সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম - মিহির সেনগুপ্ত
প্রাক-বচন
সব মানুষেরই থাকে এক সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। সে মোকামের ঠিকানা একেকজনের একেক রকম। কেউ বা প্রযত্নে থাকে মঠ-মন্দির-মসজিদ-গির্জার, কেউ বা আবার গগনচুম্বি অট্টালিকার, সাতমহলা বাড়ির, ধন-ঐশ্বর্যের চোখধাধানো সমারোহের। আমার সিদ্ধিগঞ্জের মোকামখানা রয়েছে আমার হৃদয়েশ্বরী জলেশ্বরীর কোলের মধ্যে। সেখানে ভূপ্রকৃতির ইতিহাস নবীন কিন্তু মানুষ প্রাচীন। সে এখনও আধুনিকতার ধরতাই-এ হাটি হাটি পা পা। তার কথার লজে, চলার ছন্দে সামন্ত-পরম্পরার শ্লথ ভাবটি এখনও প্রবল। তথাপি হৃদয়বৃত্তের অলখ বলয়ের সাতরঙের হাতছানিতে সে আমাকে পৌছোয় যে স্থানে, সেই আমার মোকাম-আমার সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম।
সেই মোকামের সওদাগর আমি। ফকিরসাব, মোকছেদ, কার্তিক এবং সর্বশেষ, হ্যা—আমার শেকড়ের শেকড়, পিতৃকল্পপুরুষ ছোমেদ, আমার মহাজন। প্রত্যেক পরম্পরায়ই একজন বীজপুরুষ থাকে। তাকে ঘিরে থাকে তার পুষিপোনা-শিষ্যশাবকেরা। এখানে এই রচনায় উপস্থিত যে-সব মানুষ, তারা সবাই ফকিরসাব, মোকছেদ, কার্তিক এবং ছোমেদের শিষ্যশাবক, পুষিপোনা। এরা কেউই কথাকারের সৃষ্ট একান্ত কাল্পনিক চরিত্র নয়। আমি এমত বলতে বা শপথ করতে পারব না যে, “এই উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা সবাই সম্পূর্ণ কাল্পনিক চরিত্র, যদি কোনও বাস্তব ঘটনা বা চরিত্রের সঙ্গে এর কোনও মিল পাওয়া যায়, তা নিতান্ত আকস্মিক” । না, এ-রকম বলার কোনও উপায় আমার নেই। কেননা এরা সবাই বাস্তব চরিত্র সবাই জীবিত, এমনকী এইসব নামেই। লেখাও হল তাদের কথ্যপাঠ অনুসারেই।
১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯২ সাল, এই ছ'-বছরে একবার করে হলেও শারদীয় উৎসবের সময় আমার এই উজানযাত্রা ঘটেছে। এই সময়কালে যাদের আমি আমার মোকামের জন বলে জেনেছি—সবাই তারা এই রচনায় উপস্থিত। ১৯৬৩র কোনও একটা সময়ে এইসব আত্মজনের আবেষ্টনী ছিড়ে আমাকে এসে পড়তে হয়েছিল নাগরিকতার এই চক্রবৃহে। তখন অবস্থা হয়েছিল চক্রবৃহে শূন্যহাতে যুদ্ধরত সপ্তরর্থীবেষ্টিত অভিমনুর মতো। কিন্তু তার মতো ধরাশায়ী যে হইনি, তার প্রমাণ এই আলেখ্য –সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। এই রচনার কোনও সাহিত্যিক তাৎপর্য আছে কি না, তার বিচার মহাকালরূপী পাঠকের। তবে এই দলিলায়ন করা আমার পক্ষে নিতান্ত আবশ্যক ছিল, এবং তা ছিল আমার কোটির মনুষ্যজনের বঁাচার স্বার্থে। আমার কোটি বলতে এখানে আমি শুধু সমতট বঙ্গীয় নস্টালজিয়াক্লিষ্ট মানুষকেই বোঝাচ্ছি না, বোঝাচ্ছি বৃহৎ বঙ্গীয় তামাম সেইসব মানুষদের যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর তথাকথিত আধুনিকতার স্রোতের ধাক্কায় শিকড়-বাকড় হারিয়ে নাগরিক পঙ্কে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। আমাদের কোটির এই জনেরা ইতিহাসগত কারণেই এখনও লড়ে যাচ্ছে কবে তারা এই পঙ্ক থেকে মুক্তি পাবে এই আশায়। তাই সময়ের দলিল হিসেবে রেখে যাওয়া এই অক্ষর-শব্দ পদবন্ধসমূহ তাদেরই উৎসর্গ করি, যারা আমার সিদ্ধিগঞ্জের মোকামের অদ্যাপিও জাগ্রত মশালধারী। যারা ফকিরসাব, মোকছেদ, কার্তিক এবং ছোমেদের সঙ্গে এখনও উৎসবের রাত্রিতে উজাগর থাকে এবং দুঃখের রাত্রিতে অতন্দ্র থেকে যেসব মহীয়সীরা রাত্রির কিনারায় এসেও স্নিগ্ধস্বরে আহবান করতে পারেন; ওরে তোরা কয়জন আছ, রাইত শ্যাষ অইয়া গেছে, বইয়া পড়, মুই তোগো খাইতে দিতাছি।
Download and Comments/Join our Facebook Group