভাসের আত্মার অবলম্বন তো অপৰ্ণাই। দূর নক্ষত্রের আলোটুকু হয়ে যে স্নিগ্ধ করে বিভাসকে। প্রশান্তি দেয়। অপর্ণা আর বিভাসের জীবনের নানা ওঠাপড়া, অন্তর্জগতের সঙ্গে বহির্জগতের অবিরাম টানাপড়েন, কখনও কাছে আসা, ফের সরে যাওয়া, সাফল্য আর প্রাপ্তির মাঝেও বিভাসের চাপা ছটফটানি, চোরা অপরাধবোধ, ইতুর নিরাপত্তাহীনতা, দিদির জায়গাটুকু দখল করার মরিয়া চেষ্টা, নীরবে অপর্ণার কর্তব্যপালন, তার প্রখর ব্যক্তিত্ব, এক বুক কষ্ট নিয়েও কোনও এক অমোঘ বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকা, তারপর একসময়ে হাক্লান্ত হয়ে তার চিরমুক্তি, আবার চলে গিয়েও আত্মজনের হৃদয়ে থেকে যাওয়া—গোটা উপন্যাস জুড়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছেন লেখক। বৃহৎ এই উপন্যাসে আছে আরও অজস্র চরিত্র, শাখাপ্রশাখা মেলে দেওয়া আরও অসংখ্য কাহিনি। আছে বিভাস-অপর্ণার ছেলেমেয়েদের জীবন। তাদের প্রাপ্তি। অপ্রাপ্তিও। ঘটনার বিস্তার কোথাও কোথাও দীর্ঘ মনে হলেও বিশ্লেষণের গুণে তা কিন্তু মানিয়েও যায়। সব চেয়ে বেশি নজর কাড়ে, কোনও একটা ঘটনা বা দৃশ্যের ডিটেলিং। যে কোনও দৃশ্য, খুঁটিনাটি লেখক এত নিখুঁতভাবে ফুটিয়েছেন, যে মনে হয় তিনি যেন প্রত্যক্ষ করছেন দৃশ্যটি।
নবকুমার বসু সত্তর দশকের এক পরিশ্রমী লেখক। প্রবাসে গিয়ে বাংলা সাহিত্যের দুনিয়া থেকে কিছুকাল বিচ্ছিন্ন থাকলেও লেখালিখিতে ছেদ টানেননি। উপন্যাসটির দু’চারটে জায়গায় শব্দচয়নে আর একটু সচেতনতার প্রয়োজন থাকলেও নবকুমারের ভাষা কিন্তু অত্যন্ত সাবলীল। অর্থাৎ সহজ কথা সহজ করে বলার মতো কঠিনতম ক্ষমতাটি তাঁর আয়ত্তে আছে। অন্তত পড়তে গিয়ে বার বার হোচট খেতে হয় না। সব মিলিয়ে ‘চিরসখা' বহমান সুখদুঃখের এক জীবন্ত দলিল। বিভাস আর অপর্ণার জীবনের এক মহাযাত্রা।